পরিবেশ দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

    0
    244

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,০৫এপ্রিল,জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরীঃ পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন শান্তিময় সুস্থ্য পরিবেশ। বেঁচে থাকার জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন, সে পরিবেশ আজ নানা কারণে জটিল আঁকার ধারণ করেছে। মানুষ তার আবিষ্কারের প্রতিভা, পরিশ্রম আর দক্ষতা দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা পদ্ধতি সংগ্রহ করেছে, বিজ্ঞান ক্রমবিকাশের ধারায় চরম উন্নতি লাভ করেছে। আর মানুষ সেই গৌরবে অন্ধ হয়ে পৃথিবীর সুন্দর পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। আধুনিক বিশ্বে পরিবেশ একটি বহুল আলোচিত বিষয়।

    সুস্থ্য মনের জন্য যেমন সুস্থ্য শরীর জরুরি তেমনি সুস্থ্য শরীরের জন্য সুন্দর ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু আমাদের প্রকৃতিক পরিবেশ ক্রমেই বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে এবং সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বিংশ শতাব্দিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবন পরিবেশকে ভয়ানক ভাবে দূষিত করছে। বায়ুমণ্ডল, মাটি, পানি, সবই সীমাহীন ভাবে দূষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী মানবসৃষ্ট দূষণের মাত্রা মারাত্মক আঁকার ধারণ করেছে।

    পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ গুলি হচ্ছে- বৃক্ষনিধন ও মরুকরণ, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, যুদ্ধ ও সংঘর্ষ, কীটনাশক ব্যবহার, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, নিষিদ্ধ পলিথিন জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, গ্রিন হাউস এফেক্ট, অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্যসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমশ আমাদের চারপাশ বিনষ্ট ও দূষিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও পরিবেশ দূষণে উপরোল্লিখিত কারণগুলি বিদ্যমান। তবে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ গুলি হচ্ছে- বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও শব্দ দূষণ যা আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকীস্বরূপ।

    মানবজীবনে সুস্থ্য পরিবেশ সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হচ্ছে বায়ু, মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারনের জন্য নির্মল বায়ু অপরিহার্য কিন্তু বিভিন্ন ভাবে সে বায়ু দূষিত হচ্ছে। ইট, কাট, কয়লা, ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে যেমন ধোঁয়া সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি কল-কারখানায় ব্যবহৃত পেট্রোল, ডিজেল থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে, এগুলোর ধোঁয়া ও দুর্গন্ধ বায়ুকে মারাত্মক ভাবে দূষিত করছে, যানবাহন থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস যেমন- কার্বনডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-অক্সাইড, পার্টিকেল ম্যাটার, ও লেড নির্গত হয় যা বায়ুকে দূষিত করছে, ফলে এ্যাজমা, যক্ষ্মা, ফুসফুসে ও হৃদরোগসহ বিভিন্ন বায়ুবাহি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনসাধারণ, এছাড়া বায়ু দূষণের কারণে স্বল্পমেয়াদে চোখ ও নাকে ব্যাথা হয়, ব্রন্কাইটিস ও নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে।

    পানি পরিবেশের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগতের জীবনধারনের জন্য অত্যাবশ্যক। বিশুদ্ধ পানি যেমন জীবনধারনের অবলম্বন তেমনি দূষিত পানি জীবননাশেরও অন্যতম কারণ। কিন্তু সে পানি দূষিত হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে, জলাশয়ের পানিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলা, জীবজন্তুর মৃতদেহ ও জবাইকৃত পশুর বর্জ্য ফেলানোর কারণে পানি দূষিত হচ্ছে, নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলে শিল্পবর্জ্য অনেক বেড়ে গেছে, দেশের অধিকাংশ শিল্প ও কল-কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন বা ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) নেই, ফলে এসব বর্জ্য জলাশয় ও নদীতে পড়ছে, এতে পানি দূষিত হচ্ছে।

    পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের অধিকাংশ নদীর পানি দূষিত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, এছাড়াও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে, এগুলো মাটির নিচের পানির সঙ্গে মিশে মাটির নিচের পানিকে দূষিত করছে এবং বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদী ও জলাশয়ে মিশে নদী ও জলাশয়ের পানিকে দূষিত করছে। পুকুরের পানিতে ময়লা কাপড় ধুয়া ও গরু-ছাগলকে গোসল করানোর কারণে পুকুরের পানি দূষিত হচ্ছে, জলাশয় বা পুকুরের আশেপাশে তৈরী কাঁচা পায়খানার বর্জ্য পানিকে দূষিত করছে। দূষিত বায়ু গ্রহনের ফলে যেমন এ্যাজমা, যক্ষ্মা, ফুসফুসে ও হৃদরোগসহ বায়ুবাহি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি দূষিত পানি পান বা ব্যবহারের ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, আমাশয়, জন্ডিস ও বিভিন্ন চর্মরোগসহ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনসাধারণ।

    মাটি আমাদের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক, শুধু খাদ্যই নয় জীবনধারণের সবকিছুই আমরা মাটি থেকে পাই। বাসস্থান, বস্ত্র, ঔষধ, ইত্যাদির জন্য আমরা যে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল তাও আমরা মাটি থেকে পাই। উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনধারনের জন্য মাটি অপরিহার্য। বর্তমানে মাটিকে আমরা ব্যাপক ভাবে দূষিত করছি, কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা গৃহস্থলি বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলা, হাসপাতালের বর্জ্য সরাসরি মাটিতে ফেলা, কল-কারখানার বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে নিষ্কাশন, অপচনশীলদ্রব্য পলিথিন মাটিতে ফেলার কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, মাটি দূষিত হচ্ছে। দূষিত মাটিতে উৎপাদন কম হয় ফলে বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়না, এতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়, খাদ্য ঘাটতি থেকে বিভিন্ন রোগ তৈরী হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, এছাড়া দূষিত মাটিতে উৎপাদিত ফসল ও শাক-সবজি খেলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।

    শব্দ দূষণ আমাদের দেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতপক্ষে শব্দ দূষণের কারণে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ বধিরতা থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া পর্যন্ত বেশ কিছু মারাত্মক রোগের শিকার হচ্ছে। শব্দ দূষণ ঘটছে মূলত যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক ভেঁপু, শিল্পাঞ্চলে কল-কারখানার বিকট শব্দ, মাইকের উচ্চ আওয়াজ, বাদ্যযন্ত্র বা ক্যাসেট প্লেয়ার দ্ধারা। বাহ্যিকভাবে শব্দ দূষণ তেমন কোন ক্ষতিকারক মনে না হলেও এটি মানুষের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর, উচ্চ শব্দ বা অতিরিক্ত শব্দ জনসাধারণের মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার অন্যতম কারণ, উচ্চ শব্দ বা অতিরিক্ত শব্দ উচ্চরক্তচাপ, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, মাথাব্যাথা, বদহজম ও পেপটিক আলসার এবং অনিদ্রা ঘটায়।

    যে হারে আমাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত হচ্ছে তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের এই সুন্দর বাংলাদেশ আমাদের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ প্রায় সব দেশই চিন্তিত, সভ্যতার অস্তিত্বই আজ এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেকোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা চিন্ত করে সারা বিশ্বেই একটা সচেতন মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমাদের দেশেও পরিবেশ দূষণ রোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।

    পরিবেশ দূষণ রোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে হবে, পরিবেশ সুরক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের সকল শিল্প ও কল-কারখানা গুলোতে বর্জ্য পরিশোধন (ইটিপি) ব্যবস্থা চালুতে বাধ্য করতে হবে, সড়ক-মহাসড়কে কালো ধোঁয়া সৃষ্টিকারী জরাজীর্ণ ইঞ্জিনযুক্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে এবং উচ্চ শব্দের ভেঁপু বাজানোর উপর নিষেধাজ্ঞারোপ করতে হবে, শহরাঞ্চলের ময়লা ও পঁচা আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনদ্রব্য যেখানে সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে, গ্রামাঞ্চলের ময়লা আবর্জনা, কাঁচা পায়খানা, মলমূত্র যাতে খাল-বিল বা নদীর পানিতে না মিশে সেদিকেও জনসাধারণকে খেয়াল রাখতে হবে।

    প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপন ও এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ সহ বর্তমান বনাঞ্চলকে সংরক্ষণ করতে হবে, কারণ বৃক্ষ পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সহায়তা করে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকেও রক্ষাপেতে সহায়তা করে। সুন্দর ও সুস্থ্য পরিবেশ মানবজীবনকে সুন্দর করে, তাই পরিবেশ যাতে সুন্দর থাকে, মানুষের বাসোপযোগী হয় সেদিকে আমাদের প্রত্যেককেই লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের একটু সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি বাঁচাতে পারে আমাদের পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে, দেশটা আমাদের বাসযোগ্য রাখতে আমাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তাই আসুন আমরা সবাই একটু সচেতন হই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উপহার দেই স্বাস্থ্যসম্মত, সুন্দর ও দূষণমুক্ত বাংলাদেশ।লেখকঃ মানবাধিকার কর্মী ও কলামিস্ট।