অসুস্থ স্বামী এরশাদকে দেখতে যাননি রওশন এরশাদ

    0
    643

    নাম তার পেয়ারা। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বিয়ের পর দূরে থাকা স্ত্রীকে প্রচুর চিঠি লিখতেন। চিঠিতে তিনি স্ত্রীকে সম্বোধন করতেন ‘হৃদয়ের রানী’ ‘হৃদয়ের ধন’ ‘ওগো মোর জীবন সাথী’ ‘খুশি বউ’ ‘খুশি পাগলী’ ‘সোনা বউ’ ‘খুকু বউ’ ‘ওগো দুষ্টু মেয়ে’ ‘নটি গার্ল’ ‘বিরহিনী’ ইত্যাদি অবিধায়। স্ত্রীর ডাকনাম ডেইজী হওয়ায় ভালবেসে ডাকতেন ডেজু, ডেজুমনি, ডেজুরানী। চিঠির শেষে নিজের পরিচয় লিখতেন ‘পেয়ারা পাগল সাথী’ ‘বড্ড একাকী একজন’ ‘প্রেম-পূজারি’ ‘বিরহী’ ইত্যাদি।

    ৬২ বছরের সংসার জীবন। স্ত্রীকে নিয়ে বিশ্বের বহুদেশ ঘুরেছেন। ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। স্ত্রীকে রাজনীতিতে এনে এমপি, মন্ত্রী এমনকি জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতাও বানিয়েছেন। সেই স্ত্রী এখন অসুস্থ স্বামীর খোঁজ নেন না। গুরুত্বর অসুস্থ স্বামীকে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। যাদের সম্পর্কে এই কথাগুলো বলা হলো তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও বেগম রওশন এরশাদ। এরশাদের ডাক নাম পেয়ারা ও রওশনের ডাক নাম ডেইজি। ১৯৫৬ সালে বিয়ের পর সেনা কর্মকর্তা স্বামী এরশাদকে চাকরিতে এখানে সেখানে থাকতে হয়। আর পড়াশুনার জন্য স্ত্রী রওশন এরশাদ ডেইজিকে এক বছর থাকতে হয় বাবার বাড়ি ময়মনসিংহে। তখন এইচ এম এরশাদ দূরে থাকা স্ত্রীর বিরহে লেখা চিঠিতে এই শব্দগুলো ব্যবহার করেন। স্বাম-স্ত্রীর সেই স্বর্ণালী দিনগুলো এখন যেন হয়ে গেছে তামাটে।
    কবি এরশাদ নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বিয়ের পর সংসার করার জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হয়। রওশন ওদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছিল। চাকরির জন্য আমি আজ এখানে কাল ওখানে। সে সময় দূরে থাকা স্বামীরা স্ত্রীদের কাছে চিঠি পাঠাতো। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। বহু চিঠি লিখেছি; চিঠির প্রথমে রওশনকে অনেকভাবে ‘সম্বোধন’ করতাম।
    সিএমএইচ থেকে গতকাল দুুপুরে এইচ এম এরশাদকে বারীধারার দূতাবাস রোডের বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কে আনা হয়েছে। গুরুত্বর অসুস্থ এরশাদকে চিকিৎসার জন্য আজ দুপুরে নেয়া হবে সিংগাপুরে। রোগীর সঙ্গী হিসেবে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) খালেদ আখতার, এরশাদের ছোট ভাই হুসেইন মোর্শেদ এবং হুসেইন মোর্শেদের স্ত্রী রুখসানা খান মোর্শেদ। দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ এরশাদের পাশে থাকা দূরের কথা ৬২ বছরের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী স্ত্রী রওশন গুলশানের বাসা থেকে কয়েক মিনিটের পথ বারীধারায় গিয়ে স্বামী এরশাদকে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। উল্লেখ এইচ এম এরশাদ ও বেগম রওশন এরশাদ দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে আলাদা ভাবে বসবাস করছেন। রওশন এরশাদ গুলশানে আর এরশাদ থাকেন বারীধারার দূতাবাস রোডের ১০ নম্বর প্রেসিডেন্ট পার্কে। বিদিশার সঙ্গে বিয়ের পর এরশাদ গুলশানের বাসা চেড়ে প্রেসিডেন্ট পার্কে চলে যান। বিদিশার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও এরশাদ ও রওশন এক ছাদের নীচে আসেননি। তবে রাজনীতিটা এখনো এক দলেই করছেন।
    বাংলাদেশের রাজনীতির বহুল আলোচিত চরিত্র এরশাদ। আনপ্রেডিক্টেবল, পল্ট্রিবাজ, ভেল্কিবাজ নানান নামে তিনি দেশের রাজনীতিতে পরিচিত। ’১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাপার সমর্থনে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে। এর কিছুদিন পর কারাগার থেকে মুক্তি পান এরশাদ। অতপর তার রাজনীতি ভেল্কিবাজী নিয়ে বছরের পর বছর চলছে আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্কের ঝড়। কারাগারে থেকেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চিঠি লিখে রওশন এরশাদকে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য করেন। পর্যায়ক্রমে স্ত্রীকে কয়েকবার এমপি, মন্ত্রী, সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা করেন। বিদিশাকে বিয়ে করার কারণে স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের পর তারা পৃথক বসবাস শুরু করেন।
    স্বামী-স্ত্রীর রাজনীতি নিয়ে বিরোধের সুত্রপাত ঘটে ২০০৭ সালে।

    ২২ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে ইস্যু করে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক বিরোধ রাজনৈতিক বিরোধ রুপ নেয়। এরশাদ আন্দোলনরত আওয়ামী লীগের পক্ষ্যে অবস্থান নিয়ে মহাজোট আর রওশন এরশাদ বিএনপির ইচ্ছানুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে লাঙ্গলের প্রার্থী দেন। দেশের টলটলায়মান রাজনীতির মধ্যে সে সময় জাতীয় পার্টি থেকে স্বামী এরশাদকে বহিস্কার করে রওশন এরশাদ নিজে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও গোলাম মসিহ (বর্তমানে সউদীকে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) মহাসচিব করেন। এরশাদও অনেকটা বাধ্য হয়ে ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। পরবর্তীতে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ ও গাইবান্ধা থেকে তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে রওশন পরাজিত হন। এরশাদ রংপুরের চেড়ে দেয়া আসনে উপনির্বাচনে স্ত্রী রওশনকে এমপি করেন।

    ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের কাহিনী সবার জানা। এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্বামীকে হাসপাতালে রেখে রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেন এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন। গুরুমারা শিষ্যের মতোই সংসদে নিজের অধীনে স্বামী এরশাদকে রাজনীতি করতে বাধ্য করেন।
    গত কয়েক বছরে স্বামী-স্ত্রীর বিরোধী বহুবার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। মন্ত্রিসভা থেকে জাতীয় পার্টির মন্ত্রীদের পদত্যাগ করা না করা নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কয়েকবার ঝগড়া হয়। যা জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের বি-টীমে রুপান্তর ঘটানো হয়। জাতীয় পার্টি এখন কার্যত গল্পের গণিমিয়া। নিজস্ব কোনো রাজনীতি নেই; আওয়ামী লীগ যা বলে তাই তাদের করতে হয়।
    এরশাদ অনেকদিন থেকে অসুস্থ। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার সিংগাপুর গেছেন চিকিৎসা নিতে। কয়েক মাস থেকে বাসায় থাকার চেয়ে হাসপাতালেই তিনি বেশি নিরাপদবোধ করেন। তারপরও স্ত্রীর মন গলেনি! স্বামী-স্ত্রীর সবশেষ বিরোধ বাধে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ভাই জিএম কাদেরকে দলের কো চেয়ারম্যান করায়। এই সিদ্ধান্তে স্বামী এরশাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রওশন। ভাঙ্গনের মুখে পড়ে দল। শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়। সম্প্রতি এরশাদ তার অবর্তমানে দলের চেয়ারম্যান পদ জিএম কাদেরের নামে ‘উইল’ করে দেন। গত ১৮ জানুয়ারীও এক বার্তায় জিএম কাদেরকে তার অবর্তমানে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন এরশাদ। গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা গেছে এরশাদ পরিবারের সব সদস্যই এরশাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। আত্মীয়-স্বজন ও দলের নেতাকর্মীরা খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু রওশন এরশাদ অসুস্থ স্বামী এরশাদকে দেখতে যাননি।ইনকিলাব থেকে