ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টাকারী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

    0
    268

    “পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার পর একজন পরীক্ষার্থী নুসরাতকে বলে, তার এক বান্ধবীকে ছাদে নিয়ে মারধর করা হচ্ছে। এটা শুনে সে দ্রুত ছাদে যায়। এরপরই এই ঘটনা ঘটে।ওই সময় চার দুর্বৃত্ত বোরকা পরা এসে নুসরাত জাহানের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে চারজনের কাউকেই চিনতে পারেনি নুসরাত”

     

    সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হন ছাত্রীর গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনায় আলোচিত শিক্ষক সিরাজ উদদৌলা। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ওই মাদ্রাসার বিপুল পরিমাণ অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। জড়ান বহু ছাত্রীকে যৌন হয়রানির কেলেঙ্কারিতেও। চেক জালিয়াতি, প্রতারণা ও নাশকতার অভিযোগে ৪টি মামলা হলেও স্বপদে বহাল ছিলেন সাবেক এই জামায়াত নেতা।তবে এ ঘটনার পর নুসরাতকে হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের গ্রেফতারের নির্দেশ  দিলেন প্রধানমন্ত্রী।

    গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় মাদ্রাসাটির ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ৮০ ভাগ অগ্নিদগ্ধ হওয়া রাফি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

    এ ঘটনার ৬ মাস আগে ওই অধ্যক্ষ’র বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন মাদ্রাসার আরেক ছাত্রী।

    নুসরাত জাহান রাফীর সহপাঠি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নাসরিন সুলতানা ফুর্তি সাংবাদিকদের বলেন, ‘অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলা ছিলেন, একজন লম্পট প্রকৃতির লোক। রাফির গায়ে হাত দেওয়ার ঘটনায় আমি নিজেও অধ্যক্ষের কাছে প্রতিবাদ করেছি।’

    জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি জানায়, রাফির আরেক সহপাঠী নিশাত। তাকে মারা হচ্ছে বলেই রাফিকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে এনেছিলো দুর্বৃত্তরা।

    স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর বলেন, ‘অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজদ্দৌলা মাদ্রাসার এক ছাত্রীকে অন্তসত্তা করে ফেলেন। পরে তিনি স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার হাত-পা ধরে বেঁচে যান। ২০১৬ সালে একবার চেক জালিয়াতি মামলায় জেল খেটেছেন, এরপরও উক্ত মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে বহাল ছিলেন।’

    তার বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতি, প্রতারণা, নাশকতা ও যৌনহয়রানিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ফেনী ও সোনাগাজী থানায় চারটি মামলা রয়েছে। চেক জালিয়াতির মামলায় ২০১৭ সালেও জেল খেটেছিলেন তিনি।

    ফেনী জেলা জামায়াতের আমির এ কে এম শামসুদ্দিন জানান, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা একসময় জামায়াতের রোকন ছিলেন। বিভিন্ন অভিযোগে ২০১৬ সালে তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।

    নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাগাজী থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাফীর গায়ে অগ্নিদদ্ধের ঘটনায় প্রভাবশালী একটি মহল ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, মাদ্রাসার একটি মাত্র প্রবেশ পথ। গেইটের দারোয়ান ছিল, পুলিশ ছিল, পরীক্ষা কেন্দ্রে বহিরাগত কোন লোকই ছিল না। নুসরাত জাহানের গায়ে কে বা কাহারা আগুন লাগিয়েছে, তার চাইতে বড় কথা হলো, অগ্নি সংযোগকারী সেই দূর্বৃত্তরা পুলিশ, দারোয়ান কে এড়িয়ে কিভাবে প্রবেশ পথ দিয়ে বের হয়ে গেলো, তা অবাক হওয়ার বিষয়।

    রবিবার চট্টগ্রাম রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ অপারেশন এন্ড ক্রাইম, ফেনীর পুলিশ সুপার এবং উক্ত মাদ্রাসার গর্ভনিং বডির সভাপতি, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট পি.কে এনামুল করিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে এডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ আবুল ফয়েজ সোনাগাজী থানায় বেলা ১১ টা থেকে নুসরাত জাহান রাফীর সহপাঠী আলীম পরীক্ষার্থীদেরকে তার কক্ষে এক এক করে ডেকে রাফীর অগ্নিদগ্ধ’র ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান এবং প্রত্যেকের বক্তব্য রেকর্ড করেন।

    তিনি বেলা ৪ টার দিকে নুসরাত জাহান রাফীর সহপাঠী নিশাতের বক্তব্য নেন। পরে তার আরেক সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ফুর্তিরও বক্তব্য রেকর্ড করেন। বেলা ৫ টার দিকে এডিশনাল ডিআইজি সাংবাদিকদের এক ব্রিফিং এ বলেন, তিনি ছাত্রী ও শিক্ষকদের বক্তব্যের পর বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত পেয়েছেন এবং কিছু ঘটনা আঁচ করতে পেরেছেন, যা তদন্তের স্বার্থে তিনি প্রকাশ করতে রাজী নন। তদন্ত শেষে এ নারকীয় ঘটনায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

    ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষ থেকে থানায় এখনও কোন মামলা হয়নি, তবে যদি ক্ষতিগ্রস্থদের পক্ষ থেকে কোন মামলা করতে রাজী না হলে, পরবর্তীতে পুলিশ তা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

    এদিকে সোনাগাজীর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সার্কেল সাইকুল আহমেদ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার সবকিছু সময় মতো বের হয়ে আসবে, তবে একটু ধৈয্যের ব্যাপার।

    অপরদিকে রবিবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন  সাংবাদিকদেরকে বলেন, দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করতে যান তিনি। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতের বিষয়ে খোঁজ নেন। তার চিকিৎসাসহ সার্বিক বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। একই সঙ্গে এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

    এদিকে নুসরাত জাহানের চিকিৎসায় নয় সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। বোর্ডে রয়েছেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক আবুল কালাম, অধ্যাপক রাইহানা আউয়াল, অধ্যাপক লুৎফর কাদের, অধ্যাপক মহিউদ্দিন, অধ্যাপক বিধান সরকার, অধ্যাপক নওয়াজেশ খান, চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম ও জহিরুল ইসলাম।

    ডা. সামন্ত লাল সেন আরও বলেন, নুসরাতের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তার শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।

    ঘটনার বিবরণ থেকে জানা যায়,ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।

    নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়ার পর একজন পরীক্ষার্থী নুসরাতকে বলে, তার এক বান্ধবীকে ছাদে নিয়ে মারধর করা হচ্ছে। এটা শুনে সে দ্রুত ছাদে যায়। এরপরই এই ঘটনা ঘটে।ওই সময় চার দুর্বৃত্ত বোরকা পরা এসে নুসরাত জাহানের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে চারজনের কাউকেই চিনতে পারেনি নুসরাত। শনিবার রাতে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান এমন তথ্যই দেন।

    প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নুসরাত জাহান আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় যায়। পরে সে প্রকৃতির ডাকে বাথরুমে যায়। সেখানে থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার অনুগত কয়েক দুর্বৃত্ত তাকে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তার আত্মচিৎকারে শিক্ষকরা এসে তাকে উদ্ধার করে।

    সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ইতিপূর্বে ওই ছাত্রীর মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় অভিযোগ করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা সবসময় তার মেয়ে নুসরাত জাহানকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করতেন। এ অভিযোগে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়।