ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গ্রাম আদালতের ভূমিকা

    0
    223

    আমারসিলেট24ডটকম,তাজমুন নাহার লিজা: গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে স্বল্প খরচে ন্যায়বিচারের সুফল পৌঁছে দিতে ১৯৭৬ সালে প্রণীত হয় ‘গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৭৬’। পরবর্তীতে কিছু সংশোধনের পর ২০০৬ সালে এই অধ্যাদেশটি আইনে রুপান্তর করা হয় ‘গ্রাম আদালত আইন’ নামে। প্রতিটি ইউনিয়নেই গ্রাম আদালত স্থাপনের নির্দেশনা রয়েছে প্রণীত আইনে। এবছরের মাঝামাঝিতে সংসদে ‘গ্রাম আদালত (সংশোধন) বিল ২০১৩’ পাশ হয় (দৈনিক পূণ্যভূমি, ৩০ নভেম্বর ২০১৩)। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) পরিচালনায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউএনডিপির আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ গ্রাম আদালত প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে (সাপ্তাহিক পাতাকুঁড়ির দেশ, ১৮ নভেম্বর ২০১৩)। বিচার-প্রার্থীরা কোর্ট-আদালতে না গিয়ে নিজের ইউনিয়নে এ বিচার কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারছেন গ্রাম আদালতের মাধ্যমে। গ্রাম আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে তৃণমূল মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নকে কার্যকর করে তুলবে।

    বাংলাদেশে গ্রাম আদালতের প্রেক্ষাপট: অসহায়-গরীব মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে, উচ্চ আদালতে মামলার জট কমাতে আর সাধারণ মানুষের দোরগড়ায় সেবা পৌঁছাতেই ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে গ্রাম আদালতের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে এবং সর্বশেষ ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে  গ্রাম আদালত সংশোধন বিল পাশ হয়। ‘অ্যাকটিভেটিং ভিলেজ কোর্টস ইন বাংলাদেশ’ নামে ২০০৯ সালে আমাদের দেশে একটি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করে তোলা। এই প্রকল্প পাইলট জরিপের ভিত্তিতে অল্প পরিসরে বাংলাদেশের ৩৫০টি ইউনিয়নে কাজ করছে। উল্লেখিত প্রকল্পে, ২০১৩, ১৫ জুনে ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়, ২০১০ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ২৬,৯৪৯ টি মামলা দাখিল করা হয়। যার মধ্যে ২০,১০৩ টি মামলা নিষ্পত্তি হয় এবং ১,৬৮৩ টি মামলা জেলা আদালতে প্রেরণ হয়। ২০১২ সালে ২,৮৫০ জন মহিলা গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করেন এবং ২০১২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫,৪৪৩। গ্রাম আদালতে নারী প্রতিনিধি ছিলেন (২০১১;৭%; ২০১২: ৮%)। ১৭ জুলাই ২০১১ তারিখে দ্যা ডেইলি স্টারে গ্রাম আদালত বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের আদালতসমূহে নিষ্পতি না হওয়া মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ লাখ এবং ২০ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সুপ্রীম কোর্টের তথ্যমতে ২০১০ সালে বাংলাদেশের অধস্তন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। অন্যদিকে দৈনিক প্রথম আলোর ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখের প্রতিবেদনে বলা হয় ২০০৭ সালে বাংলাদেশের আদালত সমূহে নিষ্পতি না হওয়া মামলার সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৪। এর ৫ বছর আগে ছিল ৪৬ হাজার ৪৮৫।

    একনজরে গ্রাম আদালত: গ্রাম আদালত আইন ২০০৬ অনুযায়ী ছোট ছোট দেওয়ানী ও  ফৌজদারি বিরোধ নিষ্পত্তি বা মীমাংসা করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গঠিত হয়েছে আদালত। কম খরচে দরিদ্র, অনগ্রসর, নারী, প্রতিবন্ধী, সুবিধাবঞ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও বিচার প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা, উচ্চ আদালতে মামলার চাপ কমানো এবং সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করতেই গ্রাম আদালত গঠিত হয়েছে।

     গ্রাম আদলত গঠন :

    একজন চেয়ারম্যান ও ৪ জন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়।

    বাদী পক্ষ  : ২ জন সদস্য (১ জন ইউপি মেম্বার ও ১ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি)।

    বিবাদী পক্ষ : ২ জন সদস্য (১ জন ইউপি মেম্বার ও ১ জন গণ্যমান্য ব্যক্তি)।

     গ্রাম আদালতের ইতিবাচক দিক সমূহ : গ্রাম আদালতের তফসিলভুক্ত বিরোধসমূহ ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য কোন আদালতের বিচার করার এখতিয়ার  নেই। ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিবাদীকে কারাদন্ড প্রদানে ফৌজদারি মামলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করার বিধান রয়েছে। নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে আদালতের চেয়ারম্যান পরিবর্তন করা যায় এবং ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারে (শাখাওয়াৎ: ২০১২)।

    গ্রাম আদালতের এখতিয়ার: ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে গ্রাম আদালতের এখতিয়ারভূক্ত ধারাগুলো হলো দন্ডবিধির ১৬০,৩২৩,৩৩৪,৩৪১,৩৪২, ৩৫২,৩৫৮,৪২৬,৫০৪,৫০৬ (প্রথম অংশ), ৫০৮,৫০৯ এবং ৫১০ ধারা। এছাড়া ৩৭৯, ৩৮০,৪০৩,৪০৬,৪১৭,৪২০,৪২৭,৪২৮,৪২৯ (যদি ক্ষতির পরিমাণ অনধিক পঁচাত্তর হাজার টাকা হয়) এবং ১৪১,১৪৩,১৪৭ গবাদিপশু সম্পকির্ত (আসামি অনধিক দশজন হলে)। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে-চুক্তি বা দলিলমূলে প্রাপ্য টাকা আদায়, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার এবং গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং কৃষিশ্রমিকের মজুরি সংক্রন্ত মামলাসমূহের বিচার গ্রাম আদালতে করা সম্ভব (দৈনিক সুনামগঞ্জ প্রতিদিন, ২১ নভেম্বর, ২০১৩)।

    ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় গ্রাম আদালতের বিচার প্রক্রিয়া:  বিবাদী পক্ষ কর্তৃক আবেদনপত্র দাখিল ও ইউপি চেয়ারম্যান কর্তৃক যাচাই করা। আবেদনপত্র গৃহীত হলে তার বিবরণ মামলার রেজিস্ট্রারে লেখা, আবেদনপত্রের উপর মামলার নম্বর ও সন লেখা, আবেদনপত্র নাকচ হলে লিখিত আদেশ সহ আবেদনকারীকে ফেরত দেয়া।গ্রাম আদালতের সকল ফরম ও রেজিস্টার যথাযথ ভাবে পূরণ ও সংরক্ষণ করা।   নির্ধারিত তারিখে বিবাদীকে ইউনিয়ন পরিষদে হাজির হবার জন্য সমন ।  বিবাদী আবেদনকারীর দাবি মেনে নিলে গ্রাম আদালত গঠিত হবে না।

    উভয় পক্ষকে ৭ দিনের মধ্যে ২ জন করে সদস্য (একজন ইউপি সদস্য ও একজন স্থানীয় ব্যক্তি) মনোনয়নের নির্দেশ প্রদান করা।

    বাদি ও বিবাদী’র মনোনীত ৪ জন সদস্য ও একজন চেয়ারম্যান, গ্রাম আদালত গঠন ও প্রতিবাদী পক্ষকে ৩ দিনের মধ্যে লিখিত আপত্তি দাখিল করার নির্দেশ দেয়া।

    শুনানির দিন পক্ষদ্বয়ের বক্তব্য ও সাক্ষ্য গ্রহণ এবং সারমর্ম লেখা। বিবাদের বিষয়ে প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে তদন্ত করা।

    সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আদালতের চেয়ারম্যান কর্তৃক প্রকাশ্য আদালতে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা।

     মামলা রেজিস্টার ভুক্তকরণ: যখন কোন আবেদনপত্র গৃহীত হয়, তার বিবরণ গ্রাম আদালত বিধিমালা, ১৯৭৬ এর বিধি ৭(১) মতে ১ নম্বর ফরমের রেজিস্টার বইতে লিপিবদ্ধ করে রেজিস্ট্রার বই অনুযায়ী মামলাটির নম্বর, সন, আবেদনপত্রের উপর লিখতে হবে (টিভি কর্মাশিয়াল ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)

    গ্রাম আদালতে নারীর অবস্থান: আমাদের সমাজে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। সুতরাং ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নারীদের অর্ন্তভূক্ত করার কোন বিকল্প নেই। গ্রামীণ সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অন্যায়, অবিচার ও অপরাধ নারীর প্রতি সংঘটিত হয়ে থাকে, তাই আদালতে নারীর অবস্থান এবং বিচারের প্রবিধান নারীসহ সবার জানা প্রয়োজন। দশ টাকা বা তার অধিক মূল্যের পশু হত্যা বা বিকলাঙ্গ করে অনিষ্ট সাধনের ঘটনা ঘটলে, গবাদি পশু জব্দ কল্পে বল প্রয়োগে বাধাদান বা জোরপূর্বক উদ্ধারের ঘটনা ঘটলে, কোন স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য পুনরুদ্ধার বা মূল্য আদায়ের ঘটনা ঘটলে, কেউ আঘাত করলে, অন্যায়ভাবে আটক ও বাধাগ্রস্থ করলে, অপরাধমুলক অনধিকার প্রবেশ করলে, শান্তিভঙ্গের উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত ভাবে প্ররোচনা বা অপমান করলে, শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে কথা, অঙ্গ-ভঙ্গি বা এ ধরণের কোন কাজ হলে, চুরি ও অসাধুভাবে সম্পত্তি তসরুপ করলে, অনিষ্ট করে পঞ্চাশ টাকা বা তার অধিক ক্ষতিসাধন হলে নারী গ্রাম আদালতে প্রয়োজনীয় প্রতিবিধানের জন্য বিবেচিত হবেন ।

    গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকা: সকল সীমাবদ্ধতা দূর করে গ্রাম আদালত আইনের স্বচ্ছ ও সঠিক বাস্তবায়নে গণমাধ্যম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষ করে, স্থানীয় গণমাধ্যম গ্রাম আদালত আইনের উদ্দেশ্য, গঠন, এখতিয়ার, রেজিস্টার ভুক্তিকরণের উপর নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে তা গণমাধ্যমের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সকলের মাঝে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ তৈরি হবে এবং সাধারণ মানুষ গ্রাম আদালতের সুফল আরো বেশি করে পাবে।

    উপসংহার: গ্রাম আদালত সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা এবং আদালতে দায়িত্বরত বিচারকদের দক্ষতার অভাবে গ্রাম আদালত এখন পর্যন্ত কাঙ্খিত মানে উন্নীত হতে পারেনি। গ্রাম আদালতের কার্যক্রম এখনও তুলনামুলকভাবে ধীর গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। সরকারি- বেসরকারিভাবে গ্রামীন অঞ্চলে যথেষ্ট প্রচারণা চালালে এই আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা আরো বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে গ্রাম আদালতের বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ ব্যাক্তিদের যথাযত আইনি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা আর এতে গ্রাম আদালত কার্যকর হবে, সুফল পাবে জনগন।