আমারসিলেট 24ডটকম,০৮অক্টোবর:হজ্ব ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি। আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী প্রত্যেক সুস্থ্য, বিবেকবান, প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের জন্য জীবনে একবার মহিমান্বিত এই ইবাদত আদায় করা ফরয। হজ্ব মূলত সফর ভিত্তিক একটি ইবাদত। যেখানে মুসলমানরা নিজ দেশ থেকে সফর করে সৌদি আরবের পবিত্র মক্কায় অবস্থিত বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফসহ আরো কিছু জায়গায় নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পাদন করেন। সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে তারা হিজরি সনের যিলহজ মাসের ৮ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজগুলি করে থাকেন। এরপর প্রায় সবাই মদিনায় অবস্থিত মহানবীর (সা) রওযা মুবারক যিয়ারত করেন। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তখন মক্কা ও মদিনায় কয়েক গুণ মানুষের সমাগম ঘটে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ঈমানদার মুসলমান সমবেত হন মহান মাবুদের সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র এই ভূমিতে। এক অভূতপূর্ব মহামিলনের উৎসবে পরিনত হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্ব রচনা করে এক সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমবেত মুসলমানদের দেহের গঠন, মুখের ভাষা ও বর্ণে পারস্পরিক ভিন্নতা থাকলেও সেখানে সবাই একই পোষাক জড়িয়ে থাকেন নিজ গায়ে। মুখে সবার উচ্চারিত হয় একই আওয়াজ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…..। একই কাতারে দাঁড়িয়ে আদায় করেন প্রতি ওয়াক্তের সালাত, একই নিয়মে সম্পাদন করেন হজের সকল কার্যক্রম, একই ভাষায় বর্ণনা করেন মহান মুনিবের মাহাত্ম। এর মাধ্যমে পরস্পরে সৃষ্টি হয় এক অসাধারণ ঐক্যের বাঁধন। মুসলমানা ফিরে পায় নিজ চেতনা। জাগ্রত হয় ভ্রতৃত্বের মায়া-বন্ধন। সবাই এক সাথে প্রভূর একত্ববাদ বর্ণনা করেন একই সুরে।
এভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৃষ্টি হয় এক অটুট ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের। তারা উজ্জিবীত হয় সাম্য ও ন্যায়ের মন্ত্রে। সম্মিলিতভাবে মহান প্রভূর বান্দা হিসেবে নিজেকে সপে দিতে উদগ্রীব থাকে তাদের মন। তখন তারা পায় মহান মুনিবের অফুরন্ত করুণা। পূন্য অর্জনের এই সুবর্ণ সুযোগে তারা নিেেজকে শামিল করে নেয় মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাতারে। একটি মকবুল হজের পর বান্দা জন্মের সময় যেরকম নিষ্পাপ ছিল সে রকমই নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরে। তখন মহান প্রভূর অনুগ্রহ ও ভালোবাসায় সে নিজেকে পরবর্তী জীবনের জন্য তাঁর অনুগত বান্দা হিসেবে জীবন পরিচালনার পরম শিক্ষা লাভ করে।
এরকম একটি পরিবেশে পবিত্র হজ পালনের মাধ্যমে বান্দার অন্তরে জেগে ওঠে মাওলার প্রেম। সেই প্রেমে মগ্ন হয়ে হজের যাবতীয় আহকাম সম্পাদনের পাশাপাশি আপন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চর্চা করে থাকে। কেননা এই হজ ও কোরবানি মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ), হাজেরা ও ইসমাঈল (আ)-এর অমর স্মৃতি বিজড়িত একটি ইবাদত। যেখানে ধাপে ধাপে মুসলমানরা উপলব্ধি করে ইব্রাহিমের আত্মত্যাগ আর মহান প্রভূর আনুগত্যের নাজরানা। ইব্রাহিম (আ) কীভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তাদের সামনে। হজের প্রতিটি কাজেই মহান আল্লাহ রেখে দিয়েছেন নিজ বন্ধু ইব্রাহিমের জীবনের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিগুলো। এর মাধ্যমে মুমিনেরা হজ ও কোরবানিতে খুঁজে পায় আপন প্রভূর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের মহান শিক্ষা।
নুহ (আ)-এর সময়ের প্লাবনের পর কাবা ঘরের সংস্কারের প্রয়োজন পড়লে ইব্রাহিম (আ) নিজপুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে এ ঘরটি সংস্কার করেন। এবং দোয়া করলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর, আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এ কাজটি কবুল কর।” আল্লাহ তাআলা ইবরাহিম (আ)-এর দোয়া কবুল করে নির্দেশ দিলেন, “হে ইব্রাহিম! তুমি মানবজাতিকে হজের জন্য আহবান কর। আমার বান্দারা আমার প্রেম ও ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানে হজ করতে আসবে। তাদের সব আশা-আকাক্সক্ষা ও মনের সদিচ্ছা পূর্ণ হবে এবং সব অপরাধ ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।” এছাড়া ইসমাঈল (আ)-এর শিশুকালে আল্লাহ ইব্রাহিম (আ)-কে নিদের্শ দিলেন শিশুপুত্র ইসমাঈলসহ স্ত্রী হাজেরাকে মরুভূমির নির্জন এলাকায় রেখে আসতে। ইব্রাহিম (আ) নিজ প্রভূর আনুগত্যের কারণে জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে স্ত্রী-ছেলেকে রেখে আসলেন। পানীয় ও খাদ্য সামগ্রী শেষ হয়ে যাওয়ার পর হাজেরা সন্তানের জন্য পানির খুঁজে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে পানির খুঁজ করেন। এবং আল্লাহ তখন নিজ রহমতে জমজম কুপের সৃষ্টি করে তাদের পানির চাহিদা পূরণ করেন। এজন্য হজ পালনকারীরা এই সাফ-মারওয়া পাহাড়ে সায়ি করেন। আল্লাহর আদেশে ইব্রাহিম (আ) পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় শয়তান বাধা দিলে তিনি শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে প্রতিহত করেন। তাই হাজিরা এই স্থানে গিয়ে শয়তানকে উদ্দেশ্য করে পাথর ছুঁড়েন। এরপর ইব্রাহিমের মহাত্যাগের স্মৃতিকে ভাস্কর করে রাখতে আল্লাহ স্বাবলম্বী মুসলমানদের জন্য কোরবানির বিধান অত্যবশ্যকীয় করেছেন। ইব্রাহিম যেভাবে নিজ মালিকের প্রেমে আপন পুত্রকে জবাই করতে চেয়েছিলেন মুসলমানরা সেভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পশু কোরবানি করে থকে। এভাবে ইব্রাহিম ও ইসমাঈল (আ)-এর স্মৃতিবাহী এই সব কর্মকান্ডের সাথে তাদের আত্মত্যাগ ও প্রভূপ্রেমের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ভাসে মুমিনের স্মৃতিপটে। তারা সবাই একসাথে সাদা কাপড়ে মোড়ানো দেহ নিয়ে স্মরণ করে জীবনের শেষ সময়ের কথা। মরণের পর যে এই দুটি কাপড়ই তাদের সম্বল তা খুব সহজে অনুমান করতে পারা যায় তখন। মুমিনের জীবন যে একটি সুশৃক্সক্ষলাবদ্ধ তা হজের ঐ সম্মিলিত নিয়ম আহকাম পালনের মাধ্যমে সবার মনে জাগ্রত হয়। হজের সফরের মাধ্যমে তারা শিক্ষা লাভ করে যে, এই জীবনটা একটা ক্ষণস্থায়ী সফরের মত। সফরের পর চলে যেতে হবে আমাদের স্থায়ী আবাসনে। যার জন্য পাথেও যোগাড় করার এখনই সময়।
এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে বান্দারা নিজ প্রভূর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের এক মহান সুযোগ লাভ করে। মাওলাপ্রেমিক প্রতিটি হৃদয় তাই হজ ও কোরবানিকে সামনে রেখে উপার্জন করে নেয় পরকালের যথেষ্ট পাথেয়। লেখক : লুৎফুর রহমান তোফায়েল,