চুনারুঘাটে ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্টার যৌক্তিকতা ও উপযোগিতা

    0
    253

    আমারসিলেট24ডটকম,২৭জানুয়ারী: অর্থনীতি এবং উন্নয়নের সূচকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা সারাদেশের পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলোর একটি। যদিও নানা সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর হওয়া সত্বেও চুনারুঘাট বিগত সরকারগুলোর আমলে সব সময়ই ছিল অবহেলার পাত্র। স্বাধীনতার ৪৩ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও চুনারুঘাটে চোখে পড়ার মত কোন উন্নয়ন পরিলক্ষিত হয়নি।

    যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও বিদ্যুৎ সহজলভ্য হওয়া সত্বেও সরকারী উদ্যোগে এখানে গড়ে উঠেনি কোন শিল্প কারখানা। মহাজোট সরকার উন্নয়নের ইশতেহার নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর-পরই চুনারুঘাটবাসী আশায় বুক বাধে এবার তাদের কিছু একটা হবেই। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় প্রশাসন একটি প্রস্তাব রাখে, চুনারুঘাটে একটি বৃহৎ পরিসরে ইকোনোমিক জোন করার। যেখানে ৫১১ একর জায়গা নিয়ে একটি ইকোনোমিক জোন করার কথা বলা হয়েছে। যদি ৫১১ একর জমি নিয়ে ইকোনোমিক জোন করা হয়, তাহলে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ স্থানীয় প্রশাসনের।

    যার ফলে এখানে প্রায় ৫০ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন অনেকেই। বেকার সমস্যায় জর্জরিত হবিগঞ্জ বাসীর জন্য এটা আশির্বাদ স্বরূপ। জনমনে উৎসাহ জাগছে এবং তারা আশায় বুক বাধছেন এই ভেবে যে, ইকোনোমিক জোনের উছিলায় উন্নত হবে রাস্তাঘাট, মৃত প্রায় চুনারুঘাট শহর ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুস, বেকার সমস্যার সমাধান হবে, উন্নত হবে জনগনের জীবন মান। এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক অন্য দিকে। চুনারুঘাটে ইকোনোমিক জোন বা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা সাময়িক সুফল বয়ে আনলেও ক্ষতি হবে দীর্ঘ মেয়াদী।

    যা কোন অর্থনৈতিক মানদন্ডেই পূরন করা যাবে না। অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার জন্য যে জায়গাটা বাছাই করা হয়েছে তা চুনারুঘাটের ৩নং দেওরগাছ ইউনিয়নে অবস্থিত। জায়গাটির ভৌগলিক পরিবেশ মোটামুটি এরকম যে, পশ্চিমে বেগমখান চা বাগান এবং তৎসংলগ্ন আবাদ বস্তি এলাকা, দক্ষিনে চাঁন্দপুর চা বাগান, পূর্বে চাঁন্দপুর বস্তি, ইনাতাবাদ, কালিশিরী গ্রাম, জোয়ালভাঙ্গা চা বাগান, উত্তরে দেওরগাছ এবং সুতাং নদী।

    মোটামুটি যে জায়গাটাতে জোন বানানো হবে দেখা যাচ্ছে তার চতুর্দিকে লোকালয় অবস্থিত। সাধারনত লোকালয়ের মধ্যে একটা ইটভাটা নির্মান করা নিষিদ্ধ, সেখানে এরকম একটা জায়গায় ইকোনোমিক জোনের মত ব্যয় বহুল প্রজেক্ট নির্মান করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? যে ৫১১ একর জায়গা নির্ধারন করা হয়েছে তার পুরোটাই আবাদি জমি এবং সেখানে প্রচুর পরিমানে ধান এবং অন্যান্য ফসল উৎপাদিত হয়। এমনিতেই বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে খাস জমি এবং অনাবাদি জায়গা রয়েছে সেখানে এত পরিমানে আবাদি জমি ধ্বংস করে ইকোনোমিক জোন করার চেষ্টা যুক্তিযুক্ত নয়।

    প্রতি একর জায়গাতে যদি গড়ে ৫০মন ধান উৎপন্ন হয় তাহলে আউশ এবং আমন দুই ফসলে সেখানে উৎপাদিত হবে ৫১১ী৫০ী২ মন ধান অর্থাৎ ৫১হাজার ১০০মন ধান। প্রতিমন ধানের দাম গড়ে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করলে পাওয়া যাবে ৫১১০০ী৭০০=৩৫৭৭০০০০/= টাকা। বুরো এবং শীতকালীন সবজির বাজার দরের কথা না হয় বাদই দিলাম। যদি এখানে ইকোনোমিক জোন করা হয় তা হলে বাৎসরিক ৩,৫৭,৭০০০০/= টাকার ধান হতে বঞ্চিত হবে চুনারুঘাটবাসী। যা পূরন করতে হবে অন্যান্য এলাকাগুলো হতে। ইকোনোমিক জোনের বর্জ্য পদার্থ যদি সুতাং নদীর মাধ্যমে নিকাশ করা হয়, যে সুতাং নদী পতিত হয়েছে হাওরাঞ্চলে, তাতে আশে পাশের পরিবেশ তো দুষিত হবেই ধ্বংস হবে হাওরাঞ্চলের জীব বৈচিত্র। ধ্বংস হবে আমাদের মৎস ভান্ডার।

    সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রমের ১০কিলোমিটারের মধ্যে যেখানে একটা স’মিল বসানো নিষেধ সেখানে আমাদের হবিগঞ্জের গর্ব সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের দূরত্ব স্পট হতে মাত্র ৫কিলোমিটার। ২০হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থাপিত ইকোনোমিক জোন হতে বাৎসরিক যত টাকাই আয় করা হোক পরিবেশের যে ক্ষয়ক্ষতি হবে তা কোন অর্থ মূল্যেই পূরন করা যাবে না। বলা হয়েছে, ইকোনোমিক জোন করা হলে স্থানীয়দের চাকুরী দেওয়া হবে, ঘর প্রতি একজন করে কর্ম সংস্থানের সুযোগ দেওয়া হবে।

    কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কখনোই স্থানীয় কোন লোক নিয়োগ দেওয়া হয় না। কারণ স্থানীয়রা তাতে প্রভাব খাটাবার চেষ্টা করবে। উদাহরণ স্বরূপ, চুনারুঘাটের রাণীগাঁওয়ে অবস্থিত আফতাব কোম্পানীর আফতাব হ্যাচারী এবং শাহজিবাজার তথা অলিপুরে অবস্থিত হবিগঞ্জ ইন্ডাষ্ট্রিয়াল জোনের কথা বলতে পারি। সেখানে সাধারনত স্থানীয় লোক নিয়োগ করা হয়নি।

    আর স্থানীয় দু-চার জন সেখানে নিয়োগ পেয়েছে প্রত্যেকেই তারা রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত নয়ত সংখ্যালঘু। তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে ইকোনোমিক জোন করা হলেও স্থানীয়দের তা কোন কাজেই আসছে না। অন্যদিকে, এখানে ইকোনোমিক জোন নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিন্তু নেয়া হয়নি কোন বিশেষজ্ঞ পরিবেশবিদের পরামর্শ। এখানে যদি ইকোনোমিক জোন করা হয় তাহলে মানা হবে না কোন পরিবেশের নীতিমালা। পরিবেশ ঠিক রেখে এখানে ইকোনোমিক জোন স্থাপন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া এখানে ইকোনোমিক জোন করার বিপক্ষে আন্দোলন করছে স্থানীয় আদিবাসীরা। যারা সব সময়ই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের ভোট ব্যাংক হিসাবে কাজ করেছে।

    যদি এখানে ইকোনোমিক জোন স্থাপিত হয়েই যায়, তাহলে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে পাল্টে যাবে ভোটেরও হিসাব নিকাশ। আশা করি সরকার উপরোক্ত অবস্থা বিবেচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করে রক্ষা করবে চুনারুঘাট বাসীর প্রাকৃতিক পরিবেশ। এছাড়াও, যদি চুনারুঘাটে কোন ইকোনোমিক জোন করা হয় তাহলে চুনারুঘাট হারাবে তার আবাদি জমি, ধ্বংস হবে পরিবেশ, প্রকৃতি হারাবে তার সৌন্দর্য্য।

    এখানকার আকাশ সবসময় ঢেকে থাকবে কল-কারখানার কালো ধূয়ায়, বর্জ্য পদার্থ ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে দুষিত করবে বিশুদ্ধ পানি, হাওরাঞ্চল হারাবে তার মৎস সম্পদ, সেখানে উৎপাদিত হবে না কোন ফসলাদি। ইকোনোমিক জোনের আশে পাশের জমি হারাবে তার উর্বরতা, ধ্বংস হবে চুনারুঘাটের নির্মল পরিবেশ ও প্রকৃতি। তাই, উক্ত অঞ্চলে ইকোনমিক জোন প্রতিষ্টার যৌক্তিকতা ও উপযোগিতা নিয়ে আগেই ভাবা দরকার।লেখকঃ শঙ্খনীল চৌধুরী ও গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার।