জৈন্তাপুর মেগালিথ স্মৃতিসৌধ গুলো স্থায়ী রক্ষার উদ্যোগ নেই

    0
    309

    রেজওয়ান করিম সাব্বির,জৈন্তাপুর (সিলেট) প্রতিনিধি: জৈন্তাপুর মেগালিথ (প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রকান্ড প্রস্তর নিদর্শন) যুগের ধ্বংসাবশেষের জন্য খ্যাত। সিলেট বিভাগীয় শহর থেকে ৪০ কি.মি. উত্তরে ও জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে এটি অবস্থিত। অঞ্চলটির উত্তর ও পূর্ব দিকে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়, সূতপ ও উপত্যকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণাংশে রয়েছে নিচু সমতল ভূমি ও অসংখ্য জলাশয়, যা আঞ্চলিক ভাবে হাওড় হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন যুগে বর্তমানের এ নিচু অঞ্চলটি সম্ভবত পানির নিচে ছিল এবং হয়তবা কোনো একটি জলাশয় দ্বারা সে সময় জৈন্তাপুর সিলেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। অঞ্চলটির ভূতাত্ত্বিক গঠনের জন্যই এটি দীর্ঘ দিন স্বাধীন ছিল এবং জৈন্তাপুর রাজ্য হিসেবে সুপরিচিত ছিল।

    এভাবেই এ অঞ্চলটি মহাকাব্য, পৌরাণিক কাহিনী ও তান্ত্রিক সাহিত্যে উল্লেখিত রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতি, লোক গাঁথা ও তা¤্র শাসনে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, আনুমানিক সাত-আট শতকে জৈন্তাপুর কামরূপ রাজ্যের অধীনে আসে এবং পরবর্তী কালে এটি চন্দ্র ও বর্মণ শাসকদের শাসনাধীন হয়। বর্মণদের পতনের পর জৈন্তাপুর পুনরায় কিছু সময়ের জন্য দেব বংশের শাসনাধীন ছিল। দেব বংশের শেষ শাসক জয়ন্ত রায়ের এক কন্যার নাম ছিল জয়ন্তী। তাঁর এ কন্যার সাথে খাসি উপজাতীয় প্রধানের এক পুত্র লান্দোয়ারের বিয়ে হয়। এ বৈবাহিক সূত্র ধরে জৈন্তাপুর রাজ্য আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে খাসিয়াদের শাসনাধীনে চলে যায়। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক দখল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জৈন্তাপুর রাজ্য স্বাধীন ভাবে খাসি রাজাদের দ্বারা শাসিত হতে ছিল।


    জৈন্তাপুরের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বিধ্বস্ত রাজবাড়ী, জৈন্তেশ্বরী মন্দির এবং প্রস্তর নির্মিত স্মৃতিসৌধ সমূহ উল্লেখযোগ্য। ১৬০২শক / ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে জৈন্তা রাজা লক্ষ্মী সিংহ (১৬৭০-১৭০১খ্রি.) কর্তৃক নির্মিত প্রাসাদটি বর্তমানে সম্পূর্ণ ধ্বংস প্রাপ্ত। জৈন্তেশ্বরী মন্দিরটির প্রধান অবকাঠামোটিও অত্যন্ত করুণ ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। মন্দির কমপ্লেক্সটির বেষ্টনী দেওয়ালটি অপেক্ষাকৃত ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত হলেও বর্তমানে এটি প্লাস্টার রিলিফ সহযোগে অলংকৃত হওয়ায় এর আদিরূপ হারিয়েছে। নকশার মধ্যে ঘোড়া, সিংহ এবং পাখাওয়ালা অর্ধ-পরীর মতো বিভিন্ন বস্তু অঙ্কিত। এছাড়াাও সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত কিছু প্রস্তরনির্মিত স্মৃতিসৌধ উল্লেখের দাবিদার। সাধারণত বড় ও ছোট পাথর খন্ড দ্বারা সমাধিস্থল বা স্মৃতিসৌধ নির্মিত। সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে এ ধরনের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।

     ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলি প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। অতীত সংস্কৃতি পুনর্গঠনে এগুলির গঠন ও স্থানভেদে বিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত মেগালিথ ধ্বংসাবশেষ একমাত্র জৈন্তাপুরেই রয়েছে। জৈন্তাপুরে প্রাপ্ত কাঠামো সমূহের বৈশিষ্ট্য মোটামুটি ভাবে ভারতের অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত নিদর্শন গুলির প্রায় কাছাকাছি। প্রধানত দু’ধরনের মেগালিথ মেনহির (গবহযরৎ) ও ডলমেন (উড়ষসবহ) জৈন্তাপুরে বিদ্যমান। মেনহির গুলি সাধারণত উঁচু উলম্ব পাথর খন্ড এবং এগুলি কোনো সুনির্দিষ্ট আকার ও গঠনের হয় না। পাথরের স্ল্যাব গুলি অনুভূমিক ভাবে ডলমেন নামক দুই অথবা অধিক পাথরের পায়য়ার উপর স্থাপিত। জৈন্তাপুরে সব মিলিয়ে ২৫টি মেনহির ও ৩২টি ডলমেন পাওয়াা গেছে। ৩২টি ডলমেনের মধ্যে ১১টি এখনও অক্ষত। মেগালিথ গুলিকে এলাকা ভিত্তিক বিন্যাসে নিম্ন লিখিত শ্রেণিতে বিভক্ত করা। সিলেট-তামাবিল মহাসড়কের ওপর জৈন্তাপুর বাস স্টেশন সংলগ্ন জৈন্তেশ্বরী বাড়ীর সামনে অবস্থিত। মেনহির ও ডলমেন গুলো তিনটি শ্রেণীতে শনাক্ত করা হয়।


    (১) মন্দির নিকটবর্তী স্থাপিত মেগালিথ গুলির মাঝে ৯টি মেনহির এবং ১০টি ডলমেন। মেনহির গুলির গড় উচ্চতা ২.৪ মি.। সর্ববৃহৎ ডলমেনটি ৩.৫ মি দীর্ঘ এবং ২.৬২ মি প্রস্থ। (২) এ রীতির মেগালিথ গুলি জৈন্তেশ্বরী মন্দিরের পাশে শহীদ মিনারের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত। এখানে ৮টি মেনহিরের গড় উচ্চতা ২.৬৭ মি.। বর্তমানে ডলমেনের সংখ্যা নির্ধারণ করা অসম্ভব, কেন না এগুলি অসংখ্য খন্ড খন্ড টুকরোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। (৩) তৃতীয় শ্রেণির নিদর্শন গুলি মন্দিরমুখী মহাসড়কের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত। এর মধ্যে ৩টি মেনহির ও ২টি ডলমেন বিদ্যমান। সর্ববৃহৎ মেনহিরটি ১.৬০মি.উঁচু। ৪মি.☓৩.৮মি. পরিমাপের একটি ডলমেন মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। অন্যটি জৈন্তাপুরের মেগালিথের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এটি ৬.৫ মি. দীর্ঘ ☓৫.২মি. প্রস্থ এবং ৯টি পায়ের উপর অনুভূমিক ভাবে শায়িত আছে।


    চাঙ্গীল বা মুক্তাপুর শ্রেণি এ শ্রেণির মেগালিথ গুলি মন্দিরের আনুমানিক ১.৫কিমি. উত্তর-পশ্চিমে নয়াগাং নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত। যদিও ১৯৪৮ সালে এ শ্রেণীর ৪টি মেনহির ও ১৯৬০ সালে ৭টি ডলমেন ছিল, বর্তমানে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ীয়েছে যথাক্রমে ৩ ও ৪টিতে। অক্ষত দুটি মেনহিরের উচ্চতা ৪.৫৮মি.☓৪.৫৫মি. এবং তাদের মধ্যে একটির উপরের অংশে একটি ত্রিশূল খোদিত রয়েছে। ডলমেন গুলি বহুধা বিখন্ডিত এবং সে কারণে পরিমাপের অযোগ্য। এগুলি ৪/৫টি পায়ের উপর অনুভূমিক ভাবে শায়িত আছে।


    খাসি গ্রাম বা মধুবন আবাসিক এলাকা শ্রেণী এ শ্রেণীর কাঠামো গুলি মন্দির থেকে ১ কিমি. দক্ষিণ-পূর্বে খাসি গ্রামে অবস্থিত। এখানে ২টি মেনহির ও ২টি ডলমেন আছে। পূর্বের মেনহিরটি ভেঙ্গে পড়েছে, যার উচ্চতা ২.৪০ মিটার। পশ্চিম দিকের মেনহিরটি ৩.৫০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট। উভয় মেনহিরই নিচের দিকে পদ্ম এবং উপরের দিকে যথাক্রমে চক্র ও ত্রিশূল চিহ্ন সম্বলিত। পূর্বদিকের ডলমেনটি প্রায়-আয়তাকার (১.৬৫মি.☓১.১মি.) এবং পশ্চিম দিকেরটি প্রায়-বর্গাকার (১.৬০মি.☓১.৫৫মি.)। প্রত্যেকটি ৪টি উলম্ব পায়েরর উপর শায়িত আছে। তাদের উপরের দিকে এবং অর্ধবৃত্তাকার কিনারায় খোদাইকৃত লাইন ড্রইং রয়েছে।


    জৈন্তাপুরে মেনহির ও ডলমেন গুলির স্থাপন প্রক্রিয়ায় একে অপরের সাথে নৈকট্য বজায় রাখলেও তাদের স্থাপনায় কোনো নিয়মরীতি বজায় রাখা হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি রীতিতে মেনহির গুলি ডলমেনের উত্তর প্রান্তে, অন্য গুলি কোনোটি দক্ষিণ বা পূর্ব প্রান্তে স্থাপিত। মেনহির গুলি সাধারণত উপরের দিকে ক্রমশ হ্রাসমান চতুর্ভুজাকৃতির বেলে পাথরের স্তম্ব¢। যদিও কোনো কোনোটিতে চতুর্ভুজাকার আচ্ছাদন রয়েছে। মেনহির গুলির মধ্যে সর্বোচ্চটি ৪.৫৮মি (চাঙ্গিল শ্রেণী) উচ্চতা বিশিষ্ট এবং সবচেয়ে খাটো মেনহিরটি ০.৫০ মি উঁচু (জৈন্তেশ্বরী মন্দির শ্রেণী) এবং তাদের প্রশস্ততা ০.৪০মি. থেকে ০.৩০ মিটারের মধ্যে। সর্বাপেক্ষা ছোট ডলমেনটির পরিমাপ (১.৬৫মি.☓১.১০মি.)। অক্ষত ১১টি ডলমেনের আকৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়।

    তাদের মধ্যে ৮টি প্রায়-আয়তাকার, দুটি প্রায়-বর্গাকার এবং একটি গোলাকার। যদিও সব গুলিই অনুভূমিক ভাবে ক্ষুদ্র স্তম্ব বা পায়ের উপর শায়িত, আর পায়ের সংখ্যাও ৩,৪,৫ বা ৯টি। তবে চার পায়ের ডলমেন সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। জৈন্তেশ্বরী মন্দির ধারার ডলমেন ব্যতীত সবগুলি ডলমেনের পায়া অমসৃণ এবং ভিন্ন ভিন্ন আকারের। জৈন্তেশ্বরী মন্দিরের ডলমেনের মসৃণ পাগুলি গোলাকার এবং বন্ধনী অলঙ্করণ সমৃদ্ধ। স্থানীয় জনগণের নিকট থেকে জানা যায় ডলমেনের স্ল্যাাবের উপরিতল ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের খেলাধুলা থেকে লাইন-ডায়াগ্রাম সমূহ খোদিত হয়েছে। যদি তাদের এরূপ ডায়াগ্রাম পূর্ব থেকেই থাকত, তাহলে পরবর্তী যুগে পুনরায় এর ব্যবহার দেখা যেত।


    জৈন্তাপুর মেগালিথের সঠিক তারিখ নিরূপণ করা সম্ভবপর নয়, এর কারণ এখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খননকার্য পরিচালনা করা হয়নি, যার মাধ্যমে তারিখ জানা যায়। প্রত্ন তত্ত্ব বিদগণ প্রমাণ করেছেন যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মেগালিথ সংস্কৃতির সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মেগালিথ সংস্কৃতির নিবিড় সান্নিধ্য রয়েছে। আর এটি সম্ভব পর হয়েছে অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতি সমূহের অভিবাসনের কারণে। এ অভিবাসন প্রক্রিয়া ইঙ্গিত দেয় যে, খাসিরা নবোপলীয় যুগের শেষের দিকে এ অঞ্চল  টিতে আসে। খাসিয়া পাহাড়ের মার্কোদোল প্রত্ন স্থল থেকে একমাত্র কার্বন-১৪ (ঈ-১৪) পরীক্ষায় যে সময় পাওয়া যায় তা হচ্ছে ১২৯৬ ক্ট ১০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের এবং একে নবোপলীয়োত্তর যুগের বলে ধরা যায়। জৈন্তাপুরের মেগালিথের চর্চা শুরু হয়েছে সম্ভবত এর সমসাময়িক যুগে অথবা সামান্য কিছু পরে।


    মেগালিথিক ব্যাপারে জানাতে চাইলে সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল হাদী জানান- মেগালিথিক বাংলাদেশের এক অনুপম সাংস্কৃতিক নিদর্শন। পৃথিবীর যে কয়েকটি স্থান মেগালিথিকের জন্য বিখ্যাত, তার মধ্যে নিজপাট অন্যতম। এগুলোর সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা সত্যিই জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করে। তাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, পর্যটন কর্পোরেশনসহ সবাইকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় মানুষদের মধ্যেও এগুলোর ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।