চট্টগ্রামে জঙ্গী আস্তানাকে ঘিরে পরিস্থিতির অবসানঃনিহত-৪

    0
    289

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৭মার্চ,ডেস্ক নিউজঃ  চট্টগ্রামের সীতাকু- পৌর এলাকায় জঙ্গী আস্তানাকে ঘিরে টানা ১৯ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। রক্তাক্ত হলেও অভিযান সম্পূর্ণ সফল। অভিযান চলাকালে এক মহিলাসহ ৪ জঙ্গী নিহত হয়েছে। নিহত জঙ্গীদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিহত ৪ জঙ্গীর আপাদমস্তক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নিহত জঙ্গীদের সঙ্গে একটি শিশুর লাশও পাওয়া গেছে। এদের কারও পরিচয় মেলেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, শিশুটি জঙ্গী নারীর সন্তান হতে পারে। পুলিশ জঙ্গীদের লাশ ও ছিন্নভিন্ন দেহের অংশ উদ্ধার করেছে। সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সমন্বয়ে এবং পুলিশ, র‌্যাবের সহযোগিতায় এ অভিযানে সাধারণ জানমালের কোন ক্ষতি হয়নি। বুধবার বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত প্রায় ১৮ ঘণ্টার অভিযানে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হয়েছে ৫ পরিবারের ২২ সদস্য। যাদের মধ্যে নারী-পুরুষের পাশাপাশি শিশুও রয়েছে। সকলে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারপ্রাপ্ত।

    অভিযান শেষ হওয়ার পর সরেজমিনে পরিদর্শনে জানা যায়, দ্বিতল বিশিষ্ট ছায়ানীড় নামের ভবনের ৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৫টিতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাসরত ২২ সদস্যকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। অভিযান চলাকালে সোয়াতের ২ সদস্য স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। ছায়ানীড় ভবনের মালিক মরহুম ওয়ালিউল্লাহর স্ত্রী রেহেনা বেগম ও তার দুই পুত্র মহিউদ্দিন ও নাসিরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ছায়ানীড়ের মোট ৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে একটিতে থাকত বাড়ির মালিকের পরিবারের সদস্যরা। একটি ছিল খালি। ৫টিতে ছিল ভাড়াটিয়া। ৫টির একটি অর্থাৎ নিচতলার একটি ফ্ল্যাট প্রায় দু’মাস আগে মাসিক ৬ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিল এই জঙ্গীরা। অভিযানে উদ্ধার হয়েছে গ্রেনেড, বোমা, বিস্ফোরকসহ বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম ও নানা ধরনের যন্ত্রপাতি।

    পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিইউ) ও সোয়াত বাহিনী ‘এ্যাসল্ট-১৬’ অভিযান নাম দিয়ে অপারেশনে নামে বৃহস্পতিবার ভোরে। এর আগে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ আসে যেখানেই জঙ্গী আস্তানা সেখানে অভিযান। ফলে সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর হতে থাকে। বৃহস্পতিবার ভোরে সশস্ত্র অভিযানের সূত্রপাত ঘটে। মাত্র ৪৫ মিনিটের এ অভিযানে প্রাণ হারায় জেএমবির মহিলাসহ ৪ জঙ্গী। মহিলা জঙ্গী প্রাণ হারায় পুলিশের গুলিতে। অপর তিনজনের মধ্যে একজন গুলি ও আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণে এবং বাকি ২ জনও মারা যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। এদের মধ্যে একজনের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় ৫ শ’ গজ দূরে বিলে গিয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই জঙ্গী ছাদের ওপরই পুলিশকে মোকাবেলায় তৎপর ছিল। পুলিশের গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই শরীরে থাকা আত্মঘাতী বোমারও বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তার পুরো শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ফলে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে প্রায় ৫ শ’ গজ অদূরে।

    অভিযানের আগে বুধবার রাতের মধ্যেই ঘটনাস্থলে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহানগর ইউনিটের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত বাহিনীর সদস্যদের। তাদের সহযোগিতায় থাকে র‌্যাব, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকালে অভিযান শুরু হওয়ার পর জঙ্গীদের সঙ্গে পুলিশ, সিটিইউ এবং সোয়াত বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গুলি-পাল্টা গুলি, শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় জঙ্গী আস্তানায় জেএমবি এই ৪ সদস্য নিহত হয়। ওই ফ্ল্যাটের পুরো ভবন তল্লাশি চালানোর পর আর কাউকে পাওয়া যায়নি। নিহত জঙ্গীরা সকলেই জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। মহিলাসহ নিহত এই চার সদস্য জেএমবির নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে উত্থান প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। পুলিশী অভিযানে গুলিতে একজন মারা যাওয়ার পর বাকিরা টিকে থাকার কোন পথ খুঁজে না পেয়ে আত্মঘাতী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তা-ই করে। শক্তিশালী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে ভবনটির দোতলার সিঁড়িঘরের ছাদও উড়ে যায়। এ অভিযানে আহত সোয়াতের ২ সদস্যকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়েছে। সিএমইচ সূত্রে বলা হয়েছে, তাদের অবস্থা শঙ্কামুক্ত। অভিযানের পর বুধবার বিকেল ৩টা থেকে জিম্মি হয়ে থাকা ৫ ফ্ল্যাটের জানালার গ্রিল কেটে ও দরজা ভেঙ্গে নারী-পুরুষ, শিশুসহ ২২ সদস্যকে উদ্ধার করা হয়েছে।

    বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় অভিযানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি শফিকুল ইসলাম। এরপরে জঙ্গী আস্তানাটিতে চলে উদ্ধার তৎপরতা। একে একে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সরঞ্জামাদি। উদ্ধার এসব বিস্ফোরক ও গোলাবারুদের তালিকা প্রস্তুতের কাজ বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত চলছিল।

    উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে ঘটনার সূত্রপাত। সীতাকু- পৌর এলাকায় প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বের ব্যবধানে দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথমটি পৌর এলাকার নামারবাজার আমিরাবাদ এলাকার ‘সাধন কুঠির’ নামক একটি ভবনে এবং দ্বিতীয়টি প্রায় ২ কিলোমিটার অদূরে প্রেমতলা এলাকার ‘ছায়ানীড়’ ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে। জঙ্গী আস্তানার খবরের ঘটনা মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চাউর হয়ে গেলে সীতাকু-ে সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেমে আসে। রাজনৈতিক নেতাসহ সমাজের বিভিন্নস্তরের শ্রেণী পেশার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যায়। সময় যতই গড়ায় উৎকণ্ঠাও তত বাড়তে থাকে। বৃহস্পতিবার সীতাকু-ের স্কুল, কলেজসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকে। অনেকেই নিরাপত্তার অবস্থান বেছে নেয়। তারপরও ভবনটির আশপাশজুড়ে বাড়িঘরে বসবাসরতরা অজানা শঙ্কার মাঝে ডুবে যায়। কি হতে যাচ্ছে। কি ঘটতে পারে এসব প্রশ্ন ও নানা জল্পনা-কল্পনায় মানুষের অন্ত ছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি বিবেচনায় এনে রাতে অভিযান পরিচালনা না করে ভোরের আলো ফোটামাত্রই অপারেশন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাতে সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতি এড়ানো যায়। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। জঙ্গী সদস্যরা নিহত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে কোন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। ফলে এ অভিযান সকল মহলের কাছে সাধুবাদ কুড়িয়েছে। অভিযান শুরু করার পর জঙ্গীদের সঙ্গে পুলিশের গুলি বিনিময় হয়। দফায় দফায় জঙ্গীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় পুলিশের গুলিতে প্রথমে প্রাণ হারায় ছাদের ওপর আত্মঘাতী বোমাসহ অবস্থান নেয়া এক জঙ্গী। এরপর গুলিতে প্রাণ হারায় মহিলা জঙ্গী। বাকি ২ জনও আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তাদের মৃত্যু হয়।

    ঘটনার পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত সদস্যরা ফ্ল্যাট অভ্যন্তরে প্রবেশ করে দেখতে পান এতে সর্বত্র গ্রেনেড ও বিস্ফোরকদ্রব্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ঘরের ছাদেও পুঁতে রাখা ছিল বেশকিছু বোমা। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা বালির বস্তা দিয়ে ১০টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে দুটির বিস্ফোরণ পুরো এলাকাকে প্রকম্পিত করে। নিহত মহিলা জঙ্গীর শরীরে ভেস্ট বাঁধা আত্মঘাতী বোমা ছিল। ফলে সময় নিয়ে মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ফ্ল্যাটে বোমা তৈরির অসংখ্য সরঞ্জামাদিও সতর্কতার সঙ্গে উদ্ধার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খুব সাবধানে সময় নিয়ে বোমা নিষ্ক্রিয় করে একে একে। বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের এক সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, কয়েকটি গ্রেনেড এত শক্তিশালী যে, সাবধানতা অবলম্বন না করলে বিস্ফোরণে পুরো ভবনটি ধসে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই ধীরে সুস্থে পুরো কাজ সম্পন্ন করতে হয়েছে। যার ফলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফ্ল্যাটটির অভ্যন্তরে বেশকিছু গ্রেনেড ও বোমা অপসারণের কাজ অব্যাহত থাকে।

    সীতাকু-ে জঙ্গী আস্তানায় এ সফল অভিযানের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক অভিযান সফল বলে দাবি করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশ থেকে জঙ্গী বিদেশে যাওয়ার সুযোগ খুব কম। তবে বাইরে থেকে আসাটা অমূলক নয়। এ জন্য নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আইজি বলেছেন, জঙ্গীদের নতুনভাবে কোন অবস্থানে সংগঠিত হতে দেয়া হবে না। উল্লেখ্য, গাজীপুর, রূপপুর, টাঙ্গাইল, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা, কুমিল্লার চান্দিনা, ময়নামতির পর সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানার ঘটনা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। তারা ঘন ঘন স্থান বদল করে শক্তি সঞ্চয় করছে এবং সুযোগ নিয়ে হামলার চেষ্টায় লিপ্ত। অপরদিকে, সীতাকু-ের ছায়ানীড় ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটটি অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল বলে পুলিশ ধারণা করছে। কারণ, যে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্যের সন্ধান মিলেছে তা থেকে অনুমেয় যে, এ ফ্ল্যাট থেকে এ অঞ্চলে গ্রেনেডসহ বিভিন্ন বিস্ফোরকদ্রব্য সরবরাহ হতো। এছাড়া ফ্ল্যাটটিতে জঙ্গীরা বিস্ফোরক দিয়ে বোমা তৈরির কাজও করে আসছিল।

    অভিযানের রক্তাক্ত ও শিহরণমূলক বর্ণনা ॥ বুধবার বিকেল ৩টার পর থেকে জঙ্গী আস্তানা দুটি কর্ডন করে ফেলা হয়। পুলিশ, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শত শত সশস্ত্র সদস্যের সমাবেশ ঘটানো হয়। জলকামানের গাড়িসহ পুলিশের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ঢাকা থেকে দ্রুত নিয়ে আসা হয়। এছাড়া প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি গাড়িও। প্রথম আস্তানা অর্থাৎ আমিরাবাদ এলাকার সাধন কুঠির নামের ভবনের নিচতলায় অভিযান চলাকালে জঙ্গীদের সঙ্গে গৃহকর্তা-কর্ত্রী ও অপর দু’জন সহযোগীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি হলেও জঙ্গী দম্পতি ও তাদের শিশুসন্তান সহজেই পাকড়াও হয়ে যায়। এ সময় সীতাকু- সার্কেলের এএসপি সাইফুল ইসলাম ও থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেল হোসেন স্পিøন্টার বিদ্ধ হন। পরে আটককৃত জঙ্গী দম্পতিকে তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বেরিয়ে আসে আরও একটি শক্তিশালী আস্তানার তথ্য। যা ওই স্থান থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে প্রেমতলার ছায়ানীড় ভবনের নিচতলায় অবস্থিত। ভবনটি দ্বিতল। নিচতলায় রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। দোতলায় রয়েছে আরও ৪টি ফ্ল্যাট। নিচতলার একটিতে সশস্ত্র জঙ্গীরা বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল। খবর নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে বুধবার বিকেলেই ভবনটি ঘিরে ফেলা হয়। চিহ্নিত ওই ফ্ল্যাটে পুলিশ হানা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গীরা গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ নিরাপদ অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। জঙ্গীরা ওই ফ্ল্যাট থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে দফায় দফায় গ্রেনেড নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পুলিশও ফাঁকা গুলি ছোড়ে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জঙ্গীরা ছিল বেপরোয়া। ফলে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পরিকল্পনায় ওই মুহূর্তে অভিযান বন্ধ রাখা হয়। পুরো বিষয়টি পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক মনিটরিং করতে থাকেন। তার নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে পরিকল্পনার ছক আঁটেন। বিকেল ৫টার পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে চতুর্দিকে ফোকাস লাইট লাগানো হয়। মাইক বাঁধা হয়। পুলিশ মাইক দিয়ে তাদের আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি। এরই মধ্যে ওই ভবনের নিচ ও দোতলার অবশিষ্ট ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা রীতিমতো জিম্মিদশায় নিপতিত হন। ফ্ল্যাট বাসিন্দারা যাতে কোন অবস্থাতে বের হতে না পারে সেদিকে নজর রাখে জঙ্গীরা। পুলিশ এ অবস্থায় মোবাইল ফোনে ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। তাদের প্রতিটি কক্ষের বাতি নিভিয়ে নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের কাছে বেশকিছু তথ্য নিয়ে পুলিশ অপারেশনের পরবর্তী ছক তৈরি করে। এরই মধ্যে আইজির নির্দেশে তলব করা হয় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট ও সোয়াত দলকে। সিএমপি ও ঢাকা থেকে সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা গভীর রাতের মধ্যে পৌঁছে যায় ঘটনাস্থলে। সমন্বয় বৈঠক হয়। সাধারণ মানুষের যাতে কোন প্রাণহানি না ঘটে সে জন্য ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই মধ্যে অপারেশনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।

    বৃহস্পতিবার সকালে ঘড়ির কাঁটা ৬টা পেরোনোর পর পরই শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। এর আগে রাতে জঙ্গীরা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ভবনটির ছাদে এবং বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে দফায় দফায় গুলিবর্ষণ, শক্তিশালী গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। সকালে সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বিশেষায়িত সদস্যদের অভিযান শুরু হলে জঙ্গীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। সকালে অভিযান শুরু হওয়ার পর জঙ্গীরা নিস্তব্ধ হয়ে গেলে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের নিয়ে ভবনটির নিচতলা ও দোতলার ফ্ল্যাটগুলোর দরজা জানালা ভেঙ্গে ২১ বাসিন্দাকে উদ্ধার করে। পরে বিকেল সোয়া ৪টার দিকে দোতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধকে উদ্ধার করা হয়। জঙ্গী অবস্থানে ফ্ল্যাট অভ্যন্তরে প্রবেশ করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মৃত অবস্থায় আনুমানিক ৬ বছরের এক শিশু, এক নারী ও এক পুরুষের মৃতদেহ দেখতে পায়। মহিলা ও পুরুষ দু’জনই জেএমবির সদস্য। তবে শিশুটি কে তা এখনও জানতে পারেনি পুলিশ। দোতলা উঠার সিঁড়িতে পাওয়া যায় আরও ১ পুরুষ জঙ্গীর ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। দোতলার ছাদে যে জঙ্গীর মৃত্যু হয়েছে তার শরীরের মাথাসহ বিভিন্ন অংশ ছিন্নভিন্ন অবস্থায় আশপাশ এলাকায় পাওয়া যায়। কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে লেগে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায় শরীরের টুকরো টুকরো অংশ। হাত-পা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। জঙ্গীদের ফ্ল্যাটটির কক্ষের দেয়ালজুড়ে রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ফ্লোরের মেজেতে রক্তের স্রোত। অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যরা জঙ্গীদের মৃতদেহ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ উদ্ধার করে। রুমের মধ্যে পাওয়া যায় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও গোলাবারুদ। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গণনা কার্যক্রম চলছিল। পাশাপাশি বোমা ও গ্রেনেড নিস্ক্রিয় করার কার্যক্রমও অব্যাহত ছিল।

    সকাল ১০টায় রেঞ্জ ডিআইজি শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের অভিযান সমাপ্তি নিয়ে ব্রিফিং করেন। ব্রিফিংয়ে তিনি সামগ্রিক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তিনি জানান, সীতাকু-, মীরসরাই অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোনসহ উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। এ কাজে সংযুক্ত হয়েছে দেশের পাশাপাশি বিদেশী অসংখ্য বিশেষজ্ঞ। এদের প্রতি ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তাদের কাজ থেকে বিরত রাখায় এ জঙ্গী সন্ত্রাসের অবতারণা বলে তিনি মন্তব্য করেন।

    এদিকে, পুলিশ জানায়, সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী দম্পতি হচ্ছে মোঃ জসিম ও আরজিনা। তাদের একটি শিশুসন্তান রয়েছে। তিনজনই এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। আটক হওয়ার পর থেকে এ জঙ্গী দম্পতি দ্বিতীয় আস্তানার নাম ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করেনি। পুলিশ চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা মুখ খুলছে না। এ জন্য অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাদের ঢাকায় প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।ইত্তেফাক থেকে।