কানাডার মন্ট্রিয়লে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাবেশ

    0
    207

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২২নভেম্বর,সদেরা সুজন,সিবিএনএ কানাডা থেকেঃ যেকোন অজুহাতে কিংবা মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, মাধবপুর, ঝালকাঠী, নওগাঁসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপর অব্যাহত হামলা, মামলা, নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ, জবরদখল, বাড়িঘর, ব্যবসাবানিজ্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা দেবালয় ভাঙচুর, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, এমনকি হত্যার মত উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সহিংস কর্মকান্ডের প্রতিবাদে গতকাল রোববার, বিকাল ৫ টায় কানাডার মন্ট্রিয়লের ৬৭৬৭ কোট-দে-নেইজ্‌ কমিউনিটি সেন্টারে বাংলাদেশী কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে বাংলা একাডেমীর একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের গবেষক  তাজুল মোহাম্মদ এর সভাপতিত্বে এবং মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অবঃ) দিদার আতাউর হোসেনের সঞ্চালনায় এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।  ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ কর’ শিরোনামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাবেশে বিশিষ্ট কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ উপস্থিত থেকে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতাসীন থাকা স্বত্বেও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন কঠোর হস্তে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হওয়ায় গভীর দুঃখ ও হতাশা ব্যক্ত করেন। অনেক বক্তা সরকার ও প্রশাসনেরও সমালোচনায় মুখর হন।

    তাঁরা বলেন, সকল নাগরিকের জীবন, মান ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের সাংবিধানিক দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়। বক্তাদের মতে, আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানে সন্নিবেশিত চারটি মূলস্তম্ভের একটি “ধর্মনিরপেক্ষতা” ছিল। যা অতীতের সামরিক শাসকরা বেআইনিভাবে ৫ম এবং ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন ও বাতিল করে সংবিধানের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র পাল্টিয়ে “রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম” প্রতিস্থাপিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পথপরিক্রমায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি পুনরায় জীবনবাজি রেখে অবর্ণনীয় নির্যাতন, সন্ত্রাস মোকাবেলা করেছিল। হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীর ত্যাগ, তিতিক্ষা, জেল, জুলুম এবং জীবনের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। সংসদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় এবং ঊচ্চ আদালতের রায়ের ফলে সংবিধান সংশোধন করে পূর্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষতায় ফিরে যাওয়ার দুর্লভ সুযোগ হাতে এসেছিল।

    কিন্তু; অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আওয়ামী লীগ সরকার তাঁদের অঙ্গীকার ভঙ্গকরে ঊচ্চ আদালতের রায়কে উপেক্ষা করে “ধর্মনিরপেক্ষতা” পুনঃস্থাপন না করে সুকৌশলে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা না করে সংবিধানে একটি গোঁজামিল এর পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। এককালীন ভারতের উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক বেণিয়াদের “বিভেদ ও শাসন” নীতির ফলশ্রুতিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পত্তন ঘটে। যার পরিনতিতে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তাঁদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করে। ধর্মের নামে শাসন, শোষণ এবং বিভেদের রাজনীতির চীর পরিসমাপ্তি ঘটনোর লক্ষ্যে বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ চব্বিশ বৎসর আন্দোলন সংগ্রাম করেছিল। মানবিক মর্যাদা, সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ম, বর্ণ, নারীপুরুষ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করে ত্রিশলক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়ছিল এবং স্বাধীন সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

    বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার চীর কবর রচনার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই বলে বক্তারা অভিমত ব্যক্ত করেন। বক্তারা বলেন, ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার আচরণের বিষয়। তাই রাষ্ট্রকে কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি অনুরাগ, বিরাগ বা পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। “ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার” এই আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সভার শুরুতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় আহত, নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। মোমবাতির মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে সমবেত জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার পর সভাপতির সূচনা বক্তব্যের মধ্যদিয়ে সভার কার্যক্রম শুরু হয়। যেকোন ধরণের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতা বন্ধ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, ঘটনার সুষ্ঠু বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার এবং শাস্তিবিধান, সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষতা” পুনর্বহালের দাবীতে কানাডায় অবস্থিত হাইকমিশনারের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর সভায় উপস্থিত সকলের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাছাড়াও সমাজের গভীরে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ গ্রোথিত হয়েছে তা উৎপাটন ও গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক গণসংযোগ এবং শিক্ষামূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

    সভায়  শাহ মোস্তাইন বিল্লাহ, কন্ঠ শিল্পী মাহামুদুজ্জামান বাবু, ডঃ রুমানা নাহিদ সোবহান, ডঃ সৈয়দ জাহিদ হোসেন, ডঃ শিশির ভট্টাচার্য, জিয়াউল হক জিয়া, শ্যামল দত্ত,  শর্মিলা ধর, মন্ট্রিয়ল সিটি কাউন্সিলর মিঃ মারভিন রোট্র্যান্ড, শামসাদ রানা, ইতরাদ জুবেরী সেলিম, নারায়ন দে সঞ্জু, ফণীন্দ্র ভূষণ ভট্টাচার্য, অমলেন্দু ধর, ইয়াহিয়া আহমেদ, হামোম প্রমোদ সিনহা, এডওয়ার্ড কর্নোলিয়াস গোমেজ, অপরাহ্ন সুস্মিতো,  সদেরা সুজন, সুকান্ত বড়ুয়া, সরোজ দাস, রাজ্জাক হাওলাদার, গোপেন দেব, গোলাম মহিবুর রহমান, শহীদুল আলম, দিলীপ কর্মকার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।  মন্ট্রিয়ল ছাড়াও একই দিনে কানাডার রাজধানী অটোয়া এবং মেগা সিটি টরন্টোতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন, বিক্ষোভ এবং প্রদীপ প্রজ্জলন অনুষ্ঠিত হয়। এই উইন্টারের প্রথম তুষারপাত আর প্রচন্ড শৈত প্রবাহের মাঝেও প্রতিটি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসীরা উপস্থিত হয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ জানান।