কুমিল্লার ঘটনাকে পূঁজি করে দেশে ভয়ংকর গুজব ছড়ানো হচ্ছে

0
523
কুমিল্লার ঘটনাকে পূঁজি করে দেশে ভয়ংকর গুজব ছড়ানো হচ্ছে

আমার সিলেট ডেস্কঃ কুমিল্লার ঘটনাকে পূঁজি করে দেশের আরও কিছু এলাকায় ভয়ংকর গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রের মতে, ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন বিতর্কিত আইডি ও ছদ্মবেশী আইডিসহ কিছু চিহ্নিত রাজনৈতিক কর্মিদের এ সকল আইডি থেকে এসব মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অপচেষ্টা করছে একটি চক্র। এর মধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে গন ধর্ষনের শিকার ১০বছরের শিশুটি মারা গিয়েছে বলে ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে একাধিক আইডিতে ছড়ানো হচ্ছে মূলত হাজীগঞ্জ উপজেলাসহ দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেইনি বলে বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে দেশ-বিদেশের একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হচ্ছে-চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের মা-বোন ও দশ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। শিশুটি মারা গেছে। মূলত হাজীগঞ্জ উপজেলায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হাজীগঞ্জ উপজেলার সভাপতি বাবু রুহিদাস বণিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি গুজব বলে আখ্যা দিয়েছেন।
হাজীগঞ্জ উপজেলার হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সত্যব্রত ভদ্র মিঠুন,হাজীগঞ্জ থানার ওসি হারুনুর রশীদ এবং হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শোয়েব আহম্মেদ চিশতীর সুত্রে জানা যায়, হিন্দু সম্প্রদায়ে এমন কোনো ঘটনার বিষয়ে থানায় মামলা করতে বা চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা নিতে কেউ আসেনি। শেষ পর্যন্ত এর কোনো সত্যতা মেলেনি।
একই এলাকা ঘিরে গতকাল আরেকটি গুজব ছিল- সেখানে মানিক চন্দ্র সাহা নামের আরও একজনকে হত্যা করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় গুজবের বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করে ভিডিও বার্তাও দেওয়া হয়। গুজব ঘিরে যাতে নতুন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি না হয়, এ ব্যাপারে মাঠ প্রশাসনকে সতর্ক করেছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

এছাড়া গত বৃহস্পতিবার গুজব ছড়ানো হয় সারাদেশে পূজা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন উদযাপন কমিটির কেন্দ্রীয় নেতারা। সামাজিক মাধ্যমে এ ধরনের তথ্য দেখে অনেকে পূজা উদযাপন কমিটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেন। এর পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় পূজার কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়-পূজা বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টি পুরোপুরি গুজব।

এদিকে, কুমিল্লায় একটি মন্দির ঘিরে পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের পর একই ধরনের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রামের বাঁশখালী ঘিরেও। শেষ পর্যন্ত বাঁশখালীর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়।

পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি বলেন, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ কিছু এলাকায় আমাদের লোকেরা যথাসময়ে প্রশাসনের সাড়া পায়নি। ছোট-বড় মিলিয়ে ১৮টি জেলায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সব জায়গায় গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করা হয়েছে। অনেকের মধ্যে এখনও আতঙ্ক রয়েছে। তবে পূজার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। তখন তারা আশ্বস্ত করেছিল-নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা নেই। এখন দেখা গেল উল্টো চিত্র। এই প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের গাফিলতি খুঁজে বের করাও জরুরি।“

তিনি আরও বলেন, যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা হয়তো এই সময়টিকেই মোক্ষম মনে করেছিল। তারা সরকারকে বিব্রত করতে চায়। আবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আবহ চলছে। কেউ মনোনয়ন পেয়েছে; আবার অনেকে বঞ্চিত হয়েছে।

নির্মল চ্যাটার্জি অভিযোগ করেন, নোয়াখালীতে হামলা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে এক কর্মকর্তা বলেন, চলমান পরিস্থিতি ঘিরে এখন পর্যন্ত যে তথ্য তারা পাচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীরা এ পরিকল্পনা অনেক দিন আগেই সাজিয়েছিল। কোথায় কীভাবে কাজ করলে ধরা পড়ার ঝুঁকি কম থাকবে-এটা নিশ্চিত হতে অনেক এলাকায় রেকিও করা হয়। কুমিল্লায় প্রথমে যে এলাকায় তারা পরিকল্পনা করে, সেই মন্দির ও আশপাশ এলাকার কোনো ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত কোনো সিসিটিভির ফুটেজ পাওয়া যায়নি। তারা এমন এলাকা নির্বাচন করে, যেটা প্রযুক্তিগত নজরদারির বাইরে। যেহেতু এবার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের আলোকে কোনো পূজামণ্ডপে স্থায়ীভাবে পুলিশ বা আনসার রাখা হয়নি; এমন পরিস্থিতিতে সব মণ্ডপ সিসিটিভির আওতায় আসছে কিনা- তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজন ছিল। অনেক এলাকায় প্রশাসন তা নিশ্চিত করেনি।

সাইবার মনিটরিংয়ে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে গুজব রটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টায় যুক্ত কিছু ফেসবুক আইডি ও ইউটিউব লিঙ্ক শনাক্ত করে বন্ধের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) পাঠানো হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে গুজব ছড়িয়ে দেশে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা।

একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সুত্রে জানা যায়,প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন, কয়েকটি স্তরে ভাগ করেই পরিকল্পনাকারীরা তাদের ছক বাস্তবায়নের চেষ্টায় রয়েছে। মাঠে সরাসরি অপারেশনে অংশ নেওয়াদের পরামর্শ ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছে মূল পরিকল্পনাকারীরা। কোন ঘটনার পর কোনটি ঘটানো হবে- এটাও ছিল সাজানো। পুরো ছকের মূল হোতা হিসেবে একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ এক নেতাকেও কিছু তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন গোয়েন্দারা।

পুলিশের সাইবার ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন আইডি থেকে নতুন নতুন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্য করতে অনেক আইডি থেকে ভুয়া ভিডিও দেওয়া হচ্ছে। আবার হিন্দুদের নাম ব্যবহার করে ফেসবুকে কিছু আইডি তৈরি করে সেখান থেকেও ছড়ানো হচ্ছে অসত্য তথ্য।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কে এম আজাদ বলেন, জড়িতরা ছাড় পাবে না। নাশকতাকারীদের যারা ইন্ধন দিয়েছে, তাদের শনাক্ত করার কাজও চলছে। আমরা বেশ কিছু তথ্যও পেয়েছি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আ ফ ম আল কিবরিয়া সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে তারা বেশ কিছু আইডি শনাক্ত করেছেন, যা থেকে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আইডি বন্ধের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযানও চালাচ্ছে।

সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোনো পরিস্থিতির মধ্যে একই ইস্যু ঘিরে গুজব ছড়ালে অনেকে তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করেন। চক্রান্তকারীরা সেই সুযোগই নিতে চায়। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে গুজব রটানো হয়- ধর্ষণের শিকার সনাতন সম্প্রদায়ের ১০ বছরের এক শিশু মারা গেছে। এমনকি শিশুটির সঙ্গে তার মাসি (খালা) এবং বোনও ধর্ষণের শিকার হয়ে সংকটাপন্ন।

এর পরই হাজীগঞ্জ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রুহিদাস বণিক এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘একটি কুচক্রীমহল হাজীগঞ্জে নারী ও শিশুর শ্নীলতাহানি ঘটেছে বলে একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছে। তবে এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ, জাতীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ বা বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের কোনো নেতা অবগত নন। অতএব সংশ্নিষ্ট সবাইকে এ ধরনের গুজব পরিহার করার জন্য অনুরোধ করছি।’

যেসব জেলায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুর উল্লেখযোগ্য। স্থানীয়দের ভাষ্য, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কুমিল্লার ঘটনার পর নাশকতার আশঙ্কা থাকলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক এলাকায় ছিল না বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া নাশকতাকারীদের ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্যেও ঘাটতি ছিল। কুমিল্লার ঘটনার রেশ ধরে বুধবার হাজীগঞ্জে চারজন নিহত হয়। বুধবার মধ্যরাত থেকে হাজীগঞ্জে ১৪৪ ধারা জারির পর এখনও তা বলবৎ রয়েছে। এরই মধ্যে গতকাল ফেসবুকে ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে প্রশাসন।

কুমিল্লায় মূল হোতারা অধরা: কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লার ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও এর মূল হোতা এখনও শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার হয়নি। এদিকে এসব ঘটনা নিয়ে ৩টি থানায় করা ৭টি মামলায় ৪৩ জন আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।

মণ্ডপের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে গতকাল নগরীর কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছে জেলা পূজা উদযাপন কমিটি। পাশাপাশি সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে সম্মিলিত নাগরিক উদ্যোগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে কুমিল্লার বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। পূজামণ্ডপে ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে শিগগিরই শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে ওই সূত্র দাবি করেছে। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আনওয়ারুল আজিম বলেন, তদন্ত চলছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে কয়েকজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আজ রোববার থেকে এ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ এলাকির দুটি মামলায় দুই শতাধিক আসামীর নামে মামলা করা হয়য়।

চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় মন্দিরে সহিংসতার ঘটনায় চকরিয়ায় একটি ও পেকুয়ায় তিনটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৫১ জনের নাম উল্লেখসহ এক হাজার ৩৫১ অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

সাহারবিল ইউনিয়নের শাহাপুরা জলদাসপাড়ায় পূজার জন্য নির্মিত তোরণ ভাঙচুর মামলায় ২০ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ৩০০ জনকে মামলায় আসামি করা হয়।

অপরদিকে পেকুয়া উপজেলা সদর, মগনামা ও শিলখালীর ঘটনায় তিনটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা বাহাদুর শাহ্‌ ও পেকুয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান মঞ্জুসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৫০০ জনকে। অপরদিকে,মামলায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে অন্যতম আসামি হচ্ছেন সাবেক শিবির নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান শহীদুল মোস্তফা চৌধুরী।

লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে মন্দিরে হামলা ও অগ্নিসংযোগকারীদের শনাক্তে পুলিশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া একে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে উপজেলার ১২টি মন্দিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রামগতি থানার ওসি মোহাম্মদ সোলাইমান জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে।