ইবনে বতুতার সফরনামা থেকে শাহ জালাল (র)’র অজানা তথ্য

    0
    401
    “কিতাব আল রেহালা:ইবনে বতুতার সফরনামা থেকে শেখ জালাল উদ্দিন আল তাবরিজী যিনি আমাদের কাছে হজরত শাহ জালাল মুজাররদে ইয়ামেনি (রহঃ)”
    হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি (রহঃ)-র সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বাঙলায় ইবনে বতুতা: আমি (বতুতা) সাদকাওয়ান ত্যাগ করে কামরূপ পর্বতমালার দিকে যাত্রা করি।এই পার্বত্য অঞ্চলে আমার যাবার উদ্দেশ্য ছিল একজন দরবেশের সাথে সাক্ষাত করা, যিনি সেখানে বাস করতেন। তিনি ছিলেন শেখ জালাল উদ্দিন আল তাবরিজী। তিনি প্রধান দরবেশদের মধ্যে গণ্য হতেন এবং অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি অনেক মহৎ কাজ করেছিলেন এবং অনেক অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড (কারামত) সম্পাদন করেছিলেন। তিনি খুবই বৃদ্ধ। আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি বাগদাদে আব্বাসিয় খলিফা মুসতাসিম বিল্লাহকে দেখেছিলেন এবং খলিফার হত্যার সময়ে (১২৫৮ সালে হালাকু খা কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংসের সময়) বাগদাদে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর মুরিদগণ আমাকে বলেছিলেন যে, তিনি (হজরত শাহজালাল) ১৫০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে রোজা পালন করেন। লাগাতার দশদিন পর ছাড়া তিনি রোজা ভঙ্গ কর‍তেন না। তাঁর একটা গরু ছিল। এর দুধ পান করে তিনি রোজা ভাঙতেন। তিনি সারারাত দাঁড়িয়ে ইবাদত করতেন। তিনি পাতলা ও দীর্ঘদেহী ছিলেন। খুবই সামান্য দাঁড়ি ছিল তাঁর। এই পাহাড়ি এলাকার অধিবাসীগণ তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এ কারণেই তিনি তাদের মধ্যে বাস করতেন।
    শেখের কারামত (অলৌকিক ঘটনা): তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই আমাকে বলেছেন, তিনি মৃত্যুর আগের দিন তাঁদের অনেককে ডেকে পাঠান ও আল্লাহকে ভয় করতে উপদেশ দেন। বলেন, “এ সত্য যে, আল্লাহ চান তো আগামিকাল আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো এবং তোমাদের মধ্যে আমার উত্তরাধিকারী তারাই হবে, যাদের এক খোদা ছাড়া অন্য কোন খোদা থাকবে না।” পরবর্তী দিন জোহরের নামাজ আদায়ের সময় সর্বশেষ সিজদারত অবস্থায় তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। যে গুহায় তিনি বাস করতেন তার পাশেই শিষ্যগণ একটা কবর খোঁড়া অবস্থায় দেখতে পান যার কাছেই ছিল কাফন এবং সুগন্ধি। তারা তাঁকে গোসল করিয়ে কাফন পরিয়ে জানাজা পড়ে উক্ত কবরে দাফন করেন। আল্লাহ তাঁর মঙ্গল করুন।
    শেখের (হজরত শাহজালাল) অন্যান্য অলৌকিক ঘটনা: আমি যখন শেখের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিলাম, তাঁর বাসস্থান থেকে দুইদিনের দূরত্বে তাঁর চারজন শিষ্য আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং আমাকে জানান যে, তাদের পীর তাঁর কাছে উপস্থিত মুরিদদের খবর দেন যে, “পশ্চিম থেকে একজন ভ্রমণকারী তোমাদের কাছে আসছেন। তাকে অভ্যর্থনার জন্য যাও।” তাঁরা আরও বলেন যে, শেখের নির্দেশে সে উদ্দেশ্যে তারা আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছেন। ঘটনা হলো শেখ আমার সম্বন্ধে কোনকিছু জানতেন না, কিন্তু এগুলি তাঁকে অলৌকিকভাবে জানানো হয়েছিল।
    এই লোকদের সঙ্গে আমি শেখের দর্শনের জন্য যাত্রা করে তাঁর আস্তানায় (গুহার বাইরে অবস্থিত) উপস্থিত হই। তাঁর আস্তানার কাছে কোন জনবসতি ছিল না। তবু দেশের লোকেরা, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে, শেখকে দর্শনের জন্য আসতো। তাঁর জন্য উপহার উপঢৌকন আনতো। এসব সামগ্রির উপরই শেখের শিষ্য ও মুসাফিরগণ জীবন ধারণ করতেন। শেখের সম্পদ বলতে একটি গাভী ছিল যার দুধ পান করে দশদিন পর পর তিনি রোজা ভাঙতেন, যা আমি আগেই বলেছি। তাঁর দরবারে আমি উপস্থিত হলে তিনি উঠে দাঁড়ান। আমাকে আলিঙ্গন করেন। আমার দেশ এবং ভ্রমণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি তাঁকে আমার বৃত্তান্ত বলি। তিনি আমাকে বলেন, “প্রকৃতই আপনি আরবদের পরিব্রাজক।” সেখানে উপস্থিত তাঁর শিষ্যগণ যোগ করেন, “এবং অনারবদেরও পরিব্রাজক, হে আমাদের শেখ।” জবাবে তিনি বলেন, “এবং অনারবদেরও। সুতরাং সেভাবে তার সেবা যত্ন কর।” আমাকে তাঁর আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমি তিন দিন আতিথেয়তা গ্রহণ করি।
    শেখের অলৌকিক বিস্ময়কর সত্য ঘটনাবলীর বিবরণ: যেদিন আমি শেখের আস্তানায় সাক্ষাত করতে গেলাম, তাঁর গায়ে ছাগ চর্মে তৈরি একটি পোশাক দেখতে পাই। এ আমার খুব পছন্দ হয়। আমি মনে মনে বলি, “আল্লাহ করুন যেন শেখ ওটি আমাকে দেন।” যেদিন আমি তাঁর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাত করি, তিনি উঠে দাঁড়ান এবং তাঁর আস্তানার এক কোণে যান। তাঁর পোশাকটি শরীর থেকে খুলে আমাকে পরিয়ে দেন। একটা উঁচু টুপিও তিনি তাঁর মাথা থেকে খুলে আমাকে দেন। তিনি নিজে একটা ছেঁড়া ও তালিযুক্ত জামা গায়ে দেন। উপস্থিত শিষ্যরা আমাকে জানান যে, শেখ সাধারণত এই পোশাক (ইতিপূর্বে ইবনে বতুতার আকাঙ্ক্ষিত ছাগ চর্মের পোশাকটি) পড়েন না। আমি যাওয়ার আগে তিনি এটি পড়েছিলেন এবং তাদের বলেছিলেন, “মাগরিবের অধিবাসী লোকটি এই পোশাকটি চাইবে। একজন বিধর্মী রাজা তার কাছ থেকে এটি নিয়ে নেবে এবং এটি আমাদের ভাই বোরহানউদ্দিন আসাগারজিকে দিয়ে দেবে। এটি তাঁরই এবং তাঁর ব্যবহারের জন্যেই তৈরি হয়েছে।” যখন শেখের শিষ্যরা আমাকে এসব বললো, তখন আমি তাদের বললাম, “আমি শেখের দোয়া পেয়েছি, কারণ তিনি তাঁর পোশাক আমাকে পরিয়েছেন। আমি এই পোশাক পরে কখনোই কোন রাজদরবারে যাবো না, সে মুসলিম বা বিধর্মী যে কোন সুলতানই হোক না কেন!”
    আমি শেখের কাছ থেকে বিদায় নিই। এর অনেক পরে আমি চীনে যাই এবং খানসা শহরে পৌঁছি। ভিড়ের কারণে আমার সাথী আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমার পরনে আলোচ্য পোশাকটি ছিল। আমি রাস্তায় চলছিলাম। উজির এক লম্বা মিছিল নিয়ে এলেন। আমার প্রতি তাঁর নজর পড়লো। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং আমার হাত ধরলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কখন এসেছি। আমাকে যেতে দিলেন না যতক্ষণ না আমরা রাজপ্রাসাদে পৌঁছলাম। আমি তখন তাঁর কাছ থেকে আলাদা হতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু তিনি আমাকে আটকালেন এবং যুবরাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে মুসলিম সুলতানের (ভারতের) সম্পর্কে জিজ্ঞাদাবাদ করলেন। আমি যখন জবাব দিচ্ছিলাম তখন তিনি আমার পোশাকের দিকে দৃষ্টি দিলেন ও প্রশংসা করলেন। উজির আমাকে এটি খুলে ফেলতে বললেন! আমার পক্ষে ঐ নির্দেশ অমান্য করা সম্ভব ছিল না। রাজা পোশাকটি নিলেন এবং আমাকে দশটি মূল্যবান পোশাক, একটি সুসজ্জিত ঘোড়া এবং কিছু মুদ্রা দেবার নির্দেশ দিলেন। এই ঘটনায় আমি মনে খুব আঘাত পাই। পরবর্তীকালে আমার শেখের (হজরত শাহজালাল) কথা স্মরণ হয়। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, একজন বিধর্মী রাজা পোশাকটি নিয়ে নেবে! এই ঘটনায় আমি খুব হতবাক হই।
    এক বছর পর আমি চীনের রাজা খান বালিকের পিকিং প্রাসাদে পৌঁছি এবং বুরহানউদ্দিন আসাগারজীর আস্তানায় যাই। আমি তাঁকে পাঠরত দেখি। তাঁকে সেই একই পোশাক (আমার থেকে যেটি নিয়ে নেওয়া হয়েছিল) পরিহিত অবস্থায় দেখতে পাই। এই ঘটনায় আমি খুবই অবাক হই। বারবার আমি হাত দিয়ে উল্টেপাল্টে সেটি দেখতে থাকি। তিনি (শেখ বোরহানউদ্দিন) আমাকে প্রশ্ন করেন, “তুমি এতে এত কী দেখছ? তুমি তাহলে এটা চেন?” আমি জবাবে বললাম, “হ্যাঁ, এটা সেই পোশাক, যা আমার কাছ থেকে খানসার রাজা কেড়ে নিয়েছিলেন।” তিনি বললেন, “এই পোশাক আমার ভাই জালালউদ্দিন আমার জন্যই তৈরি করেছেন। তিনি আমাকে লিখেছেন যে, পোশাকটি অমুক অমুকের হাত ঘুরে আমার কাছে আসবে।” অতঃপর তিনি আমাকে চিঠিটি দেন (হজরত জালালউদ্দিনের)। আমি সেটি পড়ে এবং শেখের অব্যর্থ ভবিষ্যদ্বাণী দেখে আশ্চর্যান্বিত হই। আমি শেখ বোরহানউদ্দিনকে কাহিনীর শুরুটা বলি। তিনি আমাকে বলেন যে, “আমার ভাই জালালউদ্দিন এখন এসবের ঊর্ধ্বে। তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন।” তিনি আরও বললেন যে, “তিনি প্রতিদিন ফজরের নামাজ মক্কাতে পড়তেন এবং প্রতিবছর হজব্রত পালন করতেন। তিনি আরাফাতের দিন এবং কোরবানির ঈদের দিন- এই দুদিন গায়েব (নিরুদ্দেশ) হয়ে যেতেন। কেউ জানতো না তিনি কোথায় গিয়েছেন।”
    .
    উল্লেখ্য, মরক্কোর বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে ভারতে আসেন এবং আট বছর সুলতানের দরবারে কাজির পদে নিযুক্ত থাকেন। ১৩৪৫-৪৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সময়ে বাঙলায় আসেন শুধুমাত্র হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি (রহঃ) এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। বাঙলার সম্পর্কে তিনি যে বিবরণ রেখে যান তা দীর্ঘ পরিসরের না হলেও তৎকালীন বাঙলার রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে আমরা জানতে পারি। উপরের লেখাটি বাঙলা বিষয়ক বৃত্তান্তের অংশমাত্র।
    এ মাসেই ইন্তেকাল করেছিলেন বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলাম প্রচারক হজরত শাহজালাল ইয়ামেনি (রহঃ)। তাঁকে উৎসর্গ করেই এটি লিখা।ইবনে বতুতার সফরনামা থেকে অনুবাদ মোহাম্মদ নাসির আলি ও সম্পাদনায় মোহাম্মদ রায়হান কাদেরী