আলীমের নির্দেশে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়

    1
    295
    আলীমের নির্দেশে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়
    আলীমের নির্দেশে ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়

    ঢাকা, ২১ মে : মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ২১তম সাক্ষী আব্দুল হামিদ সাকিদার। আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আব্দুল হামিদ সাকিদার সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্যগ্রহণের পর একটি প্রশ্ন করে জেরা শুরু করেছেন আলীমের আইনজীবী এডভোকেট এএইচএম আহসানুল হক হেনা। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে ৫৭-৫৮ বছর বয়সী সাক্ষী আব্দুল হামিদ সাকিদার জয়পুরহাট সদরের সিকদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার পিতার নাম মৃত আবুল হোসেন সাকিদার। তিনি বর্তমানে মুদি দোকানদার। সাক্ষী আব্দুল হামিদ সাকিদার সেদিনের ঘটনারই বর্ণনা দিয়েছেন তার সাক্ষ্যে। এ সময় তিনি ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ওই গণহত্যা ঘটনার দায়ে আলীমকে চিহ্নিত ও অভিযুক্ত করেন। তিনি আসামির কাঠগড়ায় আলীমকে সনাক্তও করেন।
    এ সময় সাক্ষী আব্দুল হামিদ সাকিদার বলেন, আলীমের বিরুদ্ধে আলীম সাহেব, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ১১ জন লোককে ধরে এনে বারোঘাটি পুকুরপাড়ের উত্তর পাড়ে এনে দাঁড়ায়। তাদের চোখে-মুখে কালি মাখানো ছিল। আলীম সাহেবের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা ওই ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে। আলীমের আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবেও সাক্ষী জানান, পুকুরটি তার দাদা ইমান আলী সাকিদারের নামে রয়েছে।
    রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী আরো জানান ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আব্দুল আলীম পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের নিয়ে এ সাক্ষীর গ্রামে হামলা চালিয়ে ১১ জন যুবককে ধরে নিয়ে আসেন। তাদের চোখে-মুখে কালি মাখিয়ে দু’টি ট্রাকে করে এনে সাক্ষীদের বাড়ির পুকুর পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাদের মরদেহ পুকুর পাড়ের আম ও লিচু গাছের নিচে পুঁতে রাখা হয়।
    সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে সাক্ষী তার সাক্ষ্যে বলেন, আলীম সাহেব, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা ১১ জন লোককে ধরে এনে বারঘাটি পুকুরপাড়ের উত্তর পাড়ে এনে দাঁড়ায়। তাদের চোখে-মুখে কালি মাখানো ছিল। আলীম সাহেবের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনারা ওই ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ওই ১১ জনের মরদেহ পুকুর পাড়ের আম ও লিচু গাছের নিচে পুঁতে রাখা হয়।
    সাক্ষী আরো জানান, বারোঘাটি পুকুরটি আমাদের বাড়ি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ২০০ পা দূরে হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪/৫ মাস পরে পুকুরে জাল ফেলা হলে শ’দেড়েক মানুষের কঙ্কাল উঠে আসে। সেগুলোকে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ের আমতলায় মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।
    সাক্ষী আব্দুল হামিদ সাকিদার আরও বলেন, আব্দুল মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। তিনি একাত্তর সালে জামায়াত ও মুসলিম লীগের কিছু লোকজনকে নিয়ে শান্তি বাহিনী গঠন করেন এবং এর চেয়ারম্যান হন। তিনি জয়পুরহাট মহাকুমা সদরের শাওন লাল বাজলার গদিঘর দখল করে সেখানে পাকিস্তানি ক্যাম্প বসান। আলীমের নির্দেশে রাজাকাররা গ্রামে গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিতো। লোকজনকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করতো। আলীমের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের আরও ২০ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে ১৯তম সাক্ষী আবেদ হোসেনকে বৈরি ঘোষণা করে জেরা করেছেন প্রসিকিউশন। অন্য ১৮ জন হলেন, আব্দুল মোমেন, মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, নুরুল ইসলাম, মোল্লা শামসুল আলম, আব্দুস সামাদ মণ্ডল, সোলায়মান আলী ফকির, গোলাম রসুল, বিউটি খানম, জাহিদুল ইসলাম, আবু সাইদ জোয়ার্দ্দার, দিলীপ কুমার চক্রবর্তী, লাইলী বেগম, ডা. কাজী এজাজ আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, মো. মোজাম্মেল হোসেন, এ কে এম মাহবুবর রহমান, আব্দুস সোবহান সর্দার, মোস্তাফিজুর রহমান ও সরদার আব্দুল হাফিজ। আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।
    গত বছরের ১১ জুন ৭ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৭টি অভিযোগে আলীমকে অভিযুক্ত করেন ট্রাইব্যুনাল-২।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, আব্দুল আলীম জয়পুরহাটের ডা. আবুল কাশেম হত্যা ও ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া জয়পুরহাটের করাইকাদিপুর এলাকার গণহত্যাসহ চকপাড়া, জুড়িপাড়া, পালপাড়া, সোনাপাড়া এলাকায় ৩৮ জনকে হত্যারও অভিযোগ রয়েছে আলীমের বিরুদ্ধে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের।গত বছরের ১৫ মার্চ আলীমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন। এতে একাত্তরে হত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আলীমের বিরুদ্ধে তিন হাজার ৯০৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ আলীমের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আমলে নেন।আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আব্দুল আলীমের বিরুদ্ধে ২৮টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৭টি আমলে নিয়ে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল-২।পরে ১৬ এপ্রিল আলীমের মামলাসহ তিনটি মামলা ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। ৩১ মার্চ তাকে ১ লাখ টাকায় মুচলেকা এবং ছেলে ফয়সাল আলীম ও আইনজীবী তাজুল ইসলামের জিম্মায় জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর বেশ কয়েক দফা এই জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সাবেক এই সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে দেয়া জামিনের অন্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- আলীমের পাসপোর্ট জমা থাকবে ট্রাইব্যুনালের নিবন্ধকের কাছে। ছেলে ফয়সাল আলীমের বনানীর বাসায় তাকে থাকতে হবে। ট্রাইব্যুনালের অনুমতি ছাড়া ঠিকানা বা অবস্থান পরিবর্তন করা যাবে না।গণমাধ্যমে কোনো ধরনের বক্তব্যও দিতে পারবেন না আলীম। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষী, একাত্তরে নির্যাতিত কেউ, ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পরিবার, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে, ফোনে বা ব্যক্তির মাধ্যমে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা যাবে না।