ঈদের আগে এই জয় যেন জাতির জন্য ঈদ উপহার

    0
    271

    মাশরাফি বিন মর্তুজার শেষ বিশ্বকাপের শুরুটা রাঙিয়ে তুলল টাইগাররা। প্রোটিয়া বধে বিশ্বকাপ শুরু করল। তাতে ঈদের আগে এই জয়ে জাতির ঈদ উপহারও যেন মিলে গেল। বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১ রানে হারিয়ে দিয়ে শুভ সূচনা করল মাশরাফিবাহিনী। ব্যাট হাতে মুশফিকুর রহীমের ৭৮, টানা চার বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করা সাকিব আল হাসানের ৭৫ রানের সঙ্গে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অপরাজিত ৪৬ রানের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের পর বল হাতে ৩ উইকেট নেয়া মুস্তাফিজুর রহমান ও ২ উইকেট নেয়া সাইফউদ্দিনের দুর্দান্ত বোলিংয়ে এই জয় মিলল।

    লন্ডনে দ্য ওভাল ক্রিকেট মাঠে টস হেরে আগে ব্যাটিং করে মুশফিক, সাকিব, মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে সৌম্য সরকারের ৪২, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের ২৬ ও মোহাম্মদ মিঠুনের ২১ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩৩০ রান করল বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। শুধু তাই নয়, ব্যাটসম্যানদের ঐক্যবদ্ধ নৈপুণ্য নিজেদের ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্কোরটিও করল বাংলাদেশ। এন্ডি পেহলুকওয়ায়ো, ইমরান তাহির ও ক্রিস মরিসরা ২টি করে উইকেট নিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের রুখতে পারেননি। বিশেষ করে তৃতীয় উইকেটে সাকিব-মুশফিক মিলে যে ১৪২ রানের জুটি গড়েছেন তা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে কোন উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ডও হয়ে থাকল। সাকিব-মুশফিকের জুটির পর শেষে গিয়ে ষষ্ঠ উইকেটে যে মাহমুদুল্লাহ ও মোসাদ্দেক মিলে ৬৬ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়লেন, এতদূর যাওয়াতে এই জুটিই বিশেষ ভূমিকা রাখল। এত বড় রান তাড়া করতে গিয়ে অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিস (৬২) ছাড়া আর কোন ব্যাটসম্যান হাফ সেঞ্চুরির দেখা পাননি। আর তাই ৮ উইকেট হারিয়ে ৫০ ওভারে ৩০৯ রান করে হারে দক্ষিণ আফ্রিকা। টানা দ্বিতীয় হার হয় দক্ষিণ আফ্রিকার। রেকর্ডের ম্যাচে এক উইকেট নিয়ে সাকিব আবার ২৫০ উইকেট ও ৫ হাজার রান করার অনন্য রেকর্ডও গড়েন।

    বিশ্বকাপে বাজনা বেজেছে। সব ম্যাচে ৩০০ রানের ওপরে হবে। এমনকি ৩৫০, ৪০০ রানও অনায়াসে হতে পারে। এখানেই যত ভয় ছিল। বাংলাদেশ যদি এত বড় রানের চাপে পড়ে যায় তখন কী করবে? বাংলাদেশ চাপে পড়বে কি, উল্টো দক্ষিণ আফ্রিকাকেই চাপে ফেলে দিল। রবিবার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার আগেই চোট সমস্যায় জর্জরিত ছিল দল। কিন্তু ম্যাচের আগে সব চোটকে দূর আকাশে ঠেলে দিয়ে ঠিকই সেরা একাদশ খেলতে নেমে গেল। অস্বস্তি দূর করে এমনই স্বস্তি ফিরল, তার ছোঁয়া বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংসেও লেগে গেল। এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১৫ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ৩২৯ রান করেছিল বাংলাদেশ। সেটিই বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্কোর ছিল। আর বিশ্বকাপে ২০১৫ সালে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৮ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ৪ উইকেটে ৩২২ রান করে ৬ উইকেটে জিতেছিল বাংলাদেশ। সেটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ছিল। এবার দুই রানকেই টপকে নতুন রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ। এই রেকর্ডের দিনে জয়ের আনন্দেও ভাসল বাংলাদেশ।

    দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং দেখেই মনে হচ্ছিল কাঁপছিল। এত বিশাল রান টপকে জিততে হবে, তাতেই যেন তাদের হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচে হারের পর আরেকটি ম্যাচ হারতো দক্ষিণ আফ্রিকাকে শুরুতেই বিপদে ফেলে দিবে! এমন ভাবনা থেকে এতটাই সাবধানী হয়ে খেলতে থাকেন দুই ওপেনার কুইনটন ডি কক ও এইডেন মার্করাম ১০তম ওভারে গিয়ে ৫০ রান স্কোরবোর্ডে যোগ করেন। এই সময়ই আবার ছটফট করতে থাকা ডি কক (২৩) ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে রানআউট হয়ে যান। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে কককে স্টাম্পিং করে আউট করতে পারেননি মুশফিক। মুশফিকের হাত থেকে বল ফসকে একটু দূরে যায়। কক বল না দেখে রান নেবেন কিনা তাই বুঝতে পারেননি। এমন অবস্থায় দ্রুতই বল কুড়িয়ে নিয়ে স্টাম্পে আঘাত করে বেল ফেলে দেন মুশফিক। কক আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন। এই আউটেই যেন দক্ষিণ আফ্রিকার কম্পন বোঝা হয়ে যায়। কিন্তু পেশাদার দল। পেশাদার ক্রিকেটার। তারা জানে কিভাবে বিপদ দƒর করতে হয়। মার্করামের সঙ্গে অধিনায়ক প্লেসিস মিলে এমনই শান্তভাবে এগিয়ে যেতে থাকলেন ১৯ ওভারে দলকে ১০০ রানেও নিয়ে গেলেন।

    দুইজন মিলে ৫৩ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন। এমন সময়ই পঞ্চম ওভার করতে এসে স্পিন জাদু দেখিয়ে দেন সাকিব। মার্করামকে (৪৫) বোল্ড করে দেন। এই উইকেট পেয়ে সবচেয়ে কম ১৯৯ ম্যাচ খেলে ২৫০ উইকেট ও ৫০০০ রান করার রেকর্ড গড়লেন সাকিব। তিনি যে কেন বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার ‘ব্রেক থ্রু’ এনে দিয়ে তা বুঝিয়ে দেন। শুরু থেকেই পেসের সঙ্গে স্পিনটাই বেশি কাজে লাগানো হয়। তাতে রানের গতিতে লাগাম টেনে রাখা যায়। চাপ তৈরিও হতে থাকে। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ‘সুপার এইটে’ দক্ষিণ আফ্রিকাকে গায়ানায় এভাবেই চাপে ফেলে ৬৭ রানে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই স্মৃতি যেন ততক্ষণে তাজা হতে থাকে।

    আবার সঙ্গে খানিক আশঙ্কাও থাকে। ডু প্লেসিসের মতো ব্যাটসম্যান যে উইকেটে থাকেন। তিনি আবার ধীরে ধীরে হাফ সেঞ্চুরিও করে ফেলেন। তবে প্লেসিসকে ৬২ রানের বেশি করতে দেননি মিরাজ। বোল্ড করে দেন। দলের ১৪৭ রানের সময় প্লেসিস আউটের পর যেন স্বস্তি ফিরে। তারপরও সাবধান থাকেন টাইগাররা। একটি বড় জুটিই যে সব ধ্বংস করে দিতে পারে।

    হাশিম আমলা খেললে ডেভিড মিলার হয়তো একাদশে সুযোগ পেতেন না। মিলারকে বলা হয় ‘কিলার মিলার’। মিলার উইকেটে থাকেন। ফর্মহীনতায় ভুগছেন। কিন্তু যদি জেগে ওঠেন। যদি তার মরণফাঁদে পড়ে বাংলাদেশ? সেই ভয়ও থাকে। মিলার ও ভ্যান ডের ডুসেন মিলে এগিয়েও যেতে থাকেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার ৪৩৪ রানের টার্গেটে জেতার রেকর্ডও আছে। তবে বিশ্বকাপে ৩০০ রানের বেশি টার্গেট নিয়ে জিততে পারেনি প্রোটিয়ারা। তাতে স্বস্তি থাকে। কিন্তু অস্বস্তিও মিলতে থাকে। মিলার কিংবা ডুসেনকে যে আউটই করা যাচ্ছিল না। নিজের পঞ্চম ওভারে ফিরে মিলারকে আউট করার সুযোগও তৈরি করেন মুস্তাফিজুর রহমান। কিন্তু সঠিক স্থানে না থাকায় ৩১ রানে থাকা মিলারের ক্যাচটি থার্ড ম্যানে ধরতে পারেননি মাহমুদুল্লাহ। মাশরাফির চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ দেখা যায়। এমন মুহূর্তে যেন বাংলাদেশ ফিল্ডারদের মধ্যেও একটু ঘাটতি দেখা যেতে থাকে। ৩৫ ওভারে ২০০ রান করে ফেলায় প্রোটিয়ার ব্যাটসম্যানরাও যেন একটু রিদমে ফিরেন। মিলার ও ডুসেন মিলে ৫০ রানের জুটিও গড়ে ফেলেন।

    মিলার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকেন। এমন মুহূর্তেই মুস্তাফিজ নিজের চমক জাগিয়ে তুলেন। মিলারকে (৩৮) আউট করে দেন। দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে তখন আবারও আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া লাগে। ডুসেনকেও একবার রান আউটের সুযোগ মিলে। কিন্তু করা যায়নি। মহাচাপে থাকে প্রোটিয়ারা। ৩৮তম ওভারের প্রথম বলে মুস্তাফিজ ডুমিনিকে এলবিডব্লিউ করেন। আম্পায়ার পক্ষেও সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান ডুমিনি। একই ওভারের চতুর্থ ও পঞ্চম বলে গিয়ে ডুসেন যে মুস্তাফিজের দুই বলে ছক্কা, চার হাঁকান, রানের গতি যেন সেখান থেকেই বাড়তে শুরু করে দেয়।

    সাইফউদ্দিন নিজের চতুর্থ ওভার করতে এসে এমনই ঝটকা দেন, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হিলিয়ে দেন। ডুসেনকে (৪১) বোল্ড করার সঙ্গে মেডেন ওভারও করেন। আবার যেন চাপে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। ডুমিনি-ডুসেন মিলে ভোগাতে থাকেন। সাইফউদ্দিন সেরা ওভার করে তা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেন। এই জুটি ভাঙ্গা খুব জরুরী ছিল। সেই জরুরী কাজটি করে দেন সাইফউদ্দিন। নিজের পরের ওভারে আবার পেহলুকওয়ায়োকেও (৮) সাজঘরে ফিরিয়ে আসল কাজটিই করে দেন এ পেস অলরাউন্ডার। ২৫২ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা হারের খপ্পরেও যেন পড়ে যায়।

    একটা সময় গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার জিততে ৩০ বলে ৬৩ রান লাগে। হাতে থাকে ৪ উইকেট। উইকেট ফেলতে পারলেই জেতা খুব সহজেই সম্ভব। মুস্তাফিজ বল করতে এসে ক্রিস মরিসকে (১০) আউট করে দেন। ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জয় পেতে যেন অপেক্ষা তৈরি হয়ে যায়। মুস্তাফিজ যখন ডুমিনিকেও (৪৫) বোল্ড করে দেন তখন থেকেই যেন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ রব ওঠে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন দেশবাসী। ২৮৭ রানে ডুমিনি আউটের পর শেষ পর্যন্ত ৩০৯ রানের বেশি করতে পারল না দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে যে কম্পন তৈরি করবে এবার তার আলামতও দিয়ে দিল।

    ম্যাচের শুরুটা হয় দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিসের টস জেতা দিয়ে। টস জিতে ফিল্ডিং নেন। তিনি মনে করেছিলেন উইকেট যতই ব্যাটিংনির্ভর হোক; পেস, গতি আর বাউন্সের সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের খাদের কিনারায় ফেলবেন। শর্ট বলেই কাত করে দেবেন। বাংলাদেশকে অল্পতে বেঁধে ফেলবেন। পরিকল্পনা কিছুটা পথ পর্যন্ত কাজেও দেয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী তা বুমেরাং হয়। শুরুতেই দ্রুত রান তুলে ফেলে বাংলাদেশ। মাঝপথে একটু তাতে বিঘ্ন ঘটে। আবার মাঝ থেকে শেষ পর্যন্ত রানের গতি সচল থাকে। তাতেই ৩০০ ছাড়ানো রান স্কোরবোর্ডে অনায়াসে যোগ হয়ে যায়।

    দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলতে নামার আগে চরম অস্বস্তি যে ছিল তাও দূর হয়ে যায়। তামিম ইকবাল কব্জির পুরো না সারতেই দলের প্রয়োজনে ব্যাট হাতে নেমে পড়েন। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনও পিঠের ব্যথা দূর করে খেলেন। ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে জেতা ম্যাচে যে একাদশ নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ, সেখান থেকে শুধু একজনকে বদল করে একাদশ সাজায় মাশরাফিবাহিনী। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সাব্বির রহমান রুম্মনকে একাদশের বাইরে রেখে সাকিব আল হাসানকে ঢুকানো হয়।

    ক্রিকেটারদের চোট বিপদেই ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশ দলকে। শঙ্কায় ফেলে দিয়েছিল। সেরা একাদশ গঠন করাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। অবশেষে সব বিপদ, শঙ্কা দূর করে সেরা একাদশই গঠন হলো। টস হওয়ার পর খেলাও শুরু হলো যথাসময়েই (বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটায়)। বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা সবুজ-লালে ঘেরা জার্সি পড়েও খেলতে নামে।

    শুরুটাও হয় দুর্দান্ত। দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার অসাধারণ ব্যাটিং করতে থাকেন। তামিম যে কব্জিতে ব্যথা পেয়ে মুহূর্তেই তা সারিয়ে ব্যাটিং করতে নামেন। কি স্বাচ্ছন্দ্যভাবে ব্যাটিং করছিলেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন। সৌম্য সুযোগ বুঝেই বাউন্ডারি হাঁকাতে থাকেন। দেখতে দেখতে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডেও ৬০ রান যোগ হয়ে যায়। ৮ ওভারেই এই রান যোগ হয়। কিন্তু এমন মুহূর্তে তামিম যেন খেই হারিয়ে ফেলেন। অস্বস্তি যেন তাকে ঘিরে ধরে। এতটা সুন্দর শুরুর পর আর এগিয়ে যেতে পারলেন না তামিম। পেহলুকওয়ায়োর চৌকস বোলিংয়ের সামনে নত হতে হয় তামিমকে (১৬)। যেমনটি মনে করা হয়েছিল, ব্যথা নিয়ে আর কতদূর এগিয়ে যেতে পারবেন তামিম। তাই হলো।

    তামিম আউট হতেই বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ব্যাট হাতে নামলেন। ২০১১, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর তৃতীয় বিশ্বকাপ বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হিসেবে খেলতে নামলেন সাকিব। যা আগে কোন ক্রিকেটার এমন কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। সাকিব তা করে দেখালেন। সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৫ রান করতেই সব সংস্করণের ক্রিকেট মিলিয়ে ১১ হাজার রানও করলেন সাকিব।

    সৌম্যের সঙ্গে সাকিবও পথ চলাটা মসৃণ করে নিচ্ছিলেন। কিন্তু এবার সৌম্যই উইকেটে আর টিকে থাকতে পারলেন না। দক্ষিণ আফ্রিকা বোলাররা একের পর এক শর্ট বল করবেন। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতায় আঘাত করবেন তা জানাই ছিল। কিন্তু তারপরও একের পর এক সাফল্য মিলতে থাকে প্রোটিয়া বোলারদের। এবার ক্রিস মরিস শর্ট বলে সৌম্যকে (৪২) সাজঘরের পথ দেখান। দলের ৭৫ রানের সময় যে পথে সৌম্য চলতে থাকেন, বাংলাদেশ দল বিপত্তি দেখতে থাকে।

    শুরুটা যেভাবে হয়, সেই গতি কমে যেতে থাকে। শুরুটা দ্রুত হলেও ১০০ রান হতে ১৬ ওভার লাগে। দল চাপে পড়ে থাকে। সেই চাপ থেকে দলকে মুক্ত করতে সাকিব ও মুশফিকুর রহীম হাল ধরেন। ২৪তম ওভারে গিয়ে দলকে ১৫০ রানেও নিয়ে যান। সাকিব ও মুশফিক মিলে হাফ সেঞ্চুরি করেন এবং দলকে শতরানের জুটিও ততক্ষণে উপহার দিয়ে ফেলেন। দুইজন মিলে এমনভাবে ব্যাটিং করতে থাকেন, প্রোটিয়া বোলারদের পাত্তাই দেন না। মনে হতে থাকে ৩৫০ রান করাও কোন ব্যাপার না!

    দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কখনই বাংলাদেশ ৩০০ রান বা তারবেশি রান স্কোরবোর্ডে যোগ করতে পারেনি। ২০১৭ সালে কিম্বার্লিতে ২৭৮ রান যে করেছিল বাংলাদেশ, সেটিই প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে রবিবারের ম্যাচের আগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্কোর ছিল। সাকিব-মুশফিক মিলে এমন খেলাই খেলছিলেন, আউট করার মতো কোন সুযোগই দিচ্ছিলেন না। কোন ঝুঁকিতে না গিয়ে স্কোরবোর্ডে রান তুলছিলেন। সেটিও আবার গতি বজায় রেখেই।

    বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে দুইজন ব্যাটসম্যানই পাঁচ শ’ রানের মালিক ছিলেন। সাকিব ও মুশফিক। এই দুইজনই দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভোগাতে থাকেন। সাকিব ও মুশফিক দুইজনই সমান তালে এগিয়ে যেতে থাকেন। দুইজন সেঞ্চুরির কাছে চলে যেতে থাকেন। কিন্তু সাকিব সেই সেঞ্চুরির দেখা পেলেন না।

    দলের ২১৭ রান হতেই ৭৫ রান করা সাকিব আউট হয়ে যান। ইমরান তাহিরের ঘূর্ণির ফাঁদে পড়ে বোল্ড হয়ে যান। তাতে সাকিব-মুশফিকের ১৪২ রানের রেকর্ড জুটি ভেঙ্গে যায়। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা জুটি হন সাকিব-মুশফিক। কিন্তু আর দূরে এগিয়ে যেতে পারেননি সাকিব। তবে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ থেকে টানা চার বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে খেলতে নেমেই হাফ সেঞ্চুরি করা দেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান এখন সাকিব। এবার মোহাম্মদ মিঠুনকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন মুশফিক। মিঠুনের যেন কি হয়েছে। ব্যাটিং ঝলক আর দেখা যাচ্ছে না। ২১ রান করে তাহিরের বলে বোল্ড হয়ে মিঠুনও সাজঘরে ফেরেন। ততক্ষণে দল আড়াই শ’ রানের কাছে চলে যায়।

    মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ মিলে এবার ইনিংস শেষ করে আসবেন মনে করা হলো। মুশফিক আউট হয়ে গেলেন। সাকিব না পারলেও মুশফিক সেঞ্চুরি করবেন ধারণা করা হলো। কিন্তু মুশফিকও পারলেন না। পেহলুকওয়ায়োর বলে ৮০ বলে ৮ চারে ৭৮ রান করে আউট হয়ে যান মুশফিক। দলের আড়াই শ’ রান হতেই মুশফিকের আউটের পর মাহমুদুল্লাহ ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতই ভরসা হয়ে থাকেন।

    দুইজন মিলে দলকে ৩০০ রানেও নিয়ে যান। দেখতে দেখতে দল ৩১৬ রানেও চলে যায়। মাহমুদুল্লাহ ও মোসাদ্দেক মিলে ৬৬ রানের মূল্যবান জুটিও গড়েন। দলের ৩১৬ রানের সময় মোসাদ্দেক (২৬) আউট হলেও মাহমুদুল্লাহ ঠিকই শেষ পর্যন্ত উইকেটে থাকেন। ৩৩ বলে ৩ চার ও ১ ছক্কায় শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ৪৬ রান করেন মাহমুদুল্লাহ। দলও শেষ পর্যন্ত ৩৩০ রানের মতো বড় স্কোরই গড়ে। রেকর্ড রান গড়ে বাংলাদেশ। যে রান দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পাহাড়সম হয়ে দাঁড়ায়। তাতে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের পর ফাইনালে এবং সর্বশেষ শিরোপা জেতার যে স্বপ্ন, তার শুরুটা দুর্দান্ত হলো। নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ম্যাককালাম ও ভারতের ধারাভাষ্যকার মাঞ্জরেকার যে বাংলাদেশকে নিয়ে উপহাস করেছেন তারও উচিত জবাব প্রথম ম্যাচেই দেয়া হয়ে গেল। প্রোটিয়া বধে বিশ্বকাপের সূচনাও অসাধারণভাবে করে ফেলল টাইগাররা।জনকণ্ঠ  অবলম্বনে