কমলগঞ্জে ১৭৪ তম মণিপুরী মহারাসলীলা উৎসব পালিত

    0
    187

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৫নভেম্বর,মহারাসলীলা ঘুরে এসে,মো:জহিরুল ইসলামঃ  বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের  বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব “রাসলীলা” প্রতি বছর কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামন্ডপ এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

    বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সোমবার ১৪ নভেম্বের শুরু হয়। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম মহারাসলীলা। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা।

    মহারাসলীলায় শিশুদের   রাসনৃত্য
    মহারাসলীলায় শিশুদের রাসনৃত্য

    উল্লেখ্য,১৭৭৯সালে মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন তাই রাসোৎসব নামে পালন করছে মণিপুরী সম্প্রদায়করা। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাস নৃত্যে  অংশগ্রহন করতেন। এর ফলে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই  কোন রুপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা। তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে  ঘিরেই আজকের দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসবে  কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে।রাসলীলায় মনিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।

    ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মনিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাস লীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত  রয়েছে এখনোও। পৃথক পৃথক মন্ডেপে আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাসলীলার নৃত্যে রাতভর অংশগ্রহণ করে থাকে কিশোর- কিশোরীরা।

     এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসেন হাজারো নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ নানা শ্রেণী পেশার দর্শনার্থীরা। বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে সোমবার মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। এ উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।এই রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লাখো মানুষের ঢল নামে। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীরা ১৭৪ তম বার্ষিকী মহারাস উৎসব উদযাপন পালিত হয়।

    মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠবে আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে গোটা উৎসব অঙ্গন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের পূণ্যস্থাণ হিসাবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদাকাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো এই একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলনতীর্থ।মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।

     মাধবপুর মহারাসলীলা ঃ মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী (বিষ্ণুপ্রিয়া) মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭৪ তম শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো ১৪ নভেম্বর মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত রাখাল নৃত্য (গোষ্ঠলীলা), সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মতবিনিময় সভা। রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নট সংকীর্তন, রাত ১১ টা থেকে পরদিন মঙ্গলবার ঊষালগ্ন পর্যন্ত শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

    অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রী মো: আসাদুজ্জামান নুর এমপি। প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি। বিশেষ অতিথি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ও কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন সচিব ও পল্লী স য় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. মিহির কান্তি মজুমদার, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এর মহাপরিচালক পুন্যব্রত চৌধুরী, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. জামাল উদ্দিন আহমেদ, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান পিপিএম, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলাম, জেলা পরিষদ প্রশাসক মো. আজিজুর রহমান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল, সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপাধ্যক্ষ ডা. নন্দকিশোর সিংহ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম, মোসাদ্দেক আহমেদ মানিক, মণিপুরী সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি প্রতাপ চন্দ্র সিংহ।

    মণিপুরী সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু মীতৈও বিষ্ণুপিয়া মণিপুরীদের আয়োজনে কমলগঞ্জের মাধবপুরের রাসোৎসবের জন্যে তৈরী মন্ডপগুলো ঐ একটি রাত্রির জন্যে হয়ে উঠে হাজারো মানুষের মিলন কেন্দ্র। সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত শিশু নৃত্য শিল্পীদের সুনিপুণ অভিনয় যেন মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। রাসোৎসবের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবে দর্শনার্থীর সমাগম। তুমুল হৈচৈ, আনন্দ উৎসাহ ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রী কৃষ্ণ ও তার সখি রাধার লীলাকে ঘিরে এই একটি দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জন জীবনে ।