রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিদ্যুতকেন্দ্র চালু রাখা কঠিনঃপ্রধানমন্ত্রী

0
245
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিদ্যুতকেন্দ্র চালু রাখা কঠিনঃপ্রধানমন্ত্রী
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিদ্যুতকেন্দ্র চালু রাখা কঠিনঃপ্রধানমন্ত্রী

আমার সিলেট ডেস্কঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতকেন্দ্র চালু রাখা ‘কঠিন হয়ে পড়েছে’ মন্তব্য করে এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন। তিনি বলেন, এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সীমিত পরিসরে বিদ্যুত উৎপাদন করে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। বিদ্যুতের উৎপাদন সীমিত করতে হবে কারণ আমাদের বিদ্যুতের ভর্তুকির পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে গেছে।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশীয় পণ্যের দাম যেমন বেড়ে গেছে, পাশাপাশি যে সমস্ত পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে, তারও দাম বেড়ে গেছে। সব কিছুর দাম এমনভাবে বেড়ে গেছে যে, বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো চালিয়ে রাখা, আমাদের নিজস্ব যতটুকু গ্যাস আছে, সব কিছু মিলিয়ে বিদ্যুতকেন্দ্র চালু রাখাটাই কষ্টকর হয়ে গেছে। অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে গেছে। সেই বিষয়টাও আপনাদের (দেশবাসীকে) আমি জানাতে চাই। আমি আশা করি দেশবাসী অন্তত এই ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।

বুধবার ৬ জুলাই চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) স্থাপিত ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর নামে দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসভিত্তিক আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর, ‘শেখ জামাল ডরমিটরি’ এবং ‘রোজি জামাল ডরমিটরি’র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চুয়েটে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে ‘চুয়েট শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’-এর ওপর একটি অডিও-ভিডিও প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিটি বিভাগের সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম।

অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যুত ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময় ভিত্তিক লোড-শেডিংয়ের জন্য একটি রুটিন তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, কোন এলাকায় কত সময় লোড-শেডিং দেয়া হবে তার একটি রুটিন তৈরি করুন। কারণ, জনগণ যেন সেজন্য প্রস্তুত হতে পারে এবং তাদের দুর্ভোগ কমানো যায়।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধজনিত বিশ্ব পরিস্থিতির কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধের পর আমেরিকা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল, ইউরোপ নিষেধাজ্ঞা দিল। অবস্থাটি কিন্তু এই দাঁড়িয়েছে যে, এখন তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, ডিজেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

ফার্নেস ওয়েল, এলএনজি, কয়লা, ডিজেলসহ বিদ্যুত উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন একটা ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে সারাবিশ্ব। সঙ্কটটা যদি না হতো, তাহলে কিন্তু রাশিয়া থেকে বা ইউক্রেন থেকে তাদের তেল বা ফার্টিলাইজার, গম, অন্যান্য সাপ্লাইটাও ঠিক থাকত।

সঙ্কট মোকাবেলায় জনগণকে খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি সবাইকে আহ্বান করেছি, প্রত্যেকের নিজেদের সঞ্চয় বাড়াতে হবে, খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং যতটুকু পারা যায় বিদ্যুত সাশ্রয় করতে হবে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে।’

দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন হলেও এখনকার পরিস্থিতিতে আবার লোডশেডিং করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুত আমরা সকলের ঘরে দিয়েছি এটা ঠিক, কিন্তু বর্তমানে আমাদের লোডশেডিং করতেই হবে, উৎপাদনও আমাদের সীমিত রাখতে হবে- যাতে করে আমাদের ভর্তুকিটা না দিতে হয়।

আমদানি করা গ্যাস দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র চালু রাখার জন্য সরকারকে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে, সেটা কতক্ষণ দিতে পারবে? কারণ আমাদের মানুষের খাদ্য দিতে হবে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে, গৃহহীনদের ঘর করে দিতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।

আমাদের এখন একটাই উপায়, ইতোমধ্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি, প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক কখন, কোন সময়, কত ঘণ্টা লোডশেডিং হবে, এটার একটা রুটিন তৈরি করে সেভাবেই লোডশেডিং করতে। যাতে মানুষ সেই সময়টায় প্রস্তুত থাকতে পারে।  প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বর্তমানে বিদ্যুত খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো চালু রাখার জন্য গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানিতে আমাদের ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমান বাজেটে ৮৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

কিন্তু ভর্তুকি না কমালে সরকার টাকা কোথা থেকে পাবে। তিনি বলেন, ভর্তুকি ছাড়াও তার সরকার দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে, ভর্তুকি মূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিস পেতে এক কোটি রেশন কার্ড দিয়েছে এবং বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিচ্ছে, যা অনেক ধনী দেশও করেনি।

অনুষ্ঠান থেকে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা সারাদেশে ২ হাজার ৭১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা  দেন। যার মধ্যে ২ হাজার ৫১টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের অধীনে এবং ৬৬৫টি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এমপিও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, তার সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগকে ব্যয়ের পরিবর্তে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করেছে। কারণ, তারা বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানভিত্তিক প্রজন্ম তৈরি করতে চায়, যাতে নতুন প্রজন্ম সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার ফলে বিদ্যুত উৎপাদনের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সরকারকে কী পরিমাণ ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে তারও একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা, সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে ১ হাজার ৮০ টাকা, অর্থাৎ ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এলএনজি যেটা মাত্র ১০ মার্কিন ডলারে ক্রয় করা হতো, যুদ্ধের ফলে সেটা এখন ৩৮ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ২৮০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। আমাদের কয়লাও ১৮৭ মার্কিন ডলার ছিল, এখন ২৭৮ মার্কিন ডলার, বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। এছাড়া ডিজেলের লিটার ৮০ মার্কিন ডলার ছিল, তা এখন ১৩০ ডলারে চলে আসছে। শোনা যাচ্ছে ৩০০ ডলার পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। ভোজ্য তেলেরও দাম বাড়ছে। প্রত্যেকটা জিনিস যেগুলো কিনে আনতে হয় তাঁর দাম অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ক্রয়ে সরকারের ব্যয় ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা। কিন্তু আমরা সেটা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছিলাম মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। যেটা সম্প্রতি ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও বিশাল অংকের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৮৪ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা, কিন্তু একক প্রতি পাইকারি মূল্যে আমরা দিচ্ছি ৫ দশমিক ০৮ টাকায়, ফার্নেস ওয়েলের প্রতি একক ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ১৭ দশমিক ৪১ টাকা, সেটাও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকায় দিচ্ছি। ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, সেখানেও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকা দরে বিদ্যুত বিক্রি করছি।

কয়লা থেকে বিদ্যুত  উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৩৭ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ০৮ টাকায়। অর্থাৎ সারা বিশ্ব এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।

তার সরকারকে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর জোগান দেয়ার পর আবার কৃষিতেও ভর্তুকি দিতে এত বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি আর কতদিন দেয়া সম্ভব সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে পিছিয়ে না পড়ে, এজন্য প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। সমগ্র বাংলাদেশে বিভিন্ন ডিজিটাল স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এদেশ থেকে ডিজিটাল ডিভাইস রফতানি হবে।

তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে আমাদের ছোট শিশু থেকে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তার ফলটা এদেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম পাবে। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা কামনা করি। আগামী দিনে পণ্য রফতানিতে গার্মেন্টেসের পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে ডিজিটাল ডিভাইস বাংলাদেশে উৎপাদন হবে। আমরা রফতানি করব।

রফতানিক্ষেত্রে এটাই হবে সব  থেকে বড় একটি পণ্য। যা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। সে লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য সমগ্র বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কোন ক্ষেত্রেই যেন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে পিছিয়ে না থাকে, সেভাবেই তাদের প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে তা আগামী তরুণ প্রজন্মের মেধা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিকাশ কেন্দ্র এবং তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দেশপ্রেমের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে জাতির স্বপ্নে সোনার বাংলাদেশ। জাতির পিতা স্বপ্নের সোনার বাংলা দেখে যেতে পারেননি। তবে উনার যে স্বপ্ন, সেটা পূরণ করা আমাদের দায়িত্ব।

পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁর সরকারের ওপর দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করব। আমরা সেটা বাস্তবায়ন করেছি। এটাই আমাদের অর্জন। আমরা বিশ^কে দেখিয়েছি, বাংলাদেশ পারে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও আমরা সফল, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। আমরা এখন আগামী প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়ে যাব, যেন তারা ভবিষ্যতে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেই আশাই পোষণ করি।