রক্তমাখা বিজয় দিবসে আত্মজিজ্ঞাসা

    1
    255

    আমারসিলেট24ডটকম,১৩ডিসেম্বরঃ  স্বাধীনচেতা এই জাতি কোন সময়ই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি বা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে প্রতিহত করেছে সকল অবিচার-অনাচারকে। সকল অসত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে প্রাণপন সংগ্রামের মাধ্যমে। নিজেদের জাতি সত্ত্বার উপর কোন আঘাত তারা সহ্য করেনি এক মুহূর্তের জন্য। যখনই কোন ষড়ন্ত্র কিংবা আগ্রাসন এসেছে, এদেশের আপামর জনগণ এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। প্রাচ্য হোক আর পাশ্চাত্য হোক কোনো শক্তির কাছে হার মানেনি কখনো। যার শতশত নজির বিদ্যমান রয়েছে ইতিহাসের পাতায়।

    কিছু বিশ্বাসঘাতক ও জাতির শত্রুর গাদ্দারি এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৭৫৭ সালে বৃটিশরা ভরতীয় উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকে শুরু হয় দফায় দফায় নানা ধরণের প্রতিবাদ আন্দোলন। এক পর্যায়ে তারা ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। তখন ভৌগলিক পরিবেশ ও ধর্মীয় কারণে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয় হিন্দুস্থান ও পাকিস্থান নামে দুটি রাষ্ট্রে। তখন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ অন্তর্ভূক্ত হয় পাকিস্তানের। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন দেশ। কিন্তু পাকিস্তানী স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর শুরু করে অত্যাচর-অবিচার। সীমাহীন শোষন আর বঞ্চনার শিকার হতে হয় পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সমাজিক, সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রে তারা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে চায় এদেশের মানুষদের।

    কিন্তু তাদের সে অবিচার কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেনি বাংলার জনগণ। তাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯, ১৯৭০ ও সর্বশেষ ১৯৭১-এ শুরু হয় চূড়ান্ত সংগ্রাম। নিরস্ত্র হাতে কামানের প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল স্বাধীনতাকামী এই বীর জনতা। তাদের সকল অত্যাচার অবিচারের জবাব দিতে রাজপথে নেমে আসে আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, নারী-পুরুষ, শ্রমিক, মজুর, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর স্বাধীনতার স্বপ্নের সূর্যটি উদিত হয়েছিল বাংলাদেশের পুবাকাশে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে অর্জন হয় চূড়ান্ত বিজয়। সে দিন থেকে ইংরেজি বছরের ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবসের ৪২ বছর পুর্তি হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ ৪২ বছর ধরে আমরা বিজয়ী জাতি হিসেবে বাস করছি সবুজ এই ভূখন্ডে।

    আমরা এই ৪২ বছর ধরে বিজয়ী বীর হিসেবে বাস করছি, তবে ১৯৭১ সালের সেই বীরত্ব কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? একটি স্বাধীন-বিজয়ী জাতি হিসেবে আমরা কতটা সফলভাবে জীবনযাপন করছি? এরকম শত প্রশ্ন আজ প্রতিধ্বনিত হয় বিবেকের কানে! জাতির শ্রেষ্ট সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা আজ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে বলেন, এই বাংলাদেশের জন্য কি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি? প্রতি বছর আমরা ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস-সহ কত দিবস উদযাপন করি। কিন্তু সেই বিজয়ের তাৎপর্য থেকে আমাদের অবস্থান বা অর্জন কতটা সমৃদ্ধ তা-ই ভাববার বিষয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক এমন কোন দিকটা রয়েছে যেখানে আমরা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ভোগ করছি? যেখানে আমরা মুখোমুখি হয়নি ভিনদেশী আগ্রাসনের? বোধ হয়, সুস্থ্য বিবেকবান নাগরিকরা এ নিয়ে শুধু আক্ষেপের নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ছাড়া কিছুই করার নেই!

    আমরা কতটা স্বাধীন আর বিজয়ী জাতি সে প্রশ্ন জাগে, যখন প্রতিদিন খবরের কাগজে সীমান্তে আমাদের ভাই-বোনদের অন্য দেশের সীমান্ত রক্ষীর হাতে নির্বিচারে হত্যার সংবাদ পড়তে হয়, যখন ছোট্ট এই দেশটাকে ঘিরে প্রাচ্য কিংবা প্রাশ্চাত্যের মোড়লদের হাজারো ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে দেখি, যখন বাংলাদেশের বাজারে দেশীয় মানসম্পন্ন পণ্য রেখে বিদেশী পণ্যের আধিপত্য দেখি, যখন দেশের প্রধান প্রধান বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্প সমূহ একের পর এক ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে নানা আগ্রাসনে-ষড়যন্ত্রে, যখন এদেশের যুবকদের হাতে হাতে, কানে কানে, মুখে মুখে শোনা যায় বাংলা রেখে হিন্দি গানের সুর, যখন কথায় কথায় চলে আসে বিদেশী ষড়যন্ত্রের কথা, যখন নদী মাতৃক দেশ হয়েও দেশের নদীগুলো একের পর পানিশূন্য হয়ে পড়তে দেখি, যখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কথা উঠতে চলে আসে হলিউড-বলিউড আরো কতো কি যে বিদেশী কুরুচিপূর্ণ অপসংস্কৃতির কথা, যখন সভ্যতার নামে এদেশের তরুণ সমাজ অনুসরণ করে কিছু বিকৃত আদর্শ, যখন দেখি এদেশের মানুষদের নাগরিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র….।

    তাহলে কি আমরা সম্মুখ সমরে শত্রুর মোকাবেলা করে বিজয়ী হলেও গোপন আর সুক্ষ এসব ষড়যন্ত্রের উপর বিজয় হতে পরিনি? বাস্তবতা তা-ই! জলে, স্থলে, আকাশে সর্বত্র আমরা অবরুদ্ধই মনে হয়। জাতীয় যে কোনা ইস্যুতে নাক গলাতে দেখি বিদেশীদের। আবার এদেশের খেয়ে পরে কিছু মানুষ দেশের স্বার্থের চেয়ে ভিনদেশের স্বার্থে কথা বলে।

    তাই বিজয়ের এই দিনে আত্মপর্যালোচনার করতে হবে। নিজের জাতি সত্ত্বার পরিচয়, স্বকীয়তা, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে ভাবতে হবে। অন্যের অনুকরণের চেয়ে নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে গর্বিত হতে হবে। দেশকে ভালোবাসতে হবে। দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। সবদিক থেকে সচেতন হতে হবে। যাতে কোন অপশক্তি, অপকৌশল বা আগ্রাসন আমাদেরকে নিজ অবস্থান থেকে নড়াতে না পারে। অনেক বেশি সাবধান হতে হবে সব ষড়যন্ত্র থেকে। তাহলে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ, বাসযোগ্য দেশ গড়া সম্ভব হবে।লেখক:লুৎফুর রহমান তোফায়েল