“তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি”

    1
    566

    আমারসিলেট24ডটকম,২৫মার্চ,লুৎফুর রহমান তেফায়েলপ্রখ্যাত শিল্পী হায়দার হোসেন হয়তো স্বাধীনতার তিরিশ বছর পর উদ্বৃত গানটি গেয়েছিলেন। কিন্তু আজ স্বাধীনতার তেতলিস্নশ বছর পরও কি আমরা আমাদের সেই কাঙ্খিত স্বাধীনতাটাকে খুঁজে ফিরছি না? তেতালিস্নশ বছর নয়, ১৭৫৭ সাল থেকেই আমাদের ছোট্ট ভূখন্ডটি পরাধীনতার শিকল পরা ছিল। এরপর ১৯৪৭ এর পর স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা পরিচিতি পেলেও স্বাধীনতার স্বাদ পাওায়ার সুযোগ হয়নি দীর্ঘ দিন। পশ্চিম পাকিস্ত্মানি শাসক গোষ্ঠীর অপশাসনে পৃষ্ঠ হতে হতে সংগ্রামী হয়ে ওঠে পূর্বপাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাস চূড়ান্ত সংগ্রামের পর স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলদেশ বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পেলেও জাতি হিসেবে এদেশের নাগরিকদের ভাগ্যে স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের কতটুকু সুযোগ হয়েছে? তাই বারবার মনে আসে হায়দার হোসেনের ঔ গানটি; কী দেখার কথা কী দেখছি/ কী শুনার কথা কী শুনছি/ কী ভাবার কথা কী ভাবছি/ কী বলার কথা কী বলছি/ তিরিশ বছর পরেও আমি স্বধীনতাটাকে খুঁজছি।…….

    স্বাধীনতা বলতে আমরা বুঝি নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। স্বাধীন জাতি হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকসহ  সর্বক্ষেত্রে মুক্ত অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকা। ১৯৭১এ দেশ স্বাধীনের পর দেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি মিশতে সময় লাগেনি বেশি দিন। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিদ্ধস্ত্ম শিশু রাষ্ট্রে শুরু হয় লুটপাটের রাজনীতি। তাই দেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আক্ষেপ করে ‘মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’র মত মন্তব্য করতে হয়েছিল। তবুও তিনি সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে নানা পদক্ষেপ নিতে থাকেন। তখনই দেশে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভক্ষ। বিপর্যস্ত এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১৯৭৫ সালে দুর্ভাগ্যবশত জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে জীবন দিতে হয় দুর্বৃত্তদের হাতে। এরপর দেশে আরেক দফায় নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। এভাবে নানা ইতিহাস তৈরী করে বাড়তে থাকে স্বাধীনতার বয়স। তখনই আরেক নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। তিনিও দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে সবুজ বাংলার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন। স্বস্তি ফিরে এলো জাতীয় জীবনে। তবে সে স্বস্তিও বেশী দিন স্থায়ী ছিলনা জাতির ভাগ্যে। তাঁকেও অল্প দিনের মধ্যে প্রাণ দিতে হয় জাতির শত্রুদের হাতে। অঙ্কুর থেকে বেরুতে পারলেও পাতা গজানোর আগেই সবুজ বাংলার স্বপ্ন মিশে যায় সবুজ ঘাসে। তারপর জেনারেল হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ  ক্ষমতা দখল করে ভাগ্যাহত জাতিকে নতুন বাংলার স্বপ্ন দেখাতে চেষ্টা করেন কিছুদিন। কিন্তু গণতন্ত্রকামী জাতি তাঁকেও বেশিদিন রাখতে চায়নি  ক্ষমতায়। এভাবে ক্ষণে ক্ষণে স্বাধীনতার বয়স বাড়তে থাকলেও জাতির কপালে স্বাধীনতারা স্বাদ ভোগ করার ভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৯১ সালে স্বাধীনতার দুই দশক পর গনতন্ত্রকামী জাতি গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মিটি মিটি আশার আলো প্রজ্বলিত হলেও তার বাস্তব রূপায়ন হয়নি শতভাগ। ১৯৯১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি দেশ পরিচালনা করে। তারপর ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামীলীগকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিলে সেখানেও আশানুরুপ ফলাফল পায়ানি সাধারণ মানুষ। ২০০১-২০০৬ সালে আবারো বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। তারপর ২০০৭ সালে জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে তত্ত্বধায়কের মোড়কে অঘোষিত সেনা শাসন। ২০০৮ সালে আবার আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট  ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়। তারা পাঁচ বছর দেশ শাসন করে নানা বিশৃঙ্খলা ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে চলতি বছরের শুরম্নতে আবার  ক্ষমতাসীন হয়।

    এভাবে গনতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে দুই দশকের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তা শুধু ছিল ক্ষমতার পালাবদল ও জোট-মহাজোট গঠনের রাজনীতি। সাধারন জনগন কী পেয়েছে এর মধ্যে? দেখার বিষয় তা-ই। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় রাজনীতিতে অনেক উত্থান-পতন হলেও দেশের স্বাধীন নাগরিকের দীর্ঘ সংগ্রাম আর বিরল আত্মত্যাগের অর্জিত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের কাহিনী তেমন একটা গৌরবময় বা সমৃদ্ধ নয়। কিন্ত্মু কেন? এদেশের মানুষ কেন এতো কষ্ট করে দেশ স্বধীন করেছিল? কোন সে আশায় এই দীর্ঘ সংগ্রাম করেছিল? আশাতো এতোটুকুই ছিল, নিজস্ব স্বকীয়তা-জাতীয়তা নিয়ে সমৃদ্ধ জীবনযাপন। আমরাতো সে লক্ষ্যে পৌঁছা দূরের কথা এখোনো পিছিয়ে আছি অনেক দূর। বিশ্ব দরবারে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি থাকলেও উন্নত, সমৃদ্ধ কিংবা সম্মানজনক জাতির মর্যাদা থেকে অবস্থান করছি যোজন যোজন দূরে। কিন্ত্মু কেন, কী নেই আমাদের? আমাদের আছে বিরাট খনিজ সম্পদ, বনজ সম্পদ, মৎস সম্পদ, সর্বোপরি আমাদের আছে এক বিশাল জনগোষ্টী। আমরা পারিনি এর সঠিক মূল্যায়ন করতে। এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে বোঝাই ভেবেছি সারা জীবন, এদেরকে জনসম্পদে রত্নপাথর করতে পারিনি। এর জন্য প্রয়োজন ছিল সৎ, যোগ্য, দৃঢ়, দেশপ্রেমিক ও দূরদর্শী নেতৃত্বের। আমরা এই নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই স্বাধীনতার চার দশক বছর পরও এর মর্ম উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো আমাদের সীমান্ত অরক্ষিত, যখন তখন ঘটছে অঘটন। দেশের ভেতর বিরাজ করছে অরাজকতা, সন্ত্রাস, হানাহানি, বিশৃঙ্খলা। বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা  রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা। রাজনীতি আছে তবে তা হচ্ছে শুধু  ক্ষমতা লাভের চিন্ত্মায়। রাজনীতির নামে চর্চা হচ্ছে অপরাজনীতি। যেখানে রাজনীতি হওয়ার কথা জনস্বার্থে, দেশের স্বার্থে সেখানে জাতিকে করা হচ্ছে বিভক্ত। পরিতাপের বিষয়, এখোনো পর্যন্ত্ম জাতীয় কোনো ইস্যুতে আমরা একটি বারের জন্যেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি। সামান্য ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থের কাছে জাতীয় স্বার্থের প্রধান্য দেয়ার মানসিকতা এখনো গড়ে ওঠেনি। এখনো বঞ্চিত-অবহেলিত জীবনযাপন করছেন অনেক মুক্তিযুদ্ধা। সাহিত্য সংস্কৃতির বেলায় এখনো নিজস্ব স্বকীয়তার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারিনি, এখনো ভিনদেশী অপসংস্কৃতি আমদানী কিংবা চর্চায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি। আমরা মনে হয় ভুলেই গেছি, আমাদের নিজস্ব একটি জাতিসত্তা আছে, নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি আছে। জাতীয়তাবোধের চর্চা ও শিক্ষা না থাকায় আমরা বারবার ঝুঁকে পড়ছি বিজাতীয় অপসংস্কৃতির দিকে। অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে তরুণ ও যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে তারা ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। সমাজে ছড়াচ্ছে অনাচার। জাতির সম্পদের পরিবর্তে তারা জাতির বোঝায় পরিনত হচ্ছে। চরমভাবে বিগ্নিত হচ্ছে দেশপ্রেমের শিক্ষা। অথচ আমরা সেদিকে খুব কমই ভ্রক্ষেপ করছি। এছাড়া দেশর অভ্যন্তরে জননিরাপত্তার বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। হরহামেশাই চোখে পড়ে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া। বুদ্ধামহলে এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ না থাকলেও প্রশাসনের কাছে এটা কিছুই নয় বলে বুঝা যাচ্ছে। নাকরিকদের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে কোনোটাই যথাযথ পাচ্ছে না সাধারণ জনগণ। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পুরো জাতি। রিকশা চালক থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত্ম এমন কোনো সেক্টর নেই যেখনে দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ততা নেই। দৃর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকেই দুর্নীতি পেয়ে বসে। মানবাধিকার লংঘনের চরম পর্যায় অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কারী বাহিনীর হাতে যেখানে জনগনের জানমালের নিরাত্তার কথা ছিল শতভাগ, সেখানেই সবচেয়ে বেশী লংঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। কোনো সভ্য দেশে যা কল্পনাতীত। মানবাধিকার কমিশন দিয়েও কাজ হচ্ছেনা এতটুকু।

    এভাবে আমাদের দুর্বলতার সুযোগে দেশী এবং বিদেশী নানা চক্রান্ত্ম-ষড়যন্ত্র বিস্ত্মৃত হচ্ছে। ভিনদেশী নানা আগ্রাসনের জবাব দিতেও আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। দেশের ভেতরের নানা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কোনো চেষ্টা না করে সবকিছুকে রাজনৈতিক ভাবে নেয়া এবং মোকবিলার মানসিকতা দেখা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। আর এর ছাপ পড়ে প্রশাসনে। তাই সরকার পরিবর্তন হলেও এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়ে ওঠেনা প্রশাসনের। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জনসেবা কিংবা দেশপ্রেমের মানসিকতা খুবই নগণ্য। এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছে দিনের পর দিন।

    আমাদেরকে এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে। দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। এজন্যে নৈতিকতা সম্পন্ন  শিক্ষার মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারনকে সবদিক থেকে সচেতন হতে হবে। তাহলেই ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তে কেনা স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে ওঠবে।