ঈদে ঘুরে আসুন সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের রাতারগুল

    0
    265

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৬জুন,জহিরুল ইসলাম,রাতারগুল থেকে ফিরেঃ বাংলাদেশের এক মাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল। এর ইংরেজি নাম ভিন্ন হলে ও দেশ জুড়ে পর্যটকদের কাছে  রাতার গুল নামেই পরিচিত।

    জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যেও নিরাপদ জায়গা এটি। জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্টের  আয়তন প্রায় ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর এই বনকে সরকার ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে।

    এই ঈদে ঘুরে আসতে পারেন সিলেট শহরের গোয়াইঘাট উপজেলার রাতারগুলে। সিলেট শহর থেকে রাতার গুলের দূরত্ব প্রায়ই ২৬ কিলোমিটার। রাতারগুলে ঘোরতে হলে রাতারগুল বন বিভাগ থেকে আপনাকে আগে অনুমতি নিতে হবে আপনার নিরাপত্তার স্বার্থে ।

    পর্যবেক্ষণ টাওয়ার:: রাতারগুলে রযেছে সুউচ্চ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এই টাওয়ার থেকে আপনি দেখতে পারবেন রাতারগুলে মনোমুগ্ধকর বনের পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন । তখন আপনার মনে হবে কোন গাছের পাহাড়ের চূড়াই দাঁড়িয়ে আছেন । রাতারগুল থেকে আপনাকে সন্ধ্যা নামার আগেই বের হতে হবে ।

    বর্ষাকালে রাতারগুলে বা জলজ বনে অথৈ জল থাকে প্রায়  চার মাস ধরে। তারপর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে-চলা পথ।আর তখন পানির আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বিলগুলোতে। সেখানেই আশ্রয় নেয় জলজ প্রাণীকুল।

    নামকরণ: সিলেটের স্থানীয ভাষায় মুর্তা বা পাটি গাছ “রাতা গাছ” নামে পরিচিত। সেই রাতা গাছের নামনুসারে এ বনের নাম করণ করা হয় রাতারগুল। সিলেট জেলার গোয়াইন ঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে, গুয়াই নদীর দক্ষিণে এই বনের অবস্থান। বনের দক্ষিণ দিকে রয়েছে আবার দুটি হাওর  শিমুল বিল হাওর ও নেওয়া বিল হাওর।

    জলবায়ূ :: সিলেটের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ক্রান্তীয় জলবায়ূর এই বনটিতে প্রতিবছর ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। সিলেট আবহাওয়া কেন্দ্রের তথ্যমতে এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিতের পরিমাণ ৪১৬২ মিলিমিটার। জুলাই মাসে আর্দ্র যখন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১২৫০ মিলিমিটার, অন্যদিকে বৃষ্টিপাত সব চাইতে শুষ্ক মাসটি হল ডিসেম্বর। মে এবং অক্টোবরে গড় তাপমাত্রা গিয়ে দাড়াঁয় ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে,আবার জানুয়ারিতে এই তাপমাত্রা নেমে আসে ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ডিসেম্বর মাসে এখানকার আপেক্ষিক আর্দ্রতা পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ, যা জুলাই-আগষ্টে ৯০ শতাংশেরও বেশি ।

    উদ্ভিদবৈচিত্র: এই বনের একটি বৈশিষ্ট্যহল মিঠাপানি , জলাবনটিতে উদ্ভিদের দু’টো স্তর পরিলক্ষিত হয় উপরের স্তর  মূলত বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে গঠিত যেখানে নিচের স্তর দুটিতে ঘন পাটিপাতার (মুর্তা) আধিক্য বিদ্যমান।বনের উদ্ভিদের চাঁদেও আলো সর্বোচ্চ ১৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত।এছাড়াও অরণ্যের ৮০ শতাংশ এলাকাই উদ্ভিদের আচ্ছাদনে আবৃত।  এ বনে ৭০ থেকে ৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।

    এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তিতে বাংলাদেশ বন বিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এছাড়াও জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ ,পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটিজাম ও বট গাছ।

    প্রাণীবৈচিত্র্য: জলমগ্ন বলে এই বনে সাঁপের আবাস বেশি, আছে জোঁকও, শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ,পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙ্গা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁসসহ প্রচুর পরিযায়ী পাখি, বিশালাকায় শকুনও আছে । টেংরা, খলিশা, রিটা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালবাউশ, রুইসহ বিভিন্ন জাতের মাছ আছে ।

    জলে নিম্নাংঙ্গ ডুব দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে  থাকা বনের গাছগুলো দেখতে বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এখানে ভিড় করেন পর্যটকরা।বনের ভিতর ভ্রমণ করতে দরকার হয় নৌকার, তবে সেগুলো হতে হয় ডিঙি নৌকা ডিঙিতে চড়ে বনের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ সুধা।

    ঢাকা ও টচ্রগ্রামে  থেকে রাতারগুল কীভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে সিলেট শহরে। সড়ক, রেল ও আকাশ পথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট আসতে পারেন। চট্রগ্রাম থেকেও সিলেটে আসা যায়। ঢাকা থেকে গ্রীন লাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, সৌদিয়া পরিবহনের এসি বাস যায় সিলেটে। ভাড়া ৮০০-১০০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার ফকিরাপুল, কমলাপুর, সায়দাবাদ জায়গা থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া, মামুন পরিবহন, সিলকম পরিবহন ইত্যাদি সংস্থার নন-এসি বাসও সিলেটে যায়। ভাড়া ৩০০-৫০০ টাকা।

    ঢাকা থেকে আপনি আসতে পারেন ট্রেন যোগে। ঢাকার কমলাপুর থেকে  মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সিলেটের উদ্দেশ্যে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায়  আন্তরনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ৩০০ টাকা-৬৯৮ টাকা। এ ছাড়া চট্রগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টায় যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টায় উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৯০-৪৬৫ টাকা।

    সিলেট শহর থেকে বিভিন্ন পথে রাতারগুল যাওয়া সম্ভব। তবে পর্যটকরা দুটি পথ ব্যবহার করতে পারেন। প্রথম সিলেট-জাফলংয়ের গাড়িতে চড়ে নামতে হবে সারিঘাট। ভাড়া ৪০-৫০ টাকা। সেখান থেকে সিএনজি চালিত বেবি টেক্সিতে চড়ে গোয়াইনঘাট বাজার। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে যেতে হবে রাতারগুল।১০-১২ জনের উপযোগী সারাদিনের জন্য একটি নৌকার ভাড়া পড়বে ৮০০-১২০০ টাকা।

    সারি নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে এ পথটি অনুসরণ করতে পারেন। তবে খরচ আর সময়, দুটোই বেশি লাগবে এ পথে। রাতারগুলের সবচেয়ে সহজ আর সুন্দর পথটি হলো সিলেট শহরের পার্শ্ববর্তী খাদিম চা বাগান আর খাদিমনগর জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। খুব অল্প সময়েই এ পথ ধরে রাতারগুল পৌঁছানো সম্ভব। এ পথে সিএনজি অটোরিকশা কিংবা জিপ নিয়ে আসতে হবে শ্রীঙ্গি ব্রিজ। সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যেই বন ঘুরে ফিরে আসা সম্ভব। সারা দিনের জন্য একটি সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া পড়বে ১২০০-১৫০০ টাকা। আর সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে লোকাল সিএনজিতে গেলে জন প্রতি ভাড়া পড়বে ১০০ টাকা। শ্রীঙ্গি ব্রিজ থেকে রাগারগুল জঙ্গলে ঢুকতে হবে জেলেদের ছোট নৌকায়। একটি নৌকায় ৪-৬ জন ঘুরে বেড়ানো সম্ভব। ভাড়া লাগবে ৪০০-৮০০ টাকা। রাতারগুলে যেতে যে পথই অনুসরণ করুন না কেন বনে ঢুকতে লাগবে জেলেদের ছোট নৌকা।

    রাতারগুলে বনের ভিতরে নৌকা নিয়ে যাবেন মনে হবে আপনি যেন কোন এক গহীন পাহাড়ের কুপের ভিতরে ঢুকছেন। বনের ভিতরে শুধু পানি আর পানি। মনোরম গাছগাছালির ছায়া বনের সাথে পানি  ও প্রকৃতির অপরুপ মিতালীতে পাখিরা যেন এক বন্ধন তৈরি করে রেখেছে। যা নিজের চোখে না দেখে  বিশ্বাসের সুযোগ নেই।