“আরসা”এখন কী করবে? কৌতূহল নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের

    0
    239

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৯অক্টোবর,ডেস্ক নিউজঃ  মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত কথিত আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা এখন কী করবে সে কৌতূহল দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা লাখ লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গার। গত ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে রাখাইনে ৩১টি নিরাপত্তা স্থাপনায় সিরিজ হামালার ১৬ দিনের মাথায় আরসা একতরফা অস্ত্র বিরতির ঘোষণা দেয়। আরসার অপরিপক্ক কার্যক্রম ও সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে পরস্পর বিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। অধিকাংশ আরসা যোদ্ধা নানা সংকটে পড়ে পালিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে তাদের অস্ত্র বিরতির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ। অস্ত্র বিরতির মেয়াদ শেষান্তে রাখাইনে থেকে আসা রোহিঙ্গা, সে দেশের সেনাবাহিনী, বর্ডার পুলিশসহ (বিজিপি) যৌথ বাহিনী এবং সেখানকার রাখাইনদের মাঝে নতুন করে আতংক সৃষ্টি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

    ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে রাখাইনের রাজধানী আকিয়াবের উপকণ্ঠে সেখানকার এক রাখাইন বাসযাত্রী মহিলাকে এক মুসলিমসহ কয়েকজন যাত্রী কর্তৃক গণ ধর্ষণের গুজব রটিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল। ওই সময় বাসে থাকা তাবলীগ জামাতের ১১ জন মুসলিমকে রাখাইন উগ্রপন্থীরা কুপিয়ে হত্যা করেছিল। এ ঘটনায় মুসলমান ও রাখাইন মগদের মাঝে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় রাখাইন মগরা মুসমানদের কয়েকশ’ ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাদ্‌রাসা মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছিল এবং দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছিল। বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছিল দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। যারা এখনো অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ক্যাম্প বা আইডিপিতে অবস্থান করছে। বিভিন্ন নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে এ ঘটনাকে পুঁজি করে রাখাইনে দুইটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর আর্বিভাব ঘটে। একটি রাখাইন উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘মা বা থা’, যেটার নেতৃত্বে আছেন উগ্রবৌদ্ধ সন্নাসী ‘ওরাথাও’। অন্যটি রোহিঙ্গা উগ্রপন্থী সংগঠন ‘হারকাত আল–ইয়াকিন’ যেটিকে সংক্ষেপে আল ইয়াকিন বলে রোহিঙ্গারা অভিহিত করে থাকে। আর এটির মূল নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বর্তমান সময়ের আলোচিত আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা।

    মিয়ানমারের দাবি, আরসা ২০১২ সালের পর থেকে সৌদিআরব, পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় সংঘটিত হতে শুরু করে। আরসা বিদ্রোহীদের সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, ২০১৩ সাল থেকে বর্তমান আরসা প্রধান আতাউল্লাহ ও সামরিক কো–চীফ হাফেজ তাহেরের নেতৃত্বে রাখাইনসহ উল্লেখিত দেশগুলোতে থাকা রোহিঙ্গা যুবকদের সংগঠিত করে। একই বছর বিদেশী একটি গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক ভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়। আফগানিস্তানে বিভিন্ন জঙ্গি অপারেশনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে বাস্তবিক সামরিক যুদ্ধা তৈরি করে। হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বা হুজি এবং লস্কর–ই–তৈয়বার সাথে আরসার সামরিক প্রশিক্ষণের বিনিময় ঘটে। ২০১৫ সালের শেষের দিকে ভারত, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে আরসা যোদ্ধারা বাংলাদেশ–ভারত–মিয়ানমার সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে সামরিক তৎপরতা শুরু করে। রাখাইন থেকে শত শত রোহিঙ্গা কিশোর ও যুবকদের মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে উজ্জীবিত করতে থাকে আরসা।

    মিয়ানমারের দাবি, বর্তমান আরসার পূর্বতন রূপ আল ইয়াকিন ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় প্রতিশোধ নিতে টেস্ট কেইস হিসেবে ২০১৬ সালে ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপির ৩টি স্থাপনায় আক্রমণ করে। এতে ৯ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হন, ৪৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬৬২৪ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৪৭টি বেয়নেট ও ১৬৪টি ম্যাগজিন লুট করে আল ইয়াকিন বিদ্রোহীরা। এঘটনার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী নির্মূলের অজুহাতে অপারেশন ক্লিয়ারেন্সের নামে রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিং অপারেশন চালায় ৪ মাসব্যাপী। সে অভিযানে কয়েক হাজার নিরাপরাধ নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও পুরুষকে হত্যা, নির্বিচারে আটক, অসংখ্যা নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং তাদের ঘরবাড়ি লুটপাটের পর অগ্নি সংযোগ করে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর চাপ ও প্রতিবাদের মুখে দীর্ঘ ৪ মাস রোহিঙ্গা নিধন ও নির্মূল অভিযানের পর অপারেশন সাময়িক ভাবে কমিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। তবে পুরোপুরি বন্ধ না করে গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহের নতুন ভাবে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে রাখাইনে।

    ২০১৬ সালে ৯ অক্টোবরের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি বছরের ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে আল ইয়াকিনের পরিবর্তিত রূপ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা রাখাইনের মংডু, বুথিডং ও রাথিডং অঞ্চলে ৩০টি পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি, একটি পুলিশ স্টেশন ও বুথিডংয়ে একটি সামরিক ঘাঁটিতে সিরিজ হামলা চালায়। এ ঘটনায় ১১ জন পুলিশ সদস্য, একজন আর্মি সদস্য ও একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ অফিসার নিহত হন। এসময় আরসা বিদ্রোহীরা ৬টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেশ কিছু গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায় বলে মিয়ানমার সরকারের তথ্য কমিটির অভিমত। এতে ৩৭০ জন রোহিঙ্গা বিদ্রোহী, ১৩ জন নিরাপত্তা বাহিনী সদস্য, ২ জন সরকারী কর্মচারী ও ১৪ জন সাধারণ লোকসহ ৪০০ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। ওই হামলার পর ২৫ আগস্ট সকাল থেকে রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইনের মংডু, রাথিডং ও বুথিডং অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনী, বিজিপি ও স্থানীয় উগ্রপন্থী রাখাইন মগরা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে চরম নির্যাতন শুরু করে।

    এ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ৪৭১টি গ্রামের মধ্যে ইতোমধ্যে যৌথ বাহিনী ২ শতাধিক রোহিঙ্গা গ্রাম সম্পূর্ণ ভাবে জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে ধ্বংস স্তুপে পরিণত করেছে। এসব গ্রাম সম্পূর্ণ ভাবে জনমানব শূণ্য হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারের হিসাব অনুযায়ী আরো ৩৪টি রোহিঙ্গা গ্রাম জনমানব শূণ্য হওয়া পথে। গত ২৫ আগস্ট থেকে গতকাল ৮ অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরিচালিত মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান রাখাইন থেকে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার ঘটনা বন্ধ না হওয়া আরো তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আশংকা করছে।

    এদিকে আরসা ঘোষিত এক তরফা অস্ত্র বিরতির মেয়াদ আজ সোমবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে বাংলাদেশে অবস্থান নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে আরসার কর্মকাণ্ড নিয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। অধিকাংশ রোহিঙ্গা বলছে, রাখাইনে যুগ যুগ ধরে চলমান সরকারী বাহিনীর নানা নির্যাতনের মাঝেও সব অধিকার হারিয়ে মোটামুটি ভাবে পূর্ব পুরুষদের ভিটে মাটি আঁকড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু রাখাইনের অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ও এক শ্রেণির উগ্র যুবক রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে বিভ্রান্ত করে রাখাইনে নিরাপত্তা স্থাপনায় হামলা চালায়। এর প্রতিশোধ নিতে মিয়নমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্যাতন শুরু করলে লক্ষ লক্ষ নিরীহ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ পালিয়ে আসে।

    নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব রোহিঙ্গা আরসার কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আরসার তাদের কাছে কোনো পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র নেই। নেই কোনো গোলাবারুদও। শুধু লাঠি, কিরিচ, চুরি ও গুলতি দিয়ে মিয়ানমারের সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু শুধু নিরাপরাধ ও নিরীহ রোহিঙ্গাদের সমূলে বিনাশ করতেই সরকার ও সেনাবাহিনীর এজেন্ট হিসেবে তারা কাজ করছে।

    তারা আরো বলেন, রাখাইনে দীর্ঘদিনের সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের পেশকৃত সুপারিশমালা সমূহ প্রকাশ করতে না করতেই আরসা রোহিঙ্গাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু করে। উক্ত সুপারিশমালা সমূহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো ধরনের মন্তব্য করার সুযোগ না দিয়ে অপরিপ ও অপরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গাদের সর্বনাশ করতে আরসা এ ধরনের হামলা চালিয়েছে।

    অন্যদিকে অনেক রোহিঙ্গাকে আরসার কাজকর্মের পত্মে কথা বলতেও শোনা গেছে। তারা বলছেন, রাখাইনের লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব সহ সকল অধিকার আদায়ের লক্ষে আরসা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অস্ত্র বিরতির মেয়াদ শেষান্তে তাদের কী পরিকল্পনা সে ব্যাপারে পরিষ্কার কিছু বলা যাচ্ছে না। আরসা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মিয়ানমার সরকার শান্তি আলোচনায় আরসাকে আমন্ত্রণ জানালে তারা তা সাদরে গ্রহণ করবে। অন্যদিকে আরসার অস্ত্র বিরতির প্রেক্ষিতে রাখাইনে এখনো থেকে যাওয়া কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা, রাখাইন জনগোষ্টি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মাঝে নতুন ভাবে অজানা আতংক কাজ করছে বলে জানা গেছে।দৈনিক আজাদী