নবাব সলিমুল্লাহ’র বংশধর পরিচয় দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ

    0
    346

    নিজেকে নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরিচয় দেন ফুপু হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক আত্মীয় হিসেবে গণভবনে তার নাকি অবাধ যাতায়াত। দুবাইয়ে আছে গোল্ডের কারখানা। বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, থাকেন নিউ ইয়র্কে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানায় অংশীদারিত্ব রয়েছে তাদের। বাবার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি নিজেই। ফেসবুক প্রোফাইলে মন্ত্রী-এমপিসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে তার ছবি। চলেন বডিগার্ড নিয়ে। নিজে থাকেন নেদারল্যান্ডসে। বছর পাঁচেক ধরে দেশে এসেছেন। দানবীর। এরকম আরও অনেক পরিচয় তার। কিন্তু আসলে সবই ভুয়া। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করাই তার পেশা। প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। ভয়ঙ্কর এই প্রতারকের নাম আলী হাসান আসকারী। বুধবার রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে।

    সিটিটিসির ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আসকারী একজন ভয়ঙ্কর প্রতারক। সে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। নবাবের বংশধর হিসেবে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে সে এসব প্রতারণা করতো। প্রতারণার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ফুপু বানিয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের নামও ভাঙিয়েছে। আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার প্রতারণার আরও কৌশল জানা ও প্রতারণা করে আয় করা অর্থ কোথায় পাচার করেছে, তা জানার চেষ্টা করছি।’

    যেভাবে প্রতারণা করতেন আলী হাসান আসকারী

    পুলিশ জানায়, বছর পাঁচেক আগে নিজের নামের সঙ্গে খাজা শব্দটি যোগ করেন আলী হাসান আসকারী। নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর খাজা আমানুল্লাহ আসকারীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন এই প্রতারক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেকে নবাবের বংশধর হিসেবে প্রচারণা শুরু করেন। একইসঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, জ্যেষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রোগ্রামে পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতেন। সেসব ছবি প্রচার করতেন ফেসবুকে। এগুলো ছিল প্রতারণার হাতিয়ার। প্রতারণার কাজে ১০-১২ জনকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি চক্র। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করতেন। তারপর কৌশলে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেন আসকারী। নিজের বিত্ত-বৈভব ও নবাবের বংশধর পরিচয় দিয়ে খাতির জমাতেন। তার বাবার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ৭০০ নার্স নিয়োগ করা হবে জানিয়ে কর্মী দিতে বলতেন। নবাবের বংশধর হিসেবে অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন। টাকা নেওয়ার পরপরই তাদের ফোন আর ধরতেন না। মোবাইল নম্বর ব্লকলিস্টে রাখতেন। কেউ বাড়াবাড়ি করতে চাইলে হত্যার হুমকিও দিতেন।

    পুলিশ জানায়, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নার্স নিয়োগের নামে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন। এছাড়া পোলান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর নামেও টাকা নিয়েছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার নাম করেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার নাম ভাঙাতেন তিনি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসকারী স্বীকার করেছেন, তার এই প্রতারণার কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগী ছিল রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা, মীর রাকিব আফসার, সজীব ওরফে মীর রুবেল, আহাম্মদ আলী ও বরকত আলী ওরফে রানা। এরমধ্যে রাশেদ, আহাম্মদ ও বরকত আপন তিন ভাই। বড় ভাই আহাম্মদ তার ম্যানেজার ছিল। রাশেদকে বানাতেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। আর ছোট ভাই বরকত ছিল তার বডিগার্ড।

    এক ব্যক্তির কাছ থেকেই নিয়েছেন সোয়া তিন কোটি টাকা

    আব্দুল আহাদ সালমান নামে ফেনীর রাশিদীয়া মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক জানান, চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে আলী হাসান আসকারীর সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় হয় তার। পরিচয়ের পর আসকারী নিজেকে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। সালমান তার ফেসবুকের প্রোফাইলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি দেখে সহজেই বিশ্বাস করে ফেলেন। পরিচয়ের একপর্যায়ে তাদের মধ্যে মোবাইলে কথা হয়। তাদের মাদ্রাসায় স্থায়ীভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা দান করতে চান আসকারী। এসব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই আসকারী তাকে জানান, মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে তার বাবার অংশীদারিত্ব রয়েছে। হাসপাতালে ৭০০ নার্স নিয়োগ করা হবে। তাকে কিছু কর্মী দিতে বলেন। বিনা খরচে এসব লোকজনকে বিদেশে পাঠানো হবে বলে জানান।

    আব্দুল আহাদ সালমান জানান, আসকারীর কথা বিশ্বাস করে তিনি এলাকার যারা সিঙ্গাপুর যেতে চায়—এরকম প্রায় ৪০০ লোক সংগ্রহ করেন। তাদের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে বিষয়টি আসকারীকে জানালে আসকারী তাদের প্রত্যেককে মেডিক্যাল করতে হবে বলে জানান। এজন্য প্রত্যেকের সাড়ে ৮ হাজার টাকা করে খরচ হবে। মেডিক্যালের কথা বলে তাদের দুই দফায় মোহাম্মদপুরের ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন আসকারী। পরে প্রত্যেককে একটি করে নার্সিং সার্টিফিকেট জোগাড় করতে বলেন তিনি।

    আব্দুল আহাদ সালমান জানান, নার্সিং সার্টিফিকেট ম্যানেজ করতে না পেরে তিনি বিষয়টি নিয়ে আসকারীর কাছে সহযোগিতা চান। এ সময় আসকারী বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) একজন কর্মকর্তার নম্বর দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আসলে বিএমডিসির কথিত ওই কর্মকর্তা ছিল আসকারীর প্রতারণার সহযোগী রাজু ওরফে রাশেদ। রাশেদকে ফোন দেওয়ার পর তিনি বিষয়টি গোপনে করে দিতে পারবেন জানিয়ে এজন্য প্রত্যেক সার্টিফিকেটের বিপরীতে ৭৫ হাজার টাকা করে দাবি করেন।

    সালমান জানান, প্রথমে বিষয়টি নিয়ে তার সন্দেহ হলেও পরে রাজি হয়ে যান। বিদেশগামী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ৭৫ হাজার টাকা করে নিয়ে তিনি কয়েক দফায় মোট সোয়া তিন কোটি টাকা আসকারী ও রাশেদের হাতে তুলে দেন। এরপর থেকেই আসকারী টালবাহানা শুরু করেন। পরে বুঝতে পারেন তিনি আসলে প্রতারিত হয়েছেন।

    সালমানের ভাষ্য, পরিচয়ের পর তিনি যখন আসকারীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকায় আসেন, তখন তার সঙ্গে একবার ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে ও পরবর্তীতে ধানমন্ডির জাহাজবাড়ির সামনে দেখা করেন। আসকারী এ সময় তাকে জাহাজবাড়িটি তার বাবার এবং বাবা সেটি সংস্কার কাজ করাচ্ছেন বলে সালমানকে জানান। সালমান বলেন, ‘নবাব পরিবারের বংশধর হিসেবে আমি তার সব কথাই বিশ্বাস করেছি।’

    আসকারীকে গ্রেফতারের খবরে সিটি কার্যালয়ে প্রতারিতরা

    এদিকে আসকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে—এমন খবর পেয়ে একে একে ডজনখানেক লোক হাজির হয়েছিলেন সিটিটিসি কার্যালয়ে। এদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের আল-ইসলামিয়া ইন্টারন্যাশনাল হেফজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মানজুর রহমান জানান, সবুজ নামে পাবনার এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসকারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। পরে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার জন্য তার কাছেও কর্মী চাওয়া হয়। এছাড়া পোলান্ডে ও ইউরোপেও লোক পাঠানোর কথা বলে। নবাব বংশধর হিসেবে এবং আসকারীর মিথ্যা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিচয় বিশ্বাস করে তিনি গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ এলাকার ১০ ব্যক্তির কাছ থেকে ৪৮ লাখ টাকা সংগ্রহ করে আসকারীর হাতে তুলে দেন। একইভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন ইব্রাহীম আলী সাগর নামে সিঙ্গাপুর প্রবাসী এক যুবকও। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা ইব্রাহীম আলী সাগর বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে পিন্টু নামে এক যুবকের মাধ্যমে আসকারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। আসকারী মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের গল্প বলে তাদের সেখানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে। তারা ৭ জন সরল বিশ্বাসে আসকারীর হাতে ১৭ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিলেন।’ টাকা দেওয়ার পর ফোন না ধরায় প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। পরে যোগাযোগ করলে তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন সাগর।

    ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের একজন কর্মকর্তা জানান, আসকারী নিজের সম্পর্কে এমনভাবে প্রচারণা করতো যে সাধারণ মানুষ সহজেই তাকে বিশ্বাস করে ফেলতো। প্রতারণার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের সামনে পিন্টুর মাধ্যমে কয়েকজন যুবকসহ নবাব আসকারীর অনুসারী হিসেবে একটি সংগঠনের ছবি তুলে তা ফেসবুকে প্রচার করেছে। মালয়েশিয়াতেও তার নামে সংগঠন রয়েছে বলে ব্যানার বানিয়ে কয়েকজন যুবকের মাধ্যমে কয়েকটি ছবি তুলে তা প্রচার করেছে। পুলিশ কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেফতার ব্যক্তিদের তিন দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। তারা প্রতারণার অর্থ দিয়ে কী করেছে তা জানার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে তাদের অপর সহযোগীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।’হাজারিকা