মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান

    0
    387

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৩অক্টোবর,ডেস্ক নিউজঃ   রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কটে ভারতের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, রাখাইনে স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে। রবিবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠক শেষে উভয় দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

    ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় আসার পর রবিবার উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যৌথ কমিশনের বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জ্বালানি ক্রয় বিষয়ে দুইটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এছাড়া ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সৌজন্য বৈঠক করেছেন।

    রবিবার বিকেলে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, আমরা চাই নিরাপদে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যাক। তবে সেখানে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। রাখাইন এলাকার অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এই অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতও সহায়তা দিতে আগ্রহী। এছাড়া রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন দেখতে চায় ভারত।

    ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের চ্যালেঞ্জগুলো একই। সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও উগ্রবাদিতা দুই দেশের মধ্যে সমান চ্যালেঞ্জ। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের নেয়া জিরো টলারেন্স নীতির সঙ্গে আমরাও একমত হয়েছি।

    যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে ভারত যেন মিয়ানমারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করে সেজন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি বলেন, ভারত রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা দিয়ে আসছে, সেজন্য তাদের প্রতি আমরা বিশেষ কৃতজ্ঞ।

    মাহমুদ আলী বলেন, ভারতের বিপক্ষে সন্ত্রাসী কাজে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ-ভারত প্রতিবেশী দেশ, দুই দেশই পরস্পরের বিশ্বস্ত বন্ধু। বৈঠকে সুষমা স্বরাজকে আবুল হাসান মাহমুদ আলী স্মরণ করিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তার আমলেই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে।

    যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রবিবার দুপুরে দুইদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। ঢাকার কুর্মিটোলায় বঙ্গবন্ধু বিমান ঘাঁটিতে তার বিশেষ বিমান অবতরণ করলে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সুষমা স্বরাজকে স্বাগত জানান।

    পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যৌথ কমিশনের বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ, আন্তঃযোগাযোগ, সীমান্ত হাট, আঞ্চলিক যোগাযোগ, পর্যটন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি তোলা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের আরও জোরালো সমর্থন চেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বৈঠকে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর পারস্পরিক সফরে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা করেছে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমিশন।

    আজ সোমবার সকালে ভারতের অর্থায়নে বাস্তবায়িত ১৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন। ভারতীয় হাইকমিশনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশ নেবেন তিনি। সুষমা স্বরাজ সোমবার সকালে ভারতীয় হাইকমিশনের নতুন চ্যান্সারি ভবন উদ্বোধন করবেন। সে সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও উপস্থিত থাকবেন। সোমবার দুপুরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।

    গত এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের কোন শীর্ষ মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসলেন। এর আগে গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ পরামর্শক কমিশনের সভা একটি নিয়মিত বৈঠক। এটি দুই দেশের মধ্যে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এই বৈঠকে চলমান বিষয়াবলীও প্রাধান্য পেয়ে থাকে। সে কারণেই এবারের বৈঠকে রোহিঙ্গা বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। কেননা এটি এখন বাংলাদেশের একটি জাতীয় সঙ্কট হয়ে উঠেছে। আর এ সঙ্কট সমাধানে প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ভারতেরও উদ্বেগ রয়েছে। রবিবারের বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ রোহিঙ্গা নিয়ে গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করেছে।

    ২০১৫ সালের জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর চলতি বছর এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যেসব সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়েছে, তার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেছেন দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। একই সঙ্গে সহযোগিতার নতুন নতুন বিষয় নিয়েও আলোচনা করেছেন তারা।

    উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তৃতীয় যৌথ কমিশনের বৈঠক হয়েছিল। সে বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অংশ নিয়েছিলেন।

    দুইটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই ॥ যৌথ পরামর্শক কমিশনের বৈঠক শেষে উভয় দেশের মধ্যে দুইটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি বিষয়ক ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ও ভারতের নুমালিগড় রিফাইনি কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়া বৈঠক শেষে ইন্টারন্যাশনাল সোলার এ্যালাইন্সের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি বিষয়ক একটি দলিল হস্তান্তর করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

    যৌথ পরামর্শক কমিটির বৈঠক ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ পরামর্শক কমিটির বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের পাশাপাশি সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের বিষয়ে গুরুত্ব পায়। এছাড়া সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিজিবি ও বিএসএফের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়।

    বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতে পাটপণ্যে প্রবেশের ক্ষেত্রে এন্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করা হয়। এছাড়া আরও কয়েকটি সীমান্ত হাট স্থাপনে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে উভয় দেশের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের পাশাপাশি তিস্তা চুক্তির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত ৮ এপ্রিলে দেয়া বক্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া গঙ্গার পানির সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষ্যে ভারতের কাছ থেকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান (বিবিআইএন) সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে ভুটানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল (বিআইএন) বাস্তবায়নে জোর দেয়া হয়েছে। তবে ভুটান ইচ্ছে করলে পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে পারবে। এছাড়া ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের আওতায় বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

    বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জোর দেয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশে বিদ্যুত ও জ্বালানি সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত সরবরাহ করছে। বিদ্যুত সরবরাহের পরিমাণ আরও বাড়াবে বলে জানিয়েছে দেশটি।

    যৌথ পরামর্শক কমিটির বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়। ঢাকা-কলকাতার মধ্যে চালু মৈত্রী ট্রেন সার্ভিসে আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও কলকাতা-খুলনা বন্ধন ট্রেন সার্ভিস বাণিজ্যিকভাবে দ্রুত চালুর বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

    মুক্তিযুদ্ধের স্মারক উপহার ॥ যৌথ পরামর্শক কমিটির বৈঠক শেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক হিসেবে একটি পিস্তল উপহার দিয়েছে ভারত। এই পিস্তলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। পিস্তল স্মারকটি রবিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে প্রদর্শন করা হয়।জনকণ্ঠ থেকে