ক্রমেই বাড়ছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা

    1
    497

    আমারসিলেট24ডটকম,০২এপ্রিলঃ কোন ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি (ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল) ব্যবসা। ক্রমেই বাড়ছে এই ব্যবসার প্রসার। এতে করে  শত শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে অবৈধ পথে সবচেয়ে বেশি কল আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক এর মাধ্যমে।

    দেশে-বিদেশে অবস্থানকারী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, টেলিকম মন্ত্রণালয়, রেগুলেটরি সংস্থা বিটিআরসির কতিপয় কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন ধরে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সাথে জড়িত। এই অবৈধ ব্যবসা রোধে বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বেশকিছু সুপারিশ সংবলিত একটি তদন্ত প্রতিবেদন গত ফেব্রুয়ারিতে জমা দিলেও এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। সরকার অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার প্রসার রোধ করতে না পারায় বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে কলের পরিমান বেড়ে দ্বিগুণে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বৈধ পথে দিনে আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ যেখানে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মিনিট; সেখানে অবৈধ পথে কলের পরিমান প্রায় সাড়ে ৬ কোটি মিনিট।
    এ বিপুলসংখ্যক অবৈধ কল অবৈধভাবে ট্রান্সফার থেকে সরকার বিরাট অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝে মধ্যে এর বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও প্রভাবশালীরা রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা একের পর এক ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ)-এর লাইসেন্স নিয়ে জড়িয়ে পড়েন ভিওআইপির মাধ্যমে অবৈধ কল টার্মিনেশনে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য এবং টেলিকম বিশেষজ্ঞদের অভিমত, অবৈধ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনে গত পাঁচ বছরে প্রায়ায় চার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। আর কল চুরি থেকে গত পাঁচ বছরে অবৈধ আন্তর্জাতিক কল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের আয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিআরসি’র এক কর্মকর্তা জানান, দিন দিন অবৈধ ভিওআইপি কারবারিদের কার্যক্রম বাড়লেও এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, একসময় এই হাইটেক ব্যবসা গোপনে চললেও এখন তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। মাঝে মধ্যে বিটিআরসি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো অভিযান চালালেও তাতে কোনো ফল হচ্ছে না।
    বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে মন্ত্রনালয়ের যে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে তাতে উল্লেখ করা হয়, অবৈধ ভিওআইপি রোধ করতে না পারার কারণের মধ্যে রয়েছে  এ খাতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করা। মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, এখাতের বেশিরভাগ লাইসেন্স হাতিয়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বজনরা। আগে দেশে আন্তর্জাতিক কল আদান-প্রদান করত মাত্র চারটি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান। বিগত মহাজোট সরকার এ খাতে ব্যবসার জন্য আরও ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়। এতে ব্যবসায়িকভাবে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে এই ২৯টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিটিসিএলের ব্যান্ডউইথের মাধ্যমে ঢাকার বাইরেও চলছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা।
    বিটিআরসি’র বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই অবৈধ ভিওআইপি কল গত বছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আর অবৈধ ভিওআইপি কলের সিংহভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটক দিয়ে। এ ব্যপারে বিটিআরসি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানালেও কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ ভিওআইপি বন্ধ না হলে টেলিযোগাযোগ খাতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে না; বরং ব্যক্তি বিশেষ দেশের অর্থ লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করবে।
    গত বছরের এপ্রিল মাসে ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত ‘ক্যারিয়ার্স ওয়ার্ল্ড এশিয়া’ সম্মেলনে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনের যে হিসাব দেয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশে প্রতিদিন কল টার্মিনেশনের পরিমাণ দেখানো হয় প্রায় ১৪ কোটি মিনিট। অথচ বিটিআরসির হিসাবে প্রতিদিন গড় আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের পরিমাণ ৫ থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি মিনিটের মধ্যে। সর্বশেষ বিটিআরসি থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আন্তর্জাতিক কলরেট পুননির্ধারণ প্রস্তাবে বৈধ কল মিনিট ৩ কোটি ৫০ লাখে নেমে আসার তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী এ কল মিনিট সংখ্যা অনেক। আবার বিটিআরসিতে একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের কাছ থেকে পাঠানো সিমকার্ড ডিটেকশন বক্সের তথ্যে দেখা যায়, সেখানে একদিনের হিসাবে ১ কোটি মিনিটের কিছু বেশি বৈধ কল এলেও ৪ কোটি ৩১ লাখ ৭২ হাজার কল এসেছে অবৈধ পথে। এভাবে বিটিআরসি স্থাপিত অন্য অপারেটরের সিমকার্ড ডিটেকশন বক্সে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল আসার গড় হিসাব করলে কল সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪ কোটি মিনিট।
    বিটিআরসি জানায়, ২৯টি আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে), ২৬টি ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), ৩৭টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ২টি ব্রডব্যান্ড ওয়ারলেস এক্সসেস (বিডাবি¬উএ), ৬টি মোবাইল অপারেটর, ৬টি ইন্টারন্যাশনাল টেরিসটরিয়াল সার্ভিস (আইটিসি), ১১টি পাবলিক সুইস টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন), ২টি ন্যাশন ওয়াইড টেলিকম নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ১টি ন্যাশন ওয়াইড অটিক্যাল ফাইবার টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক, ভিহকেল ট্যাকিং সার্ভিস ১৪টি, ইন্টারনেট প্রোটকল টেলিফোনি সার্ভিস প্রোবাইডর সেন্ট্রাল জোন, ৩টি ইন্টারনেট প্রোটকল টেলিফোনি সার্ভিস প্রোবাইডর জোনাল, ১২৬টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোবাইডর ন্যাশন ওয়াইড, ৬৩টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোবাইডর জোনাল, ৯৫টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোবাইডর সেন্ট্রাল জোন, ১৪৫টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোবাইডর ক্যাটাগরি-এ, ২৯টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোবাইডর ক্যাটাগরি-বি, ২৪টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোবাইডর ক্যাটাগরি-সি, ৪৬টি ভিস্যাট ইউজার, ১২টি ভিস্যাট প্রোবাইডর, ৫টি ভিস্যাট প্রোবাইডর ইউথ হাব, ২০৩টি কল সেন্টার, ৪১টি হোসটেড কল সেন্টার, ৩৬টি হোসটেড কল সেন্টার সার্ভিস প্রোবাইডর, ২টি ইন্টারন্যাশনাল কল সেন্টার, ১০০৪টি ভিএসপি (ভয়েস সার্ভিস প্রোবাইডর) লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। প্রতিটি লাইসেন্স মালিক ইচ্ছে করলেই ভিওআইপি করতে পারেন।
    এ ব্যপারে জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধে মন্ত্রণালয় আরও কঠোর নীতিমালা করছে। তিনি বলেন, বিটিআরসি’র দেয়া সুপারিশ মালাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
    তবে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড অপারেশন বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এ খাতে বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেয়ায় বিটিআরসির পক্ষে মনিটরিং করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব লাইসেন্সের বেশিরভাগ রাজনৈতিক চাপে দিতে হয়েছে। এর পরও অবৈধ ভিওআইপি বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে বিটিআরসি।সুত্রঃ ইনকিলাব,