তুমি আওনা কেনে ? “পাভেল পার্থ”

    0
    230

    উথালপাথাল হয়ে আছে যখন নিখিল, তখনো নির্ঘুম কৃষক। আলুথালু যখন নাগরিক শংকা, তখনো নির্ঘুম কৃষক। জমিনের উপর যে আজন্ম বিশ্বাস তা কীভাবে চুরমার করে এই করোনার নিদান? যত নিদানই আসুক রক্তজলের শস্য তোলা চাই। শস্য বাঁচাতে না পারলে গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। এ এক আদি বয়ান। কত রোশনাই কত ফিরিস্তি আসে যায়। কিন্তু এ বয়ান যেন শত ঝঞ্জা কী নিদানেও জাগিয়ে রাখে ভাটিবাংলার মেহনতের ফুল। আর তাই করোনারকালে বজ্রঝড়ে অঙ্গার হয়েও ভাটির মজুর ধান বাঁচাতে রয়েছে নির্ঘুম। এ ধান যে বাঁচাতেই হবে। দেশের তিন ভাগের এক ভাগ ভাতের থালা তো সাজাতে হবে। ভাটির কৃষকের এই বিবেক আর শিক্ষা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে দেয়নি। গড়েছে হাওরভাটির এক অনন্ত জীবনের ডাক। এই ডাকে নেশা লাগে হাসনের মনে, রাধারমণ কালা কাজলের পাখি ধরতে জলে নামে, শিতালংয়ের পিঞ্জরা থেকে ওড়ে যায় সুয়া, করিমের নাও ঝিলমিলায়। এই ডাকের মায়া আছে বলেই করোনারকালেও হাওরে নামে কৃষক। কেবল নিজের খোরাকের জন্য নয়, বোরো মওসুমের পঁচিশ ভাগ শস্যদানা দেশের গোলায় তুলবে বলে। কিন্তু নিদারুণভাবে এই করোনাকালেও ধান বেচে চাষের খরচ ওঠছে না কৃষকের।

    নিদানের কালে ধানের মর্ম
    ধানের দাম নিয়ে এই অন্যায় রাজনীতি আজকের নয়, কিন্তু এই নিদানেরকালে জীবনের বিনিময়ে বাঁচানো ধানের দাম নিয়েও কেন কৃষককে ভাবতে হবে? দুনিয়া যেখানে করোনার দুশ্চিন্তায় সেখানে হাওরের কৃষক ধানের দর নিয়ে তড়পায়। অন্য সময় না হয় এর রাজনীতি-দুর্নীতি নিয়ে বাহাস তোলা যায়, কিন্তু এই করোনাকালে কি এই তর্কের সময় আছে? লকডাউনের দুনিয়ায় যে কৃষক যাবতীয় ঝুঁকি নিয়ে আমাদের মুখের গ্রাস জোগালো, সেই জোগানের কোনো মর্ম কী আমরা এই সময়ে বুঝবো না? একবার এই লকডাউনে এই প্রশ্নটা আমাদের নিজেদের কাছে করা জরুরি। রাষ্ট্র, বহুজাতিক বাজার আর নয়াউদারবাদী বাহাদুরি এখানে টানছি না। চালের দাম দুই টাকা বাড়লেই আমাদের শহুরে মুখ ফেনিয়ে ওঠে। অথচ শহরের এক একটি পরিবারে দিনে চালের পেছনে কত টাকাইবা খরচা হয়? যত না খরচ হয় মোবাইল, পরিবহন কী বাহারি খানাদানায়। এই আমাদের মুখে কেন ধানের দাম নিয়ে কোনো কথা নাই? ধানের দাম বাড়লে চালের দামও বাড়বে এই অতি ছোট্ট সমীকরণে? এমন নির্দয় পাষাণ কলিজা নিয়ে আমরা কতদূর যাবো জানি না, তবে করোনাকাল দেখিয়ে দিচ্ছে আমাদের কার কত বাহাদুরি আর মাস্তানি। এক কৃষকই নির্ঘুম থেকে এখনো জোগান দিয়ে চলেছে আমাদের গ্রাস, অন্য কোনো মহাজন নয়।

    এক মণ ধানে কয়টা সাবান ?
    করোনাকালে বারবার হাত ধুতে হচ্ছে। স্যানিটাইজার কি হ্যান্ডওয়াশ বাদ দিলাম, গ্রামের কৃষক যদি বাংলা সাবান দিয়েও হাত ধোয় তাহলে ৬০০ টাকায় এক মণ ধান বেচে কয়টা সাবান হয়? কৃষককে তো ফসল বেচেই সাবান কী মাস্ক কিনতে হবে। আর এই এক মণ ধান ফলাতে কত মেহনত লাগে তার হদিশ কী রাখে এই বাজার? কেবল মেহনত নয়, কৃষি তো এক ঐতিহাসিক চলমান বিজ্ঞান। তাহলে এই বিজ্ঞান আর হেনতের মর্যাদা নাই কেন? বছর বছর কেন কৃষক মেহনতের ফসল বেচতে পারে না। দুধ ঢালে রাস্তায়, টমেটো ছুঁড়ে ফেলে, ধানের স্তুুপে বসে ফোঁপায়। রাষ্ট্র কেন কৃষকের শস্যফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে কঠোর হয় না। গেল বছরগুলোতে এ নিয়ে কত তর্ক হলো। আগ্রাসী ফড়িয়া, দালাল আর মিলমালিকেরা কমদামে জবরদস্তিতে কিনে নেয় কৃষকের ফসল। এই নির্দয় বাণিজ্য চাঙ্গা হয় বোরো মওসুম আর কিছুটা আমনেও। কৃষকের চারধারে তখন আর কিছুই করবার থাকেনা। ধারদেনা করে আবাদ করা ফসল যেকোনো একটা দামে তাকে বেচতে হয়। কৃষকেরও তো এই মূদ্রানির্ভর দুনিয়ায় চলতে নগদ টাকার দরকার। এই কথা এর চেয়ে টাটকা উদাহরণসমেত সবাই জানে। গ্রামের মাতবর, ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃংখলা কর্তৃপক্ষ, বাজার কমিটি, কৃষিবিভাগ, মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্র, গণমাধ্যম কী সংগঠন। তাহলে দেশের সকল কৃষকের সকল ধান মওসুমভিত্তিক একটি নির্দিষ্টদামে বেচাবিক্রি করা কী খুব কঠিন কিছু? বহুবছরের তর্ক এখানে টানছি না, এই নিদারুণ করোনাকালে কৃষকের ধানের দাম নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি। সরকার চলতি বোরো মওসুমে কৃষকের কাছ থেকে ১০৪০ টাকা দরে প্রতি মণ ধান কিনছে। সরকারি দামেই দেশের সব কৃষক বোরো মওসুমের ধান বেচবে এই নিশ্চয়তাটুকু দরকার। এর জন্য হাজারটা কমিটি, তদারকি আর বিশেষজ্ঞের দরকার কী? যারা ধান কিনছেন তারাই তো এটি চালু ও চর্চা করতে পারেন। কেবল মানসিকতাটা বদলাতে হবে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বহমান উপনিবেশিক বাহাদুরিটা এই করোনাকালে না হয় ‘ক্ষেতের চাষার’ কাছে নতজানুই হলো।

    ধানক্রয়ের সীমা বাড়াতে হবে
    আমরা যারা হাওরের মায়ার ডাকে বান্ধা পড়া ভাটির কৃষকের দানা খেয়ে বাঁচি, আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দশাসই সব ডিগ্রী নেই আমরা তলব করিনা এই মজ্জা আর মাটিতে কত নিদানের দাগ। বছর বছর তল হয় জমিন, কেউ দেখে না। বজ্রপাতে অঙ্গার হয়ে যায় জীর্ণ শরীর, কে শোনে চিৎকার? এ বছর বীজের দাম তো আর বছর সারের দোকানে লম্বা লাইন। কিন্তু আমাদের ঘরে ঘরে সাজানো ভাতের থালায় কৃষকের এইসব অমীমাংসিত নিদানের ভাপ কী ওঠে? আমাদের ভাতের থালায় কোনো হরতাল নেই, লকডাউন নেই। আমাদের মগজ যেন নিশ্চিত হয়ে আছে, বাজারে যাবো আর চাল কিনতে পারবো। কিন্তু কতো উৎপাদন হলো, সরকার কতটুকু কিনলো, কতটুকু আমদানি-রপ্তানি হলো, চাষ করতে গিয়ে কৃষকের কি দুর্ভোগ হলো এসব হিসাব কেন আমরা করবো না? এটি জরুরি, কারণ খাদ্যের জন্য আমরা সরাসরি কৃষকের ওপর নির্ভরশীল। তো চলতি বোরো মওসুমে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান, সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিন টন আতপ ও সেদ্ধ চাল এবং ৭৫ হাজার মেট্রিক টন গম কিনবে সরকার। কিন্তু বোরোতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন। সরকার ১০৪০ টাকা মণ দরে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কিনলেও বাদবাকী ধান সরকারি দরে কৃষক বেচতে পারছে না। আর সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে সরকার কিনেও কম, এর আগের বোরো মওসুমে কিনেছিল ৪ লাখ টন ধান ও ১৪ লাখ টন চাল। রাষ্ট্রের ধানক্রয়ের সীমা ও পরিধি বাড়াতে হবে। সরাসরি কৃষকের জমি থেকে ধান কিনে মজুতের সমস্যা থাকলে স্থানীয় বিদ্যালয় বা বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ীভাবে ধান মজুত করতে পারে সরকার। গ্রামের গৃহস্থ বাড়ি বা কৃষকের গোলাঘর ভাড়া নিয়েও মজুত করা সম্ভব।

    কার কুঞ্জে রাষ্ট্রের মন ?
    ভাটির কৃষক যখন এই করোনার নিদানেও সব ধান সরকারি দামে বেচতে পারছে না তখন চারধারে কত কী তড়পায়! এই সজনার হাওর তো এই হাইল, টাঙ্গুয়া থেকে শনি, দেখার হাওর থেকে হাকালুকি, মাটিয়ান থেকে তলার হাওর, বাউরবাগ থেকে ঘুইঙ্গাজুড়ি। একবার কলধূম থেকে ফিরছিলাম উজানধল। শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। রাতের শরীর চুইয়ে ভেসে আসে এক করুণ রাধারমণ। পরে এই গীত চন্দ্রাবতী রায় বর্মণের ধারেও শুনেছি। ‘তুমি আওনা কেনে রস বৃন্দাবনে রে আনন্দস্থানে/শ্যাম তুমি আওনা কেনে? বকুল ফুল কী বাসি হইলো, মধু কি শুকাই গেল রে/তুমি না আসিয়া জানিলা কেমনে? চৌষট্টিকূল বৃন্দাবন কার কুঞ্জে মজাইলায় মন রে/ রাধারে কান্ধাইয়া তুমি সাজিলা পাষাণ রে…।’ করোনার নিদানে এই গীত কেন জানি ভাটির কৃষকের আহাজারি হয়ে ওঠে আমার ধারে। দেশের চৌষট্টি জেলার কৃষককূল শস্যফসলের যে বৃন্দাবন তৈরি করে বারবার, রাষ্ট্র কেন এই আনন্দস্থানে আসে না? কৃষককে কাঁদায়ে রাষ্ট্র কেন পাষাণ হয়ে রয়। বছর বছর ধান কাটার শ্রমিক সংকটে কতজনে কৃষকের জমিনে ক্যামেরা নিয়ে হুমড়ি খায়। সরকারি দামে কৃষকের ধান বেচতে তো কেউ আসে না। না আসলে রাষ্ট্র কীভাবে জানবে কৃষকের কি বাসি হয় আর কি শুকায়ে যায় বারবার!

    লেখক ও গবেষক-পাভেল পার্থ