ছাত্রদের শাস্তি বন্ধে সরকারের পদক্ষেপে কমছে ঝড়ে পড়ার হার

    0
    203

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৯আগস্ট,ইসমাইল মাহমুদঃ  আমার মরহুম পিতার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা পাঠকদের সাথে শেয়ার করার মধ্য দিয়ে এ নিবন্ধ শুরু করছি-আমার দাদু ছিলেন গ্রামের প্রধান মুরব্বী ও জনে-বলে প্রভাবশালী। আমার পিতা আমার দাদীমার গর্ভে জন্ম নেয়া একমাত্র পুত্র সন্তান। তাই পরিবারে আদরের কমতি ছিল না। সবার চোখের মনি ছিলেন আমার পিতা। আমার দাদীমা আমার ছোটবেলা আমার সাথে গল্পচ্ছলে একদিন বললেন ‘তোমার বাবা আমার এতোই আদরের ছিলো যে ‘মাথায় তুলে রাখতাম না উকুনে খাবে, মাটিতে রাখতাম না পিপড়ায় খাবে। তাই তাকে বুকে আগলে রাখতাম’। তাই ছোটবেলা থেকেই আমার পিতা ছিলেন একরোখা ও জেদি স্বভাবের। দুষ্টামীতে তাঁর ছিল জুড়ি মেলা ভার।

    আমার পিতার বয়স যখন সাড়ে পাঁচ বছর তখন আমার দাদু তাঁকে পাশের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দেন। আমার দাদুও ছিলেন তার পিতা-মাতার ঘরে একমাত্র সন্তান। তিনি খুব একটা লেখাপড়া করেননি। ফলে অনেক আশা করে আমার পিতাকে স্কুলে পাঠান। দুষ্টামীতে বাধনহারা আমার পিতা ধীরে ধীরে দুটি বছর কাটিয়ে দেন। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। একদিন স্কুল চলাকালীন সময়ে তিনি সহপাঠীর সাথে শ্রেণিকক্ষে দুষ্টামী করছিলেন।

    এ সময় ওই সময়ের পুরো মহকুমায় জাদরেল শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আসেন। ওই শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে আসলে নাকি পিনপতন নিরব থাকতো শ্রেণিকক্ষ। কেউ কারো সাথে কথা বলা তো দুরের কথা নিশ্বাস ফেলাও অনেকটা বন্ধ হয়ে যেতো, যদি নিশ্বাসের শব্দ হয়।

    এদিকে ওই জাদরেল শিক্ষক ছিলেন আমার দাদুর সাথে গ্রামের মুরব্বীয়ানা নিয়ে যাদের শত্রুতা সেই পরিবারের। তো সেদিনের দুষ্টামীতে ওই শিক্ষক এমন ক্ষেপে গেলেন যে আমার পিতাকে তাঁরই স্লেট দিয়ে মাথায় আঘাত করে বসেন। আমার পিতার মাথা ফেটে রক্ত ঝড়তে লাগলো। খবর পেয়ে আমার দাদু ছুটে আসেন স্কুলে এবং ঘোড়ায় করে নিয়ে যান শহরের হাসপাতালে।

    এ ঘটনার পর ৭ গ্রামবাসীকে নিয়ে বসে শালিস বৈঠক। আমার দাদু বৈঠকের পর জেদ ধরলেন যে স্কুলে তাঁর একমাত্র ছেলের রক্ত ঝড়েছে সেখানে আর ছেলেকে পাঠাবেন না। প্রয়োজনে ছেলেকে লেখাপড়াই শেখাবেন না। যেমন কথা তেমন কাজ। আমার পিতার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। একটু বোঝার বয়স যখন আমার পিতার হয়েছিল তখন তিনি আফসোস করতেন যদি ওই শিক্ষক এভাবে তাঁকে আঘাত করে রক্ত না ঝড়িয়ে দুষ্টামী না করার জন্য মানবিকভাবে বুঝাতেন বা আদর-স্নেহে পড়ানোর চেষ্টা করতেন তবে তাঁর শিক্ষা জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো না।
    এরপর যখন আমার জন্ম হলো, আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম তখন থেকেই আমার পিতা তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমাকে বর্ণনা করে আমাকে নৈতিক শিক্ষা দিতে লাগলেন। কি করলে সমাজের চোখে আমি আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠতে পারি সে শিক্ষার প্রথম পাঠের শিক্ষক আমার স্বল্প শিক্ষিত পিতা। আমাকে যখন স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন তখন আমার পিতাও শহরের প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তবে দাদুর মতো জনে-বলে নয় সম্মানের আসনে তাঁর খ্যাতি তখন আকাশচুম্বি (পরবর্তীতে তিনি শ্রীমঙ্গল পৌরসভার কমিশনার, প্যানেল চেয়ারম্যান, প্রাইমারী স্কুল কমিটির সভাপতি, হাইস্কুল কমিটির শিক্ষানুরাগী সদস্য, রেলওয়ে ও জালালিয়া মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ নানা সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন)।

    আমাকে স্কুলে নিয়ে প্রথম দিনেই আমার পিতা প্রধান শিক্ষককে বলে আসেন ‘ছেলেকে স্কুলে দিয়ে গেলাম, নৈতিকতার বিপর্যয় ঘটলে, দুষ্টামী করলে পিটিয়ে মাংশ তুলে ফেললেও আমার দুঃখ নেই’। দ্বিতীয় দিনের শ্রেণিকক্ষেই প্রধান শিক্ষক মহোদয় আমাকে বললেন, ‘তোমার বাবা যেভাবে সমাজের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেছেন তেমনি তোমাকেও তাঁর নাম, খ্যাতি, যশ রক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে।’ আমার সেই প্রধান শিক্ষকের কথা এখনো আমি মনে প্রাণে ধারণ করে আছি।
    এবার আসি মূল বক্তব্যে। প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকের বেত্রাঘাতে অনেকের শিক্ষা জীবন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে-এমন উদাহরণ আছে ভুড়ি ভুড়ি। বিদ্যালয়গুলোতে ঝড়ে পড়ার হার ক্রমশ বাড়ছিল। একটা সময় এমন অবস্থা তৈরি হয় যে, পিতা-মাতা সন্তানকে স্কুলে পাঠালে সে সন্তান স্কুলে না গিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বিকেলে বাড়ি ফিরে যেতো। শুধুমাত্র শিক্ষকের বেত্রাঘাত ও মানসিক শাস্তির ভয়ে বিদ্যালয়গুলোতে ঝড়ে পড়ার হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে লাগলো। ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকের বেত্রাঘাত না খেয়ে শিক্ষা জীবনের সব শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে এমন শিক্ষার্থী আতশকাঁচ লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
    ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি হাইকোর্ট প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়ার নামে নির্যাতনকে সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধে নীতিমালা চূড়ান্ত করে তার আলোকে ব্যবস্থা নিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়।

    এ নির্দেশনার আলোকে ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ১১ ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে সরকার। নিষিদ্ধ শারীরিক শাস্তিগুলো হলো-শিক্ষার্থীদের হাত-পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, চক বা ডাস্টার-জাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা, আছাড় দেওয়া ও চিমটি কাটা, শরীরের কোনো স্থানে কামড় দেয়া, চুল টানা বা কেটে দেয়া, হাতের আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল চাপা ও মোচড় দেয়া, ঘাড় ধাক্কা দেয়া, কান টানা বা ওঠ-বস করানো, চেয়ার, টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করে বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং শ্রম আইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করানো।
    শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মা-বাবা, বংশ পরিচয়, গোত্র-বর্ণ ও ধর্ম স¤পর্কে অশালীন মন্তব্য, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করা বা শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে এমন বিষয়গুলোও মানসিক শাস্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে বলে সেখানে জানানো হয়। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরণের শাস্তি দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
    এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে চারটি স্লোগান ঠিক করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এসব স্লোগান যুক্ত হবে সরকারি চিঠিতে।
    জানা গেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দপ্তর ও সংস্থা থেকে মাঠপর্যায়ে পাঠানো সব চিঠিতে পর্যায়ক্রমে এসব স্লোগান সন্নিবেশিত করার নির্দেশ দিয়ে ইতোমধ্যে আদেশ জারি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। স্লোগানগুলো হল-
    ০১. ‘শাস্তিমুক্ত বিদ্যালয়, শিক্ষালাভে সহায় হয়’
    ০২. ‘শিশুর জন্য বেত ছড়ি, সৃজনশীল বাংলা গড়ি’
    ০৩. ‘আদর আর ভালোবাসা, দিতে পারে সুশিক্ষা’
    ০৪. ‘শিখবে শিশু হেসে খেলে, শাস্তিমুক্ত পরিবেশে পেলে’
    লেখকঃইসমাইল মাহমুদ : সভাপতি, ম্যানেজিং কমিটি, শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, জালালিয়া সড়ক, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার।