নাম পরিবর্তন:ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ কাম্য

    0
    331

    মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলামঃ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকে নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি চলে আসছে। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময় স্থান ও নিদর্শনের নামকরণ ও নাম পরিবর্তন হয়ে আসছে। তৎমধ্যে ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কারণে নাম পরিবর্তন বেশি হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে বেশ ক’বছর ধরে বিভিন্ন এলাকা ও স্থাপনার মুসলিম নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপির মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেন নাম পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা চলছে।

    একসপ্তাহ পূর্বে ভারতের উত্তর প্রদেশের (আল্লাহাবাদ) এলাহাবাদের মুসলিম নাম পরিবর্তন করে প্রেয়াগরাজ রাখা হয়েছে। এলাহাবাদ উত্তর প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর। ১৬শ শতাব্দীতে দিল্লীর মুগল সম্রাটরা এই শহরের নাম রেখেছিলেন এলাহাবাদ। প্রায় দশ লক্ষ লোকের বাস এই শহরে। আর এই শহরেই জন্ম হয়েছিল ভারতের পন্ডিত জহুরলাল নেহেরুর। ১৯শ সালের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক বৈঠক ও সংগ্রামের স্মৃতি বহন করে চলেছে এই শহর। এভাবে নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।

    নিম্নে ভারতে নাম পরিবর্তনের কয়েকটি পরিসংখ্যান উল্লেখ করছি- * ভারতে মুসলিম নাম ‘আহমেদাবাদ’ পরিবর্তন করে করা হচ্ছে অ্যামদাবাদ। * ভারতের আসাম রাজ্যের বাংলাভাষী বরাক উপত্যকা। বছর কয়েক আগে সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নাম আসাম ইউনিভার্সিটি। শিলচর শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে যে স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত তার নাম দরগাকুনা। হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে কোন একজন দরবেশ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ কারণে, তাঁর স্মৃতিধন্য এলাকাটির নাম হয়েছে দরগাকুনা।

    এলাকার ডাকঘরের নামও রাখা হয়েছে দরগাকুনা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ডাকঘরটির নাম ছিল দরগাকুনা। প্রায় ২০-২২ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকাটির যখন গুরুত্ব বেড়ে গেল, তখন ডাকঘরটির নামও পাল্টে গেল। ‘দরগাকুনা’ এবার হয়ে গেল ‘দুর্গাকুনা’। ডাকঘর কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে কাজটি করা হয়েছে সরকারিভাবে। কাগজ-পত্রে বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ার পর স্থানীয় লোকগণ যখন ডাকঘরটির নাম-বিকৃতির প্রতিবাদ করলেন, তখন বলা হলো, এটা ভুলে হয়ে গিয়েছে, সংশোধন করা হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভুলটি আর সংশোধন করা হয়নি বা হবার কোন উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না।

    *কিছুদিন আগে উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী মুঘলসরায় রেলস্টেশনের নাম পাল্টে রাখা হয় হিন্দু দীনদয়ালের নামে। * মুসলিম শাসক আওরঙ্গজেব সড়কের নামও করা হয় পরিবর্তন। * সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানে ৮টি গ্রামের মুসলিম নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম দেয়া হয়েছে। রাজস্থান রাজ্যের বড়মে জেলার ‘মিয়া কা বড়া’ নামের একটি গ্রামের নাম বদল করে করা হয়েছে ‘মহেশপুর’। অন্যদিকে রাজ্যের অপর একটি গ্রাম ‘ইসমাইলপুর’ এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘পিচানবা খুর্দ’। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এমন আরও ৬টি গ্রামের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে রাজস্থানে। যেগুলোর অধিকাংশ ছিল মুসলিম নাম।

    গত ১ জুন ২০১৮ সেই গ্রামগুলির মধ্যে ৮টি গ্রামের নাম পরিবর্তন আবেদন মঞ্জুর করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম মরোরার প্রবেশমুখে বিশাল একটি বিলবোর্ডে হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা ‘ট্রাম্প গ্রামে স্বাগতম’৷ বিলবোর্ডে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি হাসি মুখের ছবি দেখা যায়। আলীগড় জেলায় বিভিন্ন স্থানে ‘আলীগড়’ শব্দের স্থানে বর্তমানে লেখা হচ্ছে ‘হরিগড়’। মধ্যপ্রদেশের আজমগড়কে এখন বলা হচ্ছে ‘আরইয়মগড়’। মির্যাপুরকে পরিবর্তন করে লেখা হচ্ছে ‘মীরজাপুর’। কারণ, হিন্দুদের ধারণা এ স্থানটিতে নাকি তাদের দেবী মীরজা বাস করতেন। লক্ষ্ণৌ শহরের প্রসিদ্ধ ‘বেগম হযরতমহল’ পার্ককে এখন বলা হচ্ছে ‘উর্মিলা ভাটিকা’।

    মুসলিম ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন নাম পরিবর্তনের কাজ ভারত বিভাগপূর্বকালেও হয়েছে সুচতুর হিন্দুত্ববাদী ব্রাহ্মণদের কারণে। যেমন- পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর এক সময় ছিল মদিনাপুর। পরে অত্যন্ত সুচতুরভাবে নামটিকে বিকৃত করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার ঠিক পর থেকেই মহারাষ্ট্র রাজ্যের Poona শহর হয়েছে pune এবং Thana হয়েছে Tane। অনুরূপভাবে, গুজরাটের বারোদা হলো ভাদদ্রা। হুসাইন সাগর নামক যে মশহুর হ্রদটি সারা হায়দরাবাদ শহরের পানির প্রয়োজন মেটায়, তাকে এখন বলা হয় ‘বিনায়ক সাগর’।

    কারণ, কোন এক হিন্দু নাকি বলেছে, তাদের পৌরাণিক দেবতা গণেশের মূর্তিকে এ সাগরে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। শুধু হুসাইন সাগর কেন, এমনকি ‘হায়দ্রাবাদ’ শহরটির নাম পরিবর্তন করে ‘ভাগ্যনগর’, ফয়যাবাদকে সাকেট এবং লক্ষ্ণৌকে লক্ষণপুর নামকরণ করতে ভারত সরকারের নিকট দাবি জানানো হচ্ছে। নাম পরিবর্তনের জন্য আরও নতুন নতুন দাবি উঠছে। হয়তো কয়েকছরের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য রক্ষিত হয়, তেমন কোন স্মৃতি অবশিষ্ট থাকবে না। (সূত্র: ইন্ডিয়ান টাইমস, আরাবিয়া জার্নাল, বিবিসি, বিভিন্ন দৈনিক)

    এবার আমাদের প্রিয়দেশ বাংলাদেশে দেখুন-ভারতে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের স্মৃতি সহ্য করতে পারছে বলেই নাম পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তী একজন অমুসলিম শাসক ক্ষমতাসীন না হলেও আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপত্যে বা এলাকার নাম যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি  মুসলিম বা ইসলামী নামও পরিবর্তন বা বিয়োজন  হয়েছে। আমরা ইতিহাস দেখতে পায়, ভারতে নাম পরিবর্তনের উল্টো প্রতিক্রিয়া কখনও বাংলাদেশে হয় নি, বরং ভারতের অনুসরণে সুযোগ বুঝে মুসলিম নাম পরিবর্তন হয়েছে। যেমন, অবিভক্ত ভারতের সিলেটের অন্তর্গত করিমগঞ্জে ব্রিটিশ আমলে জনৈক মুসলিম ধনাঢ্য এহিয়া সাহেব ‘এহিয়া কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পর উক্ত কলেজকে পরিবর্তন করে ‘করিমগঞ্জ কলেজ’ করা হয়।

    অথচ সিলেটে তার কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। সিলেটের হিন্দু ঐতিহ্যবাহী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আজও স্বনামে অবস্থান করছে। যেমন, মুরারীচাঁদ কলেজ, মদনমোহন কলেজ, রাজা গিরীশচন্দ্র হাইস্কুল, দুর্গাকুমার পাঠশালা, সারদা হল প্রভৃতি। অনুরূপভাবে, সিলেটের বিশ্বনাথ  ও জগন্নাথ  উপজেলা হিন্দুদের দু’জন দেবতা নামে যা পরিবর্তনের চিন্তাও কেউ করে নি।

    এমনিভাবে চট্টগ্রামে জে. এম. সেন স্কুল কলেজ, নারায়ণহাট আদর্শ কলেজ, হেয়াকোঁ বনানী কলেজ, স্যার আশুতোষ কলেজ, মুজাফ্ফরাবাদ যশোদা নগেন্দ্র নন্দী মহিলা কলেজ, কুন্ডেশ্বরী মহিলা কলেজ, রামু কলেজ, কালিবাড়ি, শেঠপাড়া, ব্রাহ্মণপাড়াসহ সারাদেশে অমুসলিম ধর্মীয় নামের হাজারো স্থাপনা /প্রতিষ্ঠান/এলাকা রয়েছে।

    কোন মুসলমান কখনো এসব নাম পরিবর্তনের প্রশ্ন তুলেনি। অস্বাভাবিক, অকল্পনীয় ও দুঃখজনক হলেও সত্য ও বাস্তব যে, স্বাধীন-সোনার বাংলাতেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কালে ‘মুসলিম’ বা ইসলাম ধর্মীয় শব্দ মুছে দেয়ার বা পরিবর্তন করার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের তুলনায় ধর্মনিরপেক্ষতায় আমরা (বাংলাদেশ) যেন কয়েক ডাং এগিয়ে! কয়েকটি পরিসংখ্যান দেয়ার চেষ্টা করব।

    পশ্চিম বঙ্গ ও কলকাতার কট্টরপন্থী হিন্দুদের বিরোধীতার পরও নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯২১ সালে ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলমানদের তাহজীব তমদ্দুন রক্ষার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বলে এর মনোগ্রামে উৎকীর্ণ হয়েছিল , ‘রাব্বি জিদনী এলমা’ বাক্যটি, যার অর্থ ‘হে আল্লাহ্ আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’ মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ ও মানসম্মত শিক্ষা বিস্তার এটির উদ্দেশ্য ছিল বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এশিয়ার বৃহত্তম ছাত্রাবাসটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাম দেয়া হয় ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’।

    অথচ, মুসলমানদের কষ্টেসৃষ্ট এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো থেকে ‘রাব্বি যিদনী এলামান’ বাদ দেয়া হয়েছে এবং ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়া হয়েছে। মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষের শিকার হয়েছে জাহাঙ্গীনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, ফজলুল হক মুসলিম হল। এসব থেকেও মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়েছে। ঢাকার পুরাতন আলিয়া মাদরাসা ক্যাম্পাসে স্থাপিত ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের নামের সাথে ইসলামিক শব্দটি থাকায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে হয়েছে কবি নজরুল কলেজ (নজরুল ইসলাম নয়)। সব সমস্যা যেন ইসলাম ও মুসলিম শব্দে!  একসময়ের চট্টগ্রামের ইকবাল রোডের নাম রাখা হয়েছে শেখ মুজিব রোড। এতে সমস্যা নাই , এর বঙ্গবন্ধুর নামে করা হয়েছে। আমিও বিশ্বাস করি এবং বাঙ্গালী বলতেই মানতেই হবে, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। যিনি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, তার নামে একটি সড়কের নামকরণ বেশি কিছু নয়। কিন্তু ঐ সময়ে সারা বাংলাদেশে অসংখ্য স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। তখন নিম্নোক্ত নামসমূহ কি পরিবর্তন করা যেত না? যেগুলো বিট্রিশরা পরিবর্তন করেছিল।

    যেমন- ময়মনসিংহ এর পূর্ব নাম ছিলো মোমেনশাহী, এর পর হয় নাসিরাবাদ। কিন্তু ব্রিটিশরা কথিত ভুলের অজুহাতে এর নামকরণ করে ‘ময়মনসিংহ’। ইতিহাসের ‘ভুল’ স্বাক্ষী বহন করে বিধায় এ নামটি পরিবর্তন করা কি জরুরী নয়? তেমনি ঈশা খাঁর দীঘিকে পরিবর্তন হয়ে ঈশ্বরদী হয়েছে। এ বিকৃত নামটি পরিশুদ্ধ করা কি প্রয়োজন নাই? নাটোর এর নামকরণে বিভিন্ন মতের মধ্যে একটি হলো- নটিপাড়া হতে নাটোর। এখানে একটি নটিপাড়া ছিল। নটিপাড়া গ্রামটি রাজা ও জমিদারগণের আমোদ-ফুর্তির জন্য গড়ে তোলা হয়েছিলো। রাজা ও ধনীরা এখানে এসে নৃত্য, গান এবং অন্যান্য আমোদপ্রমোদে লিপ্ত থাকতো।

    কথিত হয়, এ নটিপাড়া হতে এলাকাটির নাম হয় নটিপাড়া বা নটিপুর। নটিপাড়া বা নটিপুর শব্দটি ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে নাটোর নামে স্থিতি পায়। এরকম ঘৃণ্য ও লজ্জাজনক ইতিহাস বহন করা নাম পরিবর্তনের কি প্রয়োজন নাই? পাঠকসমাজের মনে প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারে- আওয়ামীলীগ সরকার ও চারদলীয় জোট সরকার বিভিন্ন স্থাপনার নাম ইসলামী বা পীর-আউলিয়াদের নামে করেছেন। যেমন- জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এম এ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে শাহ আমানত বিমানবন্দর করা হয়েছে।

    বাংলাদেশের সাধারণ জনতা শুধু নয়, আওয়ামীলীগ-বিএনপির কোন নেতাকর্মীও আউলিয়াদের নামে নামকরণ বা পরিবর্তনকে  সৎ উদ্দেশ্য করা হয়েছে মনে করেন না। সবাই জানে ও মনে করে, এসব নাম পরিবর্তনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদীরা সুযোগ পেলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে- এসব তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার সুযোগ পেলে সম্পূর্ণ মুসলিম শব্দ বাদ দিতেও একমুহূর্ত চিন্তা করেন না বলে মনে করা হয়। সদ্য প্রয়াত চট্টগ্রামের সন্তান জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী আইঁয়ুব বাচ্চুর নামাযে জানাযার আগে সদরঘাটস্থ বাচ্চুর নানার বাড়ীতে (২০ অক্টোবর ২০১৮) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ. জ. ম নাসির উদ্দিন সাহেব মুসলিম হলের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াত আইঁয়ুব বাচ্চুর নামে করার ঘোষণা দেন।

    তিনি মন্ত্রণালয়ে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবনা পাঠানোর কথাও বলেন। এতে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষতঃ সংবাদমাধ্যমে এটি প্রচারিত হলে অনলাইন-অফলাইনে ঝড় উঠে। গুটিঁকয়েক মানুষ তা স্বাগত জানালেও সবার অভিমত  জনপ্রিয় শিল্পী বাচ্চুর নামে নতুন সাংস্কৃতিক হল করা যায় বা মুসলিম হলের নির্মাণাধীন যেকোন মিলনায়তনের নাম দেয়া যায়। এতে কারো আপত্তি থাকার কথাও নয়। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী মুসলিম হল বেছে নিলেন কেন- এ প্রশ্ন সবার। আমিও মনে করি, আইঁয়ুব বাচ্চুর মতো একজন জনপ্রিয় শিল্পীকে বিতর্কিত করার জন্য এতটুকু যথেষ্ট নয় কি? মুসলিম হলের সাথে শুধু মুসলমান নয়, চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। ১৯৫৩ সালে কে সি দে রোডে বর্তমান মুসলিম ইনস্টিটিউট হল নির্মিত হয়।

    তখন থেকে চট্টগ্রামের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ অংশ হিসেবে রূপ নেয় এ মুসলিম হল। মুসলিম শব্দটিতে অবশ্যই মুসলমানদের আবেগ কাজ করে ও করবে, স্বাভাবিক বিষয়। তাই মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে বাচ্চু হল নামকরণ চট্টগ্রামবাসী মেনে নেবে না। ইতোমধ্যে এ প্রস্তাবনা বাতিলের দাবিতে চট্টগ্রাম মুসলিম ঐতিহ্য ও স্থাপত্য সংরক্ষণ পরিষদ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে। তেমনি কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে শিল্পী বাচ্চুর নামে জে এম সেন হলের নামকরণের দাবি করছেন, ইহাও সাম্প্রদায়িক ও অযৌক্তিক দাবি। এধরণের পরস্পর বিরোধী দাবি চট্টগ্রামের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে পারে। অনেক গবেষক ও চিন্তাবিদদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ও বাংলাদেশে নাম পরিবর্তনে যে সাম্প্রদায়িক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এতে দু’দেশে পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের তাহজিব-তামাদ্দুন, ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে দেয়ার একটি দুষ্টুচক্রের অঘোষিত পরিকল্পিত ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র চলছে।

    বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক এডভোকেট মোছাহেব উদ্দিন বখতেয়ার এর মতে, ‘ইসলাম আর মুসলিম নাম কাটাকাটি চলছে ৭২ থেকে। মুসলিম হলের নাম কেটে শান্তি পাবার পর মুসলিম স্কুলেও কাটাকাটি হবে।’ তাই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে প্রশমিত করতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল যথাযথ ভূমিকা রাখা জরুরি। অন্যথায়, অত্র এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্ট হতে পারে। সামনে একাদশ সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনের প্রাক্কালে এরকম পরিস্থির সৃষ্টি হোক সরকারও নিশ্চয় চাইবেন না। জনপ্রতিনিধিরা জনগনের সেবক, তাই তাদেরকে জনগনের মনের ভাষা বুঝতে, সে অনুযায়ী কর্মসূচি বা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জনপ্রতিনিধির আসনে বসে অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়া বা ঘোষণা দেয়া দেশ-জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়।

    সর্বসাধারণের প্রত্যাশা, দেশসেরা শিল্পী চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান আইঁয়ুব বাচ্চুর নামে নতুন কোন হল ও স্থাপনার নামকরণ করে তাকে সম্মানিত করা হবে, তেমনি ঐতিহ্যবাহি মুসলিম হল স্ব-গৌরবে সমুজ্জ্বল রবে। মেয়র সাহেবসহ সংশ্লিষ্টদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।লেখক: সদস্য সচিব, অর্কিড সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা।E-mail: faridulislam.ctg@gmail.com