অপরিকল্পিত ফিশারি নির্মানে সংকটে শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর

    0
    471

    অপরিকল্পিত ফিশারির বাঁধ পাহাড়ি পানির স্রোত এবং বর্ষার পানি নির্গমনে বাঁধা,অপরিকল্পিত বাঁদ অপসারণ করে হাওরাঞ্চলকে দ্রুত সংরক্ষণ করে এই সংকট থেকে হাওরাঞ্চলকে বাঁচানোর দাবি পরিবেশবাদীসহ স্থানীয় সচেতন মহলের। 

    সাদিক আহমেদ,নিজস্ব প্রতিনিধি: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি চায়ের রাজধানী খ্যাত মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা।একদিকে সারি সারি চা বাগান,অন্যদিকে প্রকৃতির অপার দান,অপূর্ব জলরাশির হাইল হাওর।

    উপজেলার প্রধান পয়েন্ট থেকে আর কে মিশন রোড হয়ে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রময়ের সম্মুখ দিয়ে পশ্চিমে গেলে দেখা মিলে প্রকৃতির অকৃত্রিম দান জলরাশীর এক অপূর্ব খেলা।

    বাংলাদেশের হাওরগুলোর মধ্যে অন্যতম হাওর হচ্ছে শ্রীমঙ্গলের এই হাইল হাওর।প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে অপরূপভাবে হাওরটিকে।

    প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক আসেন প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য নিজ চোখে দেখতে।

    কথিত আছে  শতাধিক বছর পূর্বে ভূমিকম্পের ফলে এই হাওরটির সৃষ্টি হয়েছে।

    হাওরটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে শ্রীমঙ্গলের জেলেদের জীবন-জীবিকা। হাওর থেকে মাছ ধরে এনে বাজারে বিক্রি করে সেই টাকায় চলে তাদের সংসার।

    তবে কৃত্রিম ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওর আজ ধ্বংসের মুখে। অপরিকল্পিতভাবে ফিশারিজ গড়ে উঠা,হাওরের পানিতে অধিক পরিমাণ বর্জ্যের কারণে হাওরটি তার স্বাভাবিক রূপ ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

    শ্রীমঙ্গলে হাইল হাওরের একাংশ জুড়ে কৃত্রিম মাছের অভয়াশ্রম ফিশারিজের চিত্রঃ ছবি প্রতিবেদক 

    সরজমিনে দেখা যায়,অপরিকল্পিতভাবে ফিশারি গড়ে উঠায় হাওরের প্রাকৃতিক সেই রূপ দিনে দিনে বিলুপ্তির পথে।সরকারী বিধিনিষেধ অমান্য করেই গড়ে তোলা হচ্ছে মাছের কৃত্রিম আশ্রয়কেন্দ্র। এতে করে দেশীয় অনেক মাছ আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।ফিশারি নির্মানের ফলে দেশীয় মাছের বিচরণ সীমিত হয়ে যাচ্ছে।এতে করে দেশীয় মাছগুলোর বংশবৃদ্ধি স্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে না।

    অন্যদিকে হাওরের পানিতে অধিক পরিমাণ বর্জ্যের কারণে হাওরের পানিতে এক বিশ্রী দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে।যা জলজ প্রাণী বিশেষ করে দেশীয় মাছের বংশবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।এতে করে হাইল হাওর তার চিরচেনা সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। অপরদিকে পাহাড়ি ছড়া নেমে যাওয়া পানির স্রোত এবং বর্ষার পানির নির্গমনে বাধা তৈরি করেছে এই অপরিকল্পিত ফিশারিজ গুলো।

    মৌলভীবাজারের পশ্চিম বাজার থেকে হাওর ভ্রমণ করতে আসা পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিথী দত্ত এ প্রতিনিধিকে বলেন, হাইল হাওরের অপূর্ব দৃশ্যের কথা শুনে আমরা আঙ্কেলের সঙ্গে এসেছি। প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত সুন্দর তবে হাওরের পানিতে অত্যন্ত দুর্গন্ধ। যে কারণে পানি ছুঁতে ইচ্ছা হয়না।

    আবহমান গ্রামবাংলার জেলেদের জীবন যাপনের এই চিত্র হাইল হাওর থেকে নেওয়া। ছবি প্রতিবেদক

    স্থানীয় জেলে ও মাঝি সলিম উদ্দিন বলেন,আগে হাওরে জাল ফেললেই জাল ভর্তি মাছ আসতো।এখন সারাদিন জাল ফেলে রাখলেও আগের মতো মাছ পাইনা।আমরা ফিসারম্যানরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকি।বর্তমানে খুবই কষ্টে দিন যাপন করছি আমরা। হাওরে এখন অনেক ফিশারি থাকায় দেশী মাছগুলো হাওরের পানিতে ঘুরাঘুরি করতে পারে না। যে কারণে দেশী মাছ এখন হাওরের পানিতে আগের মতো ডিম পারতে না পাড়ায় হাওরে মাছ এখন একদম নেই বললেই চলে।

    স্থানীয় মৎসজীবি মাছরাঙা সমিতির সভাপতি রোকমউদ্দিন আমার সিলেটকে বলেন,এখানে অনেক ভূমিহীনদের জায়গা জোরপূর্বক দখল করে ফিশারি গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক জায়গা আছে যা লিজ না নিয়েই অপরিকল্পিত ফিশারি নির্মাণ করা হয়েছে। যে কারণে দেশীয় মাছের বংশ বৃদ্ধি ব্যাঘাত ঘটছে।

    এ ছাড়াও পাহাড়ি ছড়ার প্রবাহমান পানির সাথে লেবু বাগানসহ চা বাগানের বর্জ্য ও বিভিন্ন রাসায়নিক সার, ঔষধ নেমে আসছে হাওরে ফলে প্রাকৃতিক পোকা মাকড়,মাছ,জলিয় বিভিন্ন প্রাণী ধ্বংসের মুখে পড়েছে। আর পানি হারাচ্ছে তার গুনগত মান এমন অভিযোগ ও পাওয়া গেছে স্থানীয়দের থেকে।

    এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশবাদী সংগঠন হাওর পাহাড় রক্ষা ও উন্নয়ন সোসাইটি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমেদ আমার সিলেটকে বলেন,মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে আমাদের প্রয়োজন জলাশয়।সেই জলাশয় যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি তাহলে দেশীয় মাছের প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধি বাড়ানো আমাদের জন্য কঠিন হবে।তাই আমাদের অপরিকল্পিত ফিশারি বন্ধ করতে হবে এবং দেশীয় মাছের প্রজনন বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের একটি শ্লোগান আছে-ফিশারি করো ধ্বংস বৃদ্ধি করো দেশীয় মাছের বংশ।আমাদের সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই হাওর রক্ষা করতে হবে।

    শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বুকে এভাবেই মাছ ধরছেন জেলেরা। ছবি প্রতিবেদক।

    এ ব্যপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা শহিদুর রহমান সিদ্দিকী আমার সিলেটকে বলেন,হাইল হাওর আমাদের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম একটি অংশ।অপরিকল্পিত ফিশারি নির্মান অবশ্যই হাওরের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।এতে করে দেশীয় মাছগুলোর বিচরণ সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।বর্তমানে প্রায় অধিকাংশ মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।আমাদের সবাই মিলে হাওরকে বাঁচানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।

    এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম আমার সিলেটকে বলেন,হাইল হাওরে আমি নিজেও ভিজিট করেছি।প্রত্যেক জায়গার খতিয়ান দেখা হচ্ছে।যারা অবৈধভাবে ভূমি দখল করে ফিশারি করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পৌর কতৃপক্ষ দেখা উচিৎ। তারপরও আমরা সরজমিনে গিয়ে দেখবো পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা যেটা সেটা হাইল হাওরে না দিয়ে অন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটা দেখবো।