গ্রাম বাংলার নেতা হবিগঞ্জের কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী

    0
    448
    আমারসিলেট24ডটকম,১২জানুয়ারী,তফিদুর রহমান তালুকদার তৌফিক: ২৩ টি বছর পার করে ২৪ বছরে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীকে স্মরণ করার সময় তার অনেক গুলো অবদানকে মনে হয় অনন্য। কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী বাংলাদেশের ইতিহাসে এক পরম সম্মানিত দেশ বরণ্য বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। তিনি অসাধারণ অকূতভয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সুচনাপূর্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ক’জন অসম সাহসী ব্যক্তিত্ব দেশের ভিতরে সংগৃহিত অস্ত্র-শস্ত্রে প্রতিরোধ যুদ্ধে সিলেট বাসীকে পথ দেখান; তার মধ্যে অনন্য মানিক চৌধুরী।
    পাকিস্তানী শাসকচক্রের রক্ষণশীল শোষনমুলক মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ৫০দশকের বাঙ্গালীর মধ্যে জাতিসত্ত্বা সন্ধানের সুগভীর অনুভুতি জাগ্রত হলে, তা দ্বারা ছাত্র মানিক চৌধুরী ও ভীষনভাবে প্রভাবিত হন। আর সেই দেশবোধে পরিণত হয়ে ৫২’এর ভাষা আন্দোলন, ৬২’এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’এর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা, সর্বপরি ১৯৬৯ এর গণঅভূথ্যানের মধ্য দিয়ে ৭১’এর মুক্তিসংগ্রামে অনন্য ভুমিকার; স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী।
    জাতির দুর্দিনে মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষা করতে ব্যক্তি মানিক চৌধুরীকে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে; ৫২’এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’এর মুক্তি-সংগ্রাম। জীবনের বিনিময়ে অর্জন করতে চেয়েছেন বিজয় নিশান। সে কারনে, মানিক চৌধুরীকে বিসর্জন দিতে হয়েছে জীবনের অনেক ছোট-বড় প্রাপ্তি, জীবনের বিকাশ সমৃদ্ধি ও আকাংখাকে। তবে তিনি জয় করতে পেরেছিলেন, কিছু অসাধারণ চারিত্রিক গুনাবলী। যার মধ্য দিয়ে বৈষয়িক উন্নতি সাধনের প্রলোভনকে তিনি; তার সমগ্র জীবনে পদদলিত করতে পেরেছেন গভীর দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতায়।
    মানিক চৌধুরী মানসগঠনের সবচেয়ে বড় ভুমিকা রেখেছিল শৈশব ও কৈশোরে দেখা বাহুবলের হাওর বেষ্টিত অঞ্চলের নিসর্গ ও জীবনভৈবব। গুঙ্গিয়াজুড়ি হাওরের প্রান্তিক মানুষের জীবন ও তাদের সংগ্রামশীলতা মানিক চৌধুরী চিন্তা- চেতনার জগতকে যেমন সমৃদ্ধ করেছিল, তেমনি মানবিক করে তুলেছিল। জীবনের বৈচিত্র্য অনুসন্ধানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ তার জীবন দৃষ্টিতে এনেছে স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত স্বচ্ছতা। যে কারনে কমান্ড্যন্ট মানিক চৌধুরী’র চরিত্রে অনন্য দিক ছিল; সৎ, নিষ্টবান,
    দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্ব।
    মানিক চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে হবিগঞ্জের বীর গণনায়ক হয়ে ওঠেছিলেন। সিভিলিয়ান হয়ে সামরিক উচ্চতর কমান্ড্যান্ট পদবীতে ভুষিত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতিকে পুজি করে; লালায়িত হননি, পদ পদবীর লালসায়। ক্ষমতার পোশাকে নিজেকে কখনও আবৃত্ত করেনি কোনদিন।
    মূল্যবোধ ও ন্যায়-নীতির মানদন্ডেরাজনীতিতেনিজেকেঅবিচল রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবৎদশায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতা হওয়া সত্বেও মানিক চৌধুরী জীবনবোধের প্রশ্নে মাটি ও মানুষ থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হননি। আকৃষ্ট হননি নাগরিক আভিজাত্যে। হবিগঞ্জের জনজীবন, মাটি ও মানুষ তথা প্রকৃতির প্রতি ছিল তার গভীর অনুরাগ।
    সে কারনে তিনি অনায়াসে পরিহার করতে পেরেছেন, ভোগবাদী রাজনীতির সংস্কৃতিকে। বঙ্গবন্ধুর শিষ্য হিসাবে খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ ওশ্রমজীবি মানুষের পাশে থেকে রাজনীতি করেছেন সারাজীবন। প্রতিহিংসা, কুটকৌশল, মিথ্যাচার দিয়ে গড়ে তুলেননি ভিন্নতর রাজনীতির ধারা-উপধারা, দল-উপদল। ব্যক্তি চিন্তার চেয়ে সামষ্টিক উন্নয়নের চিন্তাকে তিনি অগ্রাধিকার দিতেন।
    তার মনোযোগ এবং দৃষ্টি কেন্দ্রিভুত হত অসহায়-বঞ্চিত মানুষের প্রতি। সাম্প্রদায়িকতা, রক্ষণশীলতা, শ্রেনীগত বৈষম্যের মত অসুস্থ প্রবনতা তার রাজনৈতিক চিন্তাকে কখনও আচ্ছন্ন করতে পারেনি। শুধু মাত্র মানুষের ভালবাসা আর সম্মান পাবার আকাংখা নিয়েই সারাজীবন তিনি রাজনীতি করেছেন। জীবনযাপনে কখনো, বৈষয়িক উন্নতির চিন্তা না করায়; ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও চরম দৈন্যদশার মধ্য দিয়েই রাজনীতি করেছেন; আদর্শিক চেতনার বলিয়ানে। টাকা-সন্ত্রাস, ক্ষমতার অপব্যবহার, সাম্প্রদায়িকতা কবলিত দুর্বৃত্তায়নের রুগ্ন রাজনীতি যা বিপন্ন করে মানুষের মর্যাদা; সুস্থ গণতন্ত্র ও সমাজ বিকাশকে।
    সেই রাজনীতিকে কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী শুধু ঘৃণা করেননি, তা প্রতিহত করতে চেষ্টা করেছেন, তার সমস্ত আদর্শিক চেতনার শক্তি দিয়ে। আর সে কারনেই তিনি আদর্শের রাজনীতি পৌছে দিতে পেরেছিলেন হবিগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে। তিনি আজ নেই, তবে তার উত্তরাধিকার ও আদর্শের অনুসারীদের কাছে তিনি সম্পদে পরিণত হয়েছেন।‘মানুষের জন্য রাজনীতি, ক্ষমতার জন্য নয়’।
    এমন মন মানসিকতা নিয়েই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী। যতদিন বেঁচে ছিলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার থেকেছেন দৃঢ়তায়। যেভাবে সংগ্রামী ছিলেন ১৯৭১সালে রণাঙ্গনের যোদ্ধা হিসেবে। বাঙ্গালীর গৌরব, বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে, সমস্ত বিশ্বাস দিয়ে, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী লালন করেছেন বাংলাদেশকে।
    ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা জানাই, নীতি নৈতিকতার আদর্শের প্রতীক, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীকে। যার আদর্শ ও দর্শন বেঁচে থাকবে, সিলেটের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে।