নিজের নিয়োগ অবৈধ,তবুও ১২ বছর ধরে অধ্যক্ষ !

    0
    276

    মৃত সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ

    রেজওয়ান করিম সাব্বির, জৈন্তাপুর (সিলেট) সংবাদদাতাঃ সিলেটের জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরীর নিয়োগ অবৈধ হলেও তিনি এ পদে বহাল রয়েছেন। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা টিম অধ্যক্ষের নিয়োগ অবৈধ বলে প্রতিবেদন দেয় এবং নিয়োগ প্রাপ্তির পর থেকে এমপিও বাবদ উত্তোলিত সমুদয় অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে।

    কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নির্দেশনাটি ধামাচাপা দিয়ে অধ্যক্ষ পদে বহাল থাকছেন মফিজুর রহমান। গত ১৯ বছরে মাত্র একবারের অভ্যন্তরীন অডিটে নানা আর্থিক অনিয়ম ও কেলেংকারির চিত্র ফুটে উঠে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ৭বৎসর পূর্বে মারা যান, সেই সভাপতির জাল প্রতিস্বাক্ষর দেখিয়ে ইতো মধ্যে ২জন শিক্ষক নিয়োগ এমপিও ছাড় করেন এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগোর পর এমপিও ছাড় করানোর প্রক্রিয়া রয়েছেন।
    সম্প্রতি বিভিন্ন দপ্তরে অধ্যক্ষ মফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে পাঠানো অভিযোগ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ছিলেন লোকমান হোসেন। তিনি কর্মরত থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ অবৈধ পন্থায় ভুয়া নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরী অধ্যক্ষ পদে অবৈধ ভাবে নিয়োগ লাভ করে। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বৈধ করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর পুনরায় অবৈধ ভাবে নিয়োগ লাভ করেন। নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরী নিজেই দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া, ২০০০ খ্রিস্টাব্দে কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান দেখালেও ২০০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান তৈয়ব আলী কারিগরি কলেজ থেকে সরকারি বেতন-ভাতা গ্রহণ করেন তিনি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরী ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে নিয়োগ লাভ করে। তিনি এইচএসসি ও বিকম তৃতীয় শ্রেণী এবং মাস্টার্স পূর্ব ভাগে তৃতীয় শ্রেণী ডিগ্রীধারী। অর্থাৎ তার একাধিক তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। নিয়োগকালে ভুয়া তথ্য প্রদান করেছেন এবং কাম্য অভিজ্ঞতা না থাকায় মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অধ্যক্ষের নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরী এ প্রতিবেদনের জবাব দাখিলের পর ২০১২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ব্রডশিট জবাব অনুমোদনে অনেক গুলো সিদ্ধান্ত প্রদান করে। ব্রডশিট জবাবে দেখা যায়, অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরীর নিয়োগ বিধি সম্মত না হওয়ায় উত্তোলিত সমুদয় বেতন ভাতার সরকারি অংশের অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয় তাকে। এমনকি অর্থ জমাদানের চালানের সত্যায়িত ছায়ালিপি পত্র জারির ৩০ দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। ব্রডশিটে অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরী তৈয়ব আলী ডিগ্রী কলেজে যোগদানের পর তৈয়ব আলী কারিগরি কলেজ থেকে অতিরিক্ত উত্তোলিত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দানের নির্দেশও দেয়া হয়েছিল। এদিকে, কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিটেও অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারীর চিত্র ফুটে উঠে। গত ১৯ বছর ধরে তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করলেও তার মেয়াদকালে কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিট হয়েছে মাত্র একবার। অভিযোগ উঠেছে, অধ্যক্ষ কলেজের গভর্নিং বডিকে ব্যবহার করে এসব অনিয়ম করে যাচ্ছেন। সূত্র জানায়, ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেখিয়ে নিয়োগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি মরহুম রশিদ হেলালী অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। কিন্তু, অধ্যক্ষের সহোদর ও রাষ্ট্রপতির তৎকালীন প্রেস সচিব মোখলেছুর রহমান চৌধুরীর সুবাদে তিনি ঐ যাত্রায় নিজেকে রক্ষা করেন।
    নিজের অবৈধ নিয়োগের পথ অবলম্বন করে তার অত্যান্ত দূরদর্শী ও আস্থাভাজন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক শফিকুর রহমানের সমন্বয়ে জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কয়েক জন তৃতীয় শিক্ষকের নিয়োগ দেখানো হয়। গত জানুয়ারি মাসের এমপিও শীটে ঝিনাইদহ জেলার লিটন কান্তি রায় ও মোহাম্মদ শাহ জাহান নামে দুই জন প্রভাষক ডিগ্রি শাখার তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে বেতন প্রাপ্ত হন।

    আগামী এমপিওতে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে আরো কয়েক জনের বেতন প্রাপ্তির বিষয়টি প্রক্রিয়াধিন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এসকল শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে বর্তমান গর্ভানিং বড়ি কিছুই জানে না, জানেন শুধু অধ্যক্ষ মুফিজুর রহমান চৌধুরী ও ইসলামের ইতিহাসের আদালত কর্তৃক ৬মাসের সাজা ভূক্ত শিক্ষক শফিকুর রহমান।

    মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক প্রতাপ চৌধুরী জানান, জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমানের নিয়োগ বিধি সম্মত নয় মর্মে তারা একটি অভিযোগ পেয়েছেন। কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধির ওই অভিযোগ প্রাপ্তির পর তারা সংশ্লিষ্ট অভিযোগকারী এবং অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করেছেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করে তারা এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ে পত্র দিয়েছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
    কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরী এ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তাঁর নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করার কথা স্বীকার করলেও এসব আপত্তি পরবর্তীতে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানান। তবে নিস্পত্তির কোন ডকুমেন্ট দেখাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তিনি এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন। এ ব্যাপারে কলেজের শিক্ষক বৃন্দ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অধ্যক্ষ মোঃ মফিজুর রহমান চৌধুরীর নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করে ইতিপূর্বে গ্রহণকৃত বেতনের টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ফেরত দানের নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু, মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ উপেক্ষা করে তিনি দীর্ঘদিন ধরে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
    অপরদিকে ৭বৎসর পূর্বে মারা যাওয়া সভাপতির প্রতি স্বাক্ষর জাল করে অর্থের বিনিময়ে অবৈধ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে এমপিও ছাড় করাচ্ছেন। যে দুই জন শিক্ষক ইতোমধ্যে এমপিও ভূক্ত হয়েছেন তারা কখনো এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেননি। অনুসন্ধানে শিক্ষকদ্বয়ের নাম কোন ছাত্র/ছাত্রী, কর্মরত শিক্ষক কর্মচারিরা শুনেনি এবং দেখে নাই। গায়েবী এই শিক্ষক নিয়োগটি জানতে পেরে তাৎক্ষনিক ভাবে তাদের বেতন ভাতা বন্ধ করে দেয় বর্তমান গভানিং বড়ি। বিশ্বস্থ সূত্র দাবী তুলেছে টাকার কোন সমস্যা নাই, শিক্ষক নিয়োগ বাবত প্রাপ্ত অর্থ এবং তাদের বেতন ছাড় করাতে ভাগ বন্টন করার জন্য দফা রফার চেষ্টা চলছে অধ্যক্ষের বিশ্বস্ত আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত প্রভাষক শফিকুর রহমান।
    বর্তমান শিক্ষক প্রতিনিধি সহকারি অধ্যাপক খসরু নোমানের সাথে আলাপকালে তিনি প্রতিবেতককে জানান, আমরা দীর্ঘ দিন থেকে শিক্ষকতা করে আসলেও এরকম অবৈধ্য নিয়োগ কোথাও দেখিনি। প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে হাজিরা না থেকে এমনকি পাঠদান না করে শিক্ষকদের নিয়োগ হয়ে এমপিও ভূক্ত হয়ে যায়। বিষয়টি কৌতুহলের, আমরা গভানিং বড়িকে জানালে তাৎক্ষনিক ভাবে তাদের বেতন বন্ধ করা হয়েছে।
    বর্তমান গভানিং বড়ির সভাপতি এটিএম বদরুল ইলামের সাথে আলাপকালে তিনি জানান- অধ্যক্ষে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি আমার পূর্ববর্তী কমিটির সভাপতিরা জানেন কি করে তিনি নিয়োগ পেলেন। হঠাৎ করে দুইজন শিক্ষকের বেতন এমপিও শীটে আসা এবং আলাদা ভাবে উত্তোলনের বিষয়টি ধরা পড়ায় আমি তাদের বেতন বন্দ করে দিয়েছি। পুরো নিযোগ প্রক্রিয়াটি যাচাই বাছাই করে দেখে যদি অসংগতিপাই তাহলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহক করা হবে।
    এবিষয়ে জানতে ইসলামের ইতিহাসের প্রভাষক শফিকুল ইসলামের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন- ২০০০ সনে তাদের নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। তৃতীয় শিক্ষক নিয়োগ মন্ত্রনালয়ের বন্দ থাকায় এতদিন তাদের এমপিও ভূক্ত হয়নি। সম্প্রতি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিও ছাড় হওয়ায় তারা বৈধ ভাবে এমপিও ভূক্ত হয়েছেন। তারা প্রতিষ্ঠানে আসেনি এমনকি অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষকপ্রতিনিধি, কিংবা গভানিং বড়ি বিষয়টি জানেন না প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দেন।
    এবিষয়ে জানতে অধ্যক্ষ মফিজুর রহমান চৌধুরীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে গত দুদিন থেকে কয়েক দফা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।