ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্ত পথশিশুরা,ঝুঁকিতে শ্রীমঙ্গল

    0
    202

    বিক্রমজিত বর্ধন,নিজস্ব প্রতিনিধি: পলিথিনের প্যাকেটে জুতার আঠা (জুতা ঠিক করতে ব্যবহৃত আঠা)। পলিথিন ফুলিয়ে তার মধ্যে গাম ঢেলে একটু ঝাকিঁয়ে, পলিথিনের ভিতর নাক-মুখ ঢুকিয়ে দিয়ে লম্বা দীর্ঘ শ্বাস নেওয়া। এর পর দীর্ঘ সময় অনেক কিছু ভুলে আনন্দে সময় কাটানোর নাম ড্যান্ডি নেশা।

    শ্রীমঙ্গলের আনোয়ার, শাহীন, ফাহিম, সুমন, সাত্তার, নাসিমা, শান্তার মতো প্রায় শিশুরা সকাল থেকে রাত অব্দি শহরের বিভিন্ন জায়গায় দাড়িয়ে বা হেটে এই কাজ করতে দেখা যায়। ভিক্ষাবৃত্তির পাশপাশি এই কাজটা তাদের নিত্য দিনের। যা থেকে এক প্রকার নেশা তৈরি হয়ে যায়। এ নেশা তাদের কাছে ড্যান্ডি নামেই পরিচিত। অল্প পয়সায় এই নেশা করা যায় বলে পথ শিশুরা ঝুঁকে পড়ছে এই নেশায়। এক জনের কাছ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্যজনের কাছে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল শহর ঘুরে এমন তথ্যই মিললো।

    খোঁজ নিয়ে জানা গেল, শহরতলীর বিভিন্ন বস্তি ও কলোনির নিম্ম আয়ের পরিবারের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা পরিবারের আর্থিক অবস্তা খারাপ থাকার দরুন শহরের বিভিন্ন শপিংমলসহ বিভিন্ন জায়গায় ভিক্ষা করে

    উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জয়নাল আবেদীন টিটু বলেন, ড্যান্ডি নেশায় যেসব সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তাতে করে শ্বাসনালীতে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরী হয়। এর ফলে নেশাগ্রহনকারী স্থায়ী শ্বাস কষ্টে ভোগে, ব্রেন (মস্তিস্ক) ডেমেজ করে ফেলে। নেশাগ্রহনকারীর খাবারের রুচি কমে যায়, ক্ষুদা অনুভূতি হয় না, ফলে খাবার না খাওয়ার কারনে পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং শ্বাসনালীতে ইনফেকশন হয়ে ঘন ঘন রোগাক্রান্ত হয়। নেশাগ্রস্ত থাকার কারনে অসুস্থ হয়েও চিকিৎসকের স্বরনাপন্ন হতে চায় না। এসব নেশাগ্রহন কারীকে শাস্তি দিয়ে এই নেশা থেকে দুরে সরানো যাবে না। তাদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে তাদের নেশার জগৎ থেকে সরিয়ে আনতে হবে।

    ঢাকার পথ শিশুদের পাশাপাশি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে পথ শিশুরা। যে বয়সে তারা নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার কথা থাকলেও পড়ালেখার পরিবর্তে তারা সারাদিন ঘুরে বেড়ায় শহরের ওলি গলিতে ড্যান্ডি নেশার টাকা জোগাড় করতে।

    সন্ধ্যা নামার পরেই শ্রীমঙ্গল শহরে তারা বসে পড়ে ড্যান্ডি নেশা করতে। এমনি কিছু পথ শিশুর দেখা মিললো শ্রীমঙ্গল ষ্টেশন রোডে। এদের নাম, ফাহিম, শাহীন, সুমন, নাসিমা, শান্তা । ওই শিশুদের কাছে কৌশলে জানা গেল ড্যান্ডির, কম দামে জুতায় লাগানো গাম কিনে পলিথিনের ব্যাগে ঢ়ুকিয়ে শ্বাস নেওয়া হয়, যা থেকে এক প্রকার নেশা তৈরি হয়ে যায়। এ নেশা তাদের কাছে ড্যান্ডি নামে পরিচিত।

    অল্প পয়সায় এই নেশা করা যায় বলে এতে ঝুঁকে পড়ছে এক শ্রেণীর পথশিশুরা।এক জনের কাছ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে অন্যজনের কাছে। এমনই তথ্য পাওয়া গেল নেশাগ্রস্ত শিশুদের সঙ্গে কথা বলে।

    তাদের বয়স আনুমানিক ৮ থেকে ১২ বছরের পথ শিশুরা,। মরণ নেশা ড্যান্ডি নেশাতে তাদের সাথে রয়েছে আরো ১৫-২০ জনে একটি সংবদ্ধ চক্র এরা সবাই পথ শিশু।

    সারাদিন এই শিশুরা শহরের গুরুত্বপূর্ন স্থানের সামনে অবস্থান নিয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। ভিক্ষা করে যে টাকা পায় তা খরচ করে ড্যান্ডি নেশাতে।

    পথ শিশু নাসিমা, শান্তার তাদের আনুমানিক বয়স হবে ১২ থেকে ১৫ বছর । এদের সাথে রয়েছে আরোও ৩ থেকে ৪ জন পথ শিশু মেয়ে এরা ড্যান্ডি নেশার টাকা জোগাড় করতে সন্ধ্যার পরে নেমে পড়ে দেহ ব্যবসাতে । এতে করে তারা হারাচ্ছে তাদের আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পথশিশু জানায় শান্তাদের এ কাজে ব্যবহার করে ষ্টেশন এলাকার ট্রাক ষ্ট্যান্ডের ট্রাক চালক , আরোও অনেকে ।

    অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩০ থেকে ৪০ টাকায় এক ধরনের জুতার আঠা, সাইকেলের সলিভিশন (টায়ারের গাম) কিনে শিশুরা পলিথিনের ব্যাগে আঠাল ওই পদার্থ ঢেলে কিছুক্ষণ ঝাঁকানো দিতে হয়। তারপর পলিথিন এর ভিতর নাক, মুখ ঢুকিয়ে জোরে শ্বাস নিলে তা থেকে সৃষ্টি হয় এক ধরনের নেশা আর এই নেশা ড্যান্ডি নামে পরিচিত।

    কথা হয় সুমন নামে এক পথ শিশুর সাথে। সুমন জানায়, আগে সে প্রতিদিনই এই ড্যান্ডি নেশা করতো তবে এখন আর সে এই নেশায় আসক্ত নয়। তবে তার সাথে থাকা ১০-১৫ জন প্রায় প্রতিদিনই এই নেশা করছে। সুমন জানায় শ্রীমঙ্গলের রাধানাথ সিনেমা হলের পাশে,সাগর দীঘির পাড় মাছের আড়ৎ এর পাশে এবং স্টেশনে বসে সেবন করা হয় এই নেশা । তীব্র গন্ধ না থাকায় কেউ নেশা করার সময় তাদের ধরতে পারে না।

    নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ড্যান্ডি সেবন কারীকে খরচ কেমন জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, স্যার ‘এ নেশার খরচ কম, ড্যান্ডির নেশা বড়ই মারাত্বক, সময় মত না পাইলে মাথা ঠিক থাকে না ।

    এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় সাবেক স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: হরিপদ রায় জানান, জুতার আঠার উগ্র ক্যামিক্যালের নির্যাসে তারা নেশায় আসক্ত হয়। দীর্ঘদিন এটি ব্যবহারের ফলে ঠোঁঠে, জিহ্বায়, গলায় ও খাদ্য নালিতে ক্যান্সার আক্রান্ত হতে পারে। পথ শিশুরাও স্বপ্ন দেখে দেশ গড়ার । এই পথ শিশুরা সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের সমাজের সকল বিত্তবানেরা যদি পথ শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে আসে তাহলে পথ শিশুদের আগামী দিনগুলো সুন্দর হতো। এমনকি তারাও হতে পারে আগামী দিনের ভবিষ্য কর্ণধার।

    এদিকে এই ড্যান্ডির প্রধান উপকরণ জুতার আঠা পথ শিশুদের কাছে বেশি মুনাফার আশায় বিক্রয় করছে এক ধরনের ব্যবসায়ীরা। এইসব বিপথগামী পথ শিশুদের তো ব্যবসায়ীরা চেনেন। ব্যবসায়ীরা জেনে বুঝেই শিশুদের কাছে এসব উপকরণ তুলে দিচ্ছেন সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য।

    বিপথগামী এসব পথ শিশুরা সাময়িক সুখের প্রত্যাশায় হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের চোরাবালিতে। তাদের জীবন হয়ে পড়ছে জরাজীর্ণ। এই পথ শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ মূলক কর্মকান্ডে। এসব বিপথগামী শিশুদের ফিরিয়ে আনতে এখন প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। আর এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা জরুরী বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন নতুবা ড্যান্ডি নেশায় আক্রান্ত পথশিশুদের কারনে ঝুঁকির মুখে পরবে ভ্রমন পিপাসুদের শহর শ্রীমঙ্গল ।