চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ

    0
    276

    আমারসিলেট24ডটকম,অক্টোবর,আশরাফুল ইসলামএকজন ব্যবসায়ী দোকানদার যদি হা-হুতাশ করে বলেন যে, তার ক্রেতা বা কাষ্টমার কমে গেছে তাহলে, হয়তো আমরাও ঐ দোকানদার বা ব্যবসায়ীর কষ্টে একবাক্যে সকলে একটু হলেও কষ্ট পাওয়ার ভান করি। চিকিৎসকের কাষ্টমার হচ্ছেন রোগী অথবা রোগীর প্রতিনিধি। সেক্ষেত্রে রোগের প্রকোপ কমে যাওয়ায় চিকিৎসক বা ডাক্তার যদি হতাশা প্রকাশ করে বলেন যে, তাঁর রোগী নাই বা কাষ্টমার নাই তখন, আমাদের কি করা উচিত? বা অবশ্যই ব্যক্তিভেদে ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করবেন। আমরা মনে করি, প্রথমত, চিকিৎসাসেবা ক্রয় করার মত সামর্থ্য কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকের উপর রোগীর আস্থা কমে গেছে। তৃতীয়ত,রোগ ও রোগীর পরিমান কমে গেছে । এক্ষেত্রে, ৫০ শয্যা বিশিষ্ট(প্রকৃতপক্ষে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট, তাও আবার অযোগ্য) চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কে আমরা কোন্ শ্রেণির চিকিৎসাকেন্দ্র বলে ধরে নিব।

    উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর মূল গেইটের দুই ধারে চারটি ওষুধের দোকান। হাসপাতাল ভবনের নীচে গাড়ী বারান্দা, বাগানের রেলিং, নিজেদের মোটর বাইক ও জরুরী বিভাগের দরোজায় দাড়িয়ে, বসে আছেন শতশত মেডিক্যাল প্রতিনিধি। সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ডাক্তার ভিজিটের জন্য সময় নির্দিষ্ট করা হলেও যেকোন সময় হাসপাতাল কমপ্লেক্সে, ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন একাধিক মেডিক্যাল প্রতিনিধি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এসব প্রতিনিধিরা ডাক্তারদের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসাবে কাজ করার সুযোগ পান বলে ধন্য হন। উল্লেখ্য, মানহীন ও নিম্ন মানের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের আনাগোনা সবচে বেশী-এর কারন অনুসন্ধ্যানে বেরিয়ে আসল যে, যে সকল কোম্পানী বা প্রতিনিধির দেয়া এমসিএস-এর পরিমান বেশী ডাক্তাররা তাদের ওষুধ বেশী লেখেন। মান্থলি ক্লিনিক্যাল সার্ভিস বা এমসিএস হচ্ছে, ডাক্তারকে দেয়া ওষুধ কোম্পানীর বিশেষ পারিতোষিক। দেখা যায়, বিভিন্ন নামে দেয়া হচ্ছে ঘুষ এবং ঘুষের পরিমানের উপর নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানীর মান ও কার্যকারিতা। মেডিক্যাল প্রতিনিধিসূত্রে জানা যায়, ডা. মামুন একাই ৩৫টি ওষুধ কোম্পানীর এমসিএস বা মান্থলী ক্লিনিক্যাল সার্ভিস ফিস গ্রহন করেন, কোম্পানীর ওষুধ লেখার জন্য প্রত্যেকটি এমসিএস কমপক্ষে ৫হাজার টাকার ঘুষ। মেডিক্যাল প্রতিনিধিরা এমসিএস দিয়ে পক্ষান্তরে কিনে নেন চিকিৎসকদের এবং বসে থাকেন ডাক্তারদের চেম্বারে। এভাবে লিখিয়ে নেন নিজেদের অখ্যাত-কুখ্যাত কোম্পানীর ওষুধ।

    অনিয়ম ও দূর্নীীতর স্বর্গরাজ্য চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি চলছে ডাক্তার-নার্স-কর্মচারীদের ইচ্ছেমত। রোগ ও রোগীর সেবা কোন কালেই প্রাধান্য পায়নি এই বিশাল সীমানার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। সরেজমিনে, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে দেখা যায় কর্মকর্তা অনুপস্থিত। উক্ত কর্মকর্তা ডা. ইমতিয়াজ আহমেদকে ফোন করলে জানা যায়, উনি ব্যক্তিগত কাজে বাইরে আছেন। জানা যায়, অত্র হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরএমও) ডা. এ.এইচ.এম.আই মামুন ভারপ্রাপ্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্ব প্রদান সম্পর্কিত কোন বৈধ রেজিষ্টার ডা. মামুন দেখাতে পারেননি। বিভিন্ন তথ্য জানার জন্য ডা. মামুনের হাসপাতালের কোয়ার্টারে গিয়ে দেখা যায় রোগীদের লাইন। অফিস চলাকালীন সময়ে বাসায় রোগীদের লাইন কেন জানতে চাইলে ডা. মামুন জানান, এরা আরেকটু ভাল চিকিৎসার জন্য এখানে আসেন। অপেক্ষা করার জন্য চেম্বারে বা বাসায় বসে দেখা যায় প্রত্যেক রোগীকে তিনি ডায়াগনোসিস করার জন্য নিকটস্থ প্রাইভেট ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন এবং উক্ত ডাক্তারের টেবিলে রয়েছে সেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ভিজিটিং কার্ড এবং প্রতিটি নির্দেশনা পত্রের সাথে গেঁথে দিচ্ছেন সেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের ঠিকানার কার্ড। এছাড়াও, রোগীদের ঘন্টা ধরে বসিয়ে রেখে ফোনে চিকিৎসা দেন দূরবর্তী কাউকে। পরবর্তীতে অনুসন্ধ্যানে জানা যায় যে, ডা. মামুন সেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের একজন প্রধান অংশীদার। অফিস সময়ে প্রায়ই ডা. মামুন থাকেন সেবা ডায়াগনষ্টিক এর চেম্বারে। রোগীর আত্মীয় স্বজনরা গিয়ে হাতে পায়ে ধরে নিয়ে আসেন তাকে। উল্লেখ্য, সরকারী কাজ ও বেসরকারী কাজ পরিচালনা করার জন্য ডা. মামুন সেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের একটি মোটর বাইক ব্যবহার করে থাকেন। ডা. মামুনের কার্যকলাপ সম্পর্কে একজন ভূক্তভূগী বলেন, উনি কার ডাক্তার বুঝার কোন উপায় নেই। রোগীদের অবহেলা করা, সামান্য পেট ব্যথাতেই আলট্রাসনোগ্রামের নির্দেশ পত্র ধরিয়ে দেওয়া ও রোগীদের নিকট থেকে অবৈধভাবে ফিস গ্রহন করা ডা. মামুনের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। ডা. মামুনের কার্যকলাপে বুঝার উপায় নেই যে, এটা সরকারী চিকিৎসাকেন্দ্র। ডা. মামুনের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন এডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন চিকিৎসক নিজেকে হাসপাতালটির মালিক মনে করেন। স্থানীয় এই এডহক চিকিৎসক চিকিৎসা কর্মে অদক্ষ হয়েও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন, অথচ, ভুল চিকিৎসায় রোগীর অবস্থা খারাপ করে দেওয়ার ঘটনাও এখানে ঘটাচ্ছেন এই এডহক চিকিৎসক। কমপ্লেক্সে রোগীদের নিকট থেকে ভিজিট বা ফিস রাখা হয় নিয়ম করে। প্রত্যেক চিকিৎসক রোগীদের নিকট থেকে ফিস রাখার প্রতিযোগিতা করেন। বিনামূল্যের ওষুধ পাওয়া এখানে ভাগ্যের বিষয়। জরুরী বিভাগে চিকিৎসককে ধরে আনতে হয় বাসা অথবা চেম্বার থেকে। একটু জটিল রোগীকে ছুঁয়েও দেখেন না চিকিৎসকরা, রোগীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে কিংবা ঢাকায় অথবা সিলেটে। অনেকাংশে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া রোগীরা পথেই মারা যান।

    চিকিৎসা সংক্রান্ত অনিয়ম-দূর্নীতির পাশাপাশি প্রশাসনিক দূর্নীতিতে অদ্বিতীয় চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রশাসন। গত বছর হাসপাতাল চত্বরের সেগুন গাছ কেটে গোপনে বিক্রি করে দেওয়ার মত ঘৃন্য কাজও কর্তৃপক্ষ করেন নির্দ্বিধায়। রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, অনিয়মিত পরিদর্শন ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রোগীদের ফেলে রাখা ও ভূয়া সনদ প্রদানে উক্ত হাসপাতালের জুড়ি নেই। ৩০ থেকে ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নীত হাসপাতালটি এখনও প্রস্তত হতে পারছেনা বিভিন্ন অভাবের দোহাই দিয়ে, তম্মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন উপরি ঝামেলা। গত মাসে কমপ্লেক্সের ওষুধের গোদামের তালা ভেঙ্গে লক্ষাধিক টাকার জরুরী ওষুধ চুরি হয়ে যায়। অনেকেই ধারনা করছেন, উক্ত চুরির ঘটনার সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লোক জড়িত, না হলে, সুরক্ষিত গোদামের তালা ভেঙ্গে ওষুধ চুরির ঘটনা অকল্পনীয়। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, রোগীদের ওষুধ দেওয়া অনেক ঝামেলার কাজ, ঝামেলা এড়াতে চুরির নাম করে ওষুধ পাচার করে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, অতীতে এরকম ওষুধ চুরির ঘটনা অনেকবার ঘটেছে এবং ঘটনার নায়কদেরও চেনা হয়েছে, তবুও কর্তৃপক্ষ ওষুধ চুরি রোধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। অন্যদিকে, এই কমপ্লেক্সে অবস্থিত পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও স্বাস্থ্য সহকারী ও স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের কাজ নেই বলে এরা ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রতিষ্টান খুলে বসেছেন।

    দীর্ঘদিন ধরে এমন অসঙ্গতি চলতে থাকলেও দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্টান হাসপাতালটির দূর্দশা লাঘবে কোন ব্যবস্থা নেননি। জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ভাবে বিষয়টিকে এড়িয়ে যান। হাসপাতালটির দৈন্যতার সুযোগে কমপ্লেক্সের সামনে গড়ে উঠেছে চারটি বেসরকারী ডায়াগনষ্টিক সেন্টার।শোনা যায়, বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বন্ধ করে রাখা হয় প্রতিবাদকারীদের চোখ ও মুখ। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিবেদক অনুসন্ধ্যানে গেলে কয়েকজন চিকিৎসক এই প্রতিবেদককে মাসোহারা গ্রহনের প্রস্তাব করেন। উক্ত প্রতিবেদক মাসোহারা গ্রহনে রাজী না হওয়ায় এই প্রতিবেদককে বিভিন্নভাবে উপহাস করা হয়।

    স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির চলমান অসুস্থতা আজ প্রায় এক যুগের বেশী হলেও একে সুস্থ করার কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছেনা। বেসরকারী ক্লিনিকের দালাল ও ওষুধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের দেয়া এমসিএস, উপহার বা নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে চিকিৎসা সেবাকে। অত্র উপজেলার ছয় লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসা সেবাকে উপেক্ষিত রেখে ব্যক্তিগত লাভলোভে মত্ত অসাধু ব্যক্তিদের অনৈতিক সুবিধা চর্চার ক্ষেত্রে পরিনত হয়েছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি। তবে, সুস্থ সমাজ গঠনে চিকিৎসা সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন সচেতন মহল।