এই ধর্ষকদের বিচার হবে তো:আবছার তৈয়বী

    0
    220

    বহুল আলোচিত-সমালোচিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী দু’টি বিষয় আমাকে দুঃখে কাতর করেছে এবং শোকে পাথর করেছে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণও হয়েছে প্রচুর। এর একটি নির্বাচন চলাকালীন সময়ে বিনা অপরাধে খোদ ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দীতে শাসকদলের সন্ত্রাসী কর্তৃক আলোকিত সেনানী প্রিয়ভাই আবু সাদেককে হত্যা এবং অপরটি নোয়াখালীর সুবর্ণচরে শাসক দলের অন্য সন্ত্রাসী ১০/১২ জন গুণ্ডা কর্তৃক ৪ সন্তানের জননী পারুল বেগমের ধর্ষন ও অমানুষিক নির্যাতন। এ দু’টি ঘটনায় আমি এতোই স্তম্ভিত হয়েছি যে, এ কয়দিনে এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি একটি শব্দও লিখতে পারিনি। কিন্তু আমার পাঠক/পাঠিকারা উপর্যুপরি অনুরোধ করেছেন- এই দু’টি বিষয়ে লেখার জন্য। আমার কয়েকজন পাঠক পারুল বেগমের অসহ্য যন্ত্রণাকাতর ও নির্যাতনের ভিডিও এবং স্থির ছবি সম্বলিত কয়েকটি পোস্টে প্রকাশ্যে মেনশন করেও এ বিষয়ে আমাকে লিখতে অনুরোধ করেছেন। তাঁদের ধারণা, যেন আমি লিখলেই এসব বর্বর দুষ্কর্মের বিচার হবে ! কিন্তু আমি এমনটি মনে করি না।
    ওপরে বর্ণিত দু’টি ঘটনাই প্রকাশ্য ফৌজদারি অপরাধ। এই প্রকাশ্য ফৌজদারি অপরাধের জন্য আবার লিখতে হবে কেন? মানববন্ধন ও আন্দোলনই বা করতে হবে কেন? আইনের শাসন থাকলে এসব প্রকাশ্য ফৌজদারি অপরাধের বিচার তো এমনিতেই হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এই সব জঘন্য নির্মম ফৌজদারি অপরাধের জন্যও লিখতে হয় এবং বিচারও চাইতে হয়! এর কারণ হলো, আমাদের প্রশাসন ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ করে না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন’ করতেই দেখা যায়। এই সব ঘৃণ্য অপরাধের সাথে যদি রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ কিংবা ক্ষমতাসীন দলের গুণ্ডা-পান্ডারা জড়িত থাকে, তবে অপরাধ যতোই জঘন্য ও নির্মম হোক না কেন, সেক্ষেত্রে সহজেই প্রশাসন তড়িৎ পদক্ষেপ নেয় না। জনদাবির প্রেক্ষিতে অনেক দেরিতে পদক্ষেপ নিলেও পুলিশের দায়সারা প্রতিবেদনের কারণে অপরাধীরা অনায়সেই পার পেয়ে যায়। এ রকম বহু নজির আমাদের দেশে আছে।
    ‘আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে’ এবং ‘আইন সকলের জন্যই সমান’ এই দু’টি আপ্তবাক্য আইনের বইয়ে লেখা থাকলেও বাস্তবে যে এর প্রয়োগ নেই- তা আমরা সকলেই কমবেশি জানি। কিন্তু আমরা যেটা আরো বেশি জানি, সেটা হলো- ‘আইন সব সময় ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে, ক্ষমতাসীনদের রক্ষায় এবং ক্ষমতাসীনদের সাথেই চলে, পাশে থাকে।’ এটি আইনের শাসনের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং খোদ আইন রক্ষাকারী ও প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কর্তৃক দেশের জনগণের ওপর চরম জুলুম। পরিতাপের বিষয় হলো এই জুলুমটিকে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কখনোই জুলুম মনে করে না। আর এটাই হচ্ছে ‘সবচেয়ে বড়ো জুলুম’।
    বিশ্বাস করুন- এসব ঘৃণ্য ফৌজদারি অপরাধকে ছোট করে দেখা বা অপরাধকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য না করার চেয়ে বড়ো জুলুম আর হতে পারে না। কারণ, যে কোন অপরাধ সংঘটিত হয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি দ্বারা ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির ওপর। কিন্তু সেই অপরাধকে ছোট করে দেখলে বা অপরাধই মনে না করলে তা পুরো জনগোষ্ঠির প্রতি জুলুম হিসেবে গণ্য হয় এবং এক্ষেত্রে সুবিচারের পথ রুদ্ধ হয়। আবার কোন অপরাধের বিচার না হলে এবং রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক সুবিচারের দ্বার রুদ্ধ হলে সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকার হয় জালিম আর সেই রাষ্ট্রের জনগণ হয় মজলুম। আবার মজলুমরা যদি মনে করে এটাই তাদের নিয়তি, যার কোন প্রতিকার নেই এবং অপরাধের বিচার পাওয়া যাবে না- তাই চুপচাপ সহ্য করে যাওয়াই শ্রেয়, সেক্ষেত্রে পুরো জনপদের অধিবাসীদেরকেই ‘জালিম’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
    আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে খোদ রাষ্ট্র ও সরকার কর্তৃক তার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় জুলুম হতে আমরা বারবার দেখেছি। শুধু এই ধর্ষন ও নারীর প্রতি সহিংস আচরণ এবং নির্বাচন পরবর্তী নিপীড়ন আমরা বিএনপি-জামাতের আমলে পূর্ণিমা রাণীর বেলায় যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি- দিনাজপুরের ইয়াসমিনের বেলায়ও। আরো দেখেছি- কুমিল্লার তনুর বেলায়, সরকারি দলের গুণ্ডা ‘তুফান’ তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড বগুড়ার অসহায় মা-মেয়ের বেলায় এবং এখন দেখছি সুবর্ণচরের পারুল বেগমের বেলায়। অতি তুচ্ছ কারণে কিংবা অকারণে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ‘গ্যাংগ রেপ’ কিন্তু কোনকালেই থেমে থাকেনি। এর মধ্যে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কোন কোনটি বিচারের মুখ দেখলেও অধিকাংশই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। সেইসাথে কোন কোন ভিকটিম পরিবার উল্টো নানাভাবে হয়রানির শিকার এবং সর্বশান্ত হয়েছে। কিন্তু দু’য়েকটি বাদে প্রায় সব ক’টি অপরাধের হোতারা ক্ষমতার দাপট, অর্থের জোর, পেশিশক্তির ব্যবহার এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় পার পেয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, আর এটিই হচ্ছে- সবচেয়ে বড়ো জুলুম।
    আমার কাছে সবচাইতে মারাত্মক পীড়াদায়ক যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো- এসব জঘন্য, ঘৃণ্য ও নির্মম অপরাধকে দলীয় দৃষ্টিকোণে দেখাটা। এবারের নির্বাচনোত্তর পারুল বেগমের ক্ষেত্রে যা হয়েছে- তা কিন্তু কোনভাবেই পূর্ণিমা রাণীর চেয়ে কম নয়। কিন্তু অবাক করা ব্যপার হলো- আমাদের দেশের মানবাধিকার সংগঠন, নারী সংগঠন, আইন ও শালিস কেন্দ্র এবং সুশীল সমাজের মুখচেনা লোকগুলো যারা পূর্ণিমা রাণীর বেলায় সোচ্চার ছিলেন, তারা পারুল বেগমের ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ! যারা সে সময় বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এবং মানববন্ধন করে খবরের কাগজের পাতা ভরেছেন এবং মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন- তারা কোন এক অজ্ঞাত কারণে লুকিয়ে আছেন! একটি সভ্য সমাজে কেন এমনটি হবে? কেন অপরাধী ও ভিকটিমের ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ধর্মবিশ্বাসকে বড়ো বা ছোট করে দেখা হবে? কবে বাংলাদেশের আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা হবে? কবে প্রশাসন নিজের গরজে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে এ সব ঘৃণ্য ও নির্মম অপরাধীর বিরুদ্ধে পক্ষপাতমুক্ত হয়ে ব্যবস্থা নেবে? কবে আমাদের সরকার ও প্রশাসন বাস্তবিক ভাবেই দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করতে শিখবে? কবে আমরা সভ্য জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখবো? আর কতোকাল বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতে কাঁদবে? আমি জানি না এবং বলতে পারি না, আপনারা কি জানেন এবং বলতে পারেন?
    তারিখ:আবছার তৈয়বী কবি ও লেখক।০৩ জানুয়ারি, ২০১৯ খৃ. আবুধাবি, ইউ.এ.ই।