শ্রীমঙ্গলের এক পিয়ন মদ মেপে কোটিপতি !

    0
    450

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,০৩এপ্রিল,ডেস্ক নিউজঃ নাম তার সিরাজ শিকদার। পদবি এমএলএসএস বা নিন্মমান সহকারী (পিয়ন)। কাজ- সরকারি মদের গুদামে মদ মাপা (ওজনদার)। বর্তমান কর্মস্থল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল মদের ডিপো।
    চাকরিতে ঢোকেন ’৮২ সালে। বর্তমানে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ১২ হাজার টাকা। যদি এ হিসাবও করা হয় তাহলে ৩৫ বছরের চাকরি জীবনে সর্বমোট আয় করেন ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
    এর থেকে দৈনন্দিন খরচ বাদ দিলে সঞ্চয় তেমন থাকার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্য আলাদিনের চেরাগ তার হাতে! পিওন পদমর্যাদার এই কর্মচারীর আয়ের সঙ্গে অর্জিত সম্পদের আকাশ-পাতাল ফারাক। বর্তমান সম্পদের পরিমাণ কয়েকশ’ কোটি টাকা !
    মদ ওজনে নয়ছয় করে অঢেল টাকায় একে একে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। তাই তাকে কোটিপতি নয়, অনেকে বলে থাকেন মদ মেপে মিলিয়নেয়ার সিরাজ।
    অবিশ্বাস্য সম্পদের কারণে শ্রীমঙ্গল উপজেলাজুড়ে তার নামডাক। তিনি এলাকার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবেও পরিচিত। আর এই পরিচিতির আড়ালে হারিয়ে গেছে তার পিওন পরিচয়। মাসব্যাপী যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে এমন মিলিয়নেয়ার পিওনের সন্ধান মেলে।
    সিরাজ শিকদার নামের এই ‘কোটিপতি পিওন’ বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের আওতাধীন কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার এমন অবিশ্বাস্য বিপুল অর্থবিত্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরশাদ হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘সিরাজের অঢেল সম্পদ সম্পর্কে মুখে মুখে আমিও অনেক কিছু শুনেছি। সে নাকি চা বাগানেরও মালিক। তার পদমর্যাদা যা তাতে এত সম্পদের মালিক হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন।’
    এ প্রসঙ্গে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একেএম দেলোয়ার হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি তার যে সম্পদের কথা বলছেন তা তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আপনার মাধ্যমে যেসব তথ্য পেলাম সেসব বিষয়ে আমি খোঁজখবর নেব। এরপর অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
    সিরাজের ‘প্রাসাদে’ একদিন
    শ্রীমঙ্গলের বিরাইমপুরে মনোরম বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক অট্টালিকা। যার প্রতিটি ফিটিংস আনা হয় ইতালি, চীন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। শানশওকতের কারণে স্থানীয়রা এই বাড়িকে ‘সিরাজ সাহেবে’র প্রাসাদ বলে থাকেন। বাইরে থেকে দেখতেও বাড়িটি সুরক্ষিত দুর্গের মতো। বিদেশী নির্মাণশৈলীর সুরম্য এই ৫ তলা বাড়ি দেখতে আসেন অনেকে। সিরাজের কথিত এই প্রাসাদ দেখতে ১১ মার্চ যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম হাজির হয় শ্রীমঙ্গল পৌর সদরের বিরাইমপুরে। সঙ্গে গোপন ক্যামেরা। সিরাজের অভিজাত বাড়ির অন্দরমহলের চিত্র ধারণ করা হয় ক্যামেরায়।
    সিরাজের বাড়ির সামনে যেতেই চোখ ছানাবড়া হওয়ার অবস্থা। কারণ ৫ তলা বাড়িতে যাওয়ার জন্য সিরাজ নিজস্ব অর্থে প্রশস্ত পাকা রাস্তা নির্মাণ করেছেন। রাস্তা ধরে মূল বাড়িতে ঢোকার আগে দ্বিতল সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। নিচতলায় গ্যারেজ। ওপরে গৃহকর্মী ও গাড়িচালকদের থাকার জায়গা। পুরো বাড়িটি উঁচু প্রাচীর ঘেরা। বাড়ির দ্বিতীয় তলায় সপরিবারে থাকেন সিরাজ। গেটে দাঁড়াতেই নিরাপত্তারক্ষীরা পরিচয় জানতে চান।
    সাংবাদিক পরিচয় জানার পর একজন নিরাপত্তা প্রহরী জানান, ‘অনুমতি ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। আপনাকে একটু বসতে হবে। খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর সিরাজ শিকদার নিজেই নিচতলায় নেমে আসেন।
    শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বিস্তারিত কথা হয় তার আভিজাত্যে ভরা ড্রয়িংরুমে। ঝলমলে ঝাড়বাতি ছাড়াও আছে আধুনিক সব শিল্পের ছোঁয়া। যে কেউ দেখলে তার কাছে মনে হবে এটি আধুনিক যুগের কোনো রাজপ্রাসাদ। দেয়ালে লাগানো সিরাজের বিশাল সাইজের বাঁধানো ছবির অঙ্গভঙ্গি দেখে অনেকে কিছুক্ষণের জন্য তাকে রাজা-বাদশাহও মনে করতে পারেন। তবে তার অঢেল সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়।
    কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে উত্তর এড়িয়ে যান। এরপর বলেন, ‘ভাই কিছু সম্পদ আল্লাহ আমাকে দিয়েছে। এ নিয়ে অনেকেই নানান কথা বলে। তবে আমি কৃপণ নই, সবাইকেই খুশি রাখি। ঢাকা থেকে কষ্ট করে এসেছেন। আপনি আমার মেহমান। আমি যতটুকু পারি, আপনাকে মেহমানদারি করব।’
    এভাবে তিনি এক পর্যায়ে মোটা অংকের ঘুষের অফার দিয়ে তাকে নিয়ে কোনো রিপোর্ট না করার অনুরোধ জানান। গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত ঘুষ অফারের এই ভিডিও চিত্র যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।
    অবাক করা সম্পদ
    সিরাজ শিকদারের নামে-বেনামে কতগুলো ব্যাংক হিসাব জমা আছে তার হিসাব কারও জানা নেই। এ বিষয়ে তিনি জানান, ‘শ্রীমঙ্গলের প্রায় সব ব্যাংকেই তার অ্যাকাউন্ট আছে। কেননা স্থানীয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকরা আমার কাছে এসে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য অনুরোধ করেন। এজন্য সব ব্যাংকেই অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়েছে।’
    তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চাকরির পাশাপাশি সিরাজ সিলেটের একজন বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল, ট্যুরিস্ট কর্টেজ ও চা পাতার আমদানি-রফতানি ব্যবসা। মৌলভীবাজার রোডে গ্র্যান্ড তাজ চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। স্টেশন রোডে সুলতান রেস্টুরেন্ট। ঢাকা-শ্রীমঙ্গল রোডে আছে চা পাতার সেলস সেন্টার ‘সাহিন টি হাউস’। তিনি চড়েন কোটি টাকার পাজেরো গাড়িতে। এলাকায় দানবীর হিসেবেও পরিচিত। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এতিমখানাসহ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তিনি দু’হাত খুলে দান করেন। কেউ তার কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে ফিরে এসেছেন এমন নজির নেই।
    তবে তার আসল পরিচয় অনেকেই জানেন না। সবাই জানেন তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সিরাজ অবশ্য নিজেকে কখনও শ্রমিক নেতা, আবার কখনও লেবার সুপারভাইজার হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।
    স্থানীয় প্রশাসন সিরাজের পকেটে : অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরাও সিরাজের নিয়মিত অতিথি। মেয়র পদমর্যাদার একজন জনপ্রতিনিধি সার্বক্ষণিক সিরাজের সঙ্গী। জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত সিরাজের বাড়িতে নাচ-গান হয়।
    এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, তার পার্টিতে ঢাকা থেকে নামিদামি নায়িকা ও আর্টিস্ট আসেন বলে শুনেছি। সেখানে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় সরকারি কর্মকর্তার যাতায়াত আছে।
    সিরাজ শিকদারের বক্তব্য
    শ্রীমঙ্গল মদের ডিপোতে সিরাজ শিকদার একটানা ১৮ বছর ধরে কর্মরত আছেন। ওপর মহলে হটকানেকশনের কারণে তার বদলি হয় না। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিরাজ বলেন, ‘এই আছি আর কি। সব বুঝেনই তো। সবাইকে ম্যানেজ করেই আমাদের চলতে হয়। বিপুল বিত্তবৈভব সম্পর্কে আমতা আমতা করে বলেন, ‘একটু একটু করে করেছি আরকি।’
    তিনি বলেন, ‘মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এই সম্পদ গড়েছি।’ শ্রীমঙ্গল ওয়্যারহাউসে কোন পদে চাকরি করেন জানতে চাইলে একেবারে ঠায় চুপ হয়ে যান।
    অনেকটা বিব্রত অবস্থায় মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘ওসব বাদ দেন তো ভাই। পদ-পদবি দিয়ে কি হবে।’ চাপাচাপির এক পর্যায়ে বলেন, ‘আমার পদবি হচ্ছে ওয়েটম্যান বা ওজনদার। আমার কাজ হচ্ছে সরকার নির্ধারিত পরিমাপ অনুযায়ী মদ মেপে দেয়া।’
    একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর এত বিপুল অর্থবিত্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী কিভাবে এত সম্পদ বানালেন তা অবশ্য তদন্ত করে দেখা উচিত। এক্ষেত্রে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। পাশাপাশি দুদকেরও এখানে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।
    তথ্যসূত্র :যুগান্তর থেকে হৃদয় দাস শুভ কর্তৃক।