বহুমুখী সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংকটের মুখে মৃৎ শিল্প

0
370
বহুমুখী সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংকটের মুখে মৃৎ শিল্প
বহুমুখী সমস্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংকটের মুখে মৃৎ শিল্প

নাজমুল হক নাহিদ, আত্রাই (নওগাঁ) প্রতিনিধি: আমাদের দেশের প্রাচীনতম শিল্প হচ্ছে মৃৎ শিল্প। মৃৎ শিল্পীরা তাদের হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞানের মধ্যদিয়ে তৈরি করে থাকেন হরেক রকমের পণ্য। আজ কালের বিবর্তনে নওগাঁর আত্রাইয়ে মৃৎপণ্যের চাহিদা কমেছে, এতে করে আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছে মৃৎ শিল্পীরা।

‘মৃৎ’ মানে মাটি আর ‘শিল্প’ মানে নিজ হাতে তৈরি কোন সুন্দর জিনিস। এই মৃৎ শিল্প আবহমান গ্রাম-বাংলার মাটি ও মানুষের কথা বলে। বর্তমানে মৃৎ শিল্পীদের দুঃখ-কষ্টের মাঝে দিন কাটলেও নওগাঁর আত্রাইয়ের মৃৎ শিল্পীরা এখনও স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন আবারও কদর বাড়বে মাটির পণ্যের।

নওগাঁ জেলার ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী দাঁড়িয়ে থাকা আত্রাই উপজেলার রায়পুর ও ভবানীপুর পালপাড়া মৃৎ শিল্পের কারণে যেন শিল্পীর তুলিতে আকাঁ একটি স্বর্ণালী ছবি। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প। বহুমুখী সমস্যা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সংকটের মুখে পড়েছে শিল্পটি। তারপরও পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে অনেকেই।

আত্রাই উপজেলার রাইপুর, মিরাপুর, সাহেবগঞ্জ, বহলা, পাঁচুপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য কুটিরের নয়নাভিরাম মৃৎ শিল্পীদের বাসস্থান। এক সময় এই গ্রামগুলো মৃৎ শিল্পের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, প্রযুুক্তির উন্নয়ন ও নতুন নতুন শিল্প সামগ্রীর প্রসারের কারণে এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুকূল বাজারের অভাবে এ শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।

উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বসবাসকারী মৃৎ শিল্পীদের অধিকাংশই পাল সম্প্রদায়ের। প্রাচীনকাল থেকে ধর্মীয় এবং আর্থ-সামাজিক কারণে মৃৎ শিল্পে শ্রেণীভুক্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা মৃৎ শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে।

বর্তমান বাজারে এখন আর আগের মতো মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা না থাকায় এর স্থান দখল করে নিয়েছে দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ও প্লাস্টিকের তৈজষপত্র। ফলে বিক্রেতারা মাটির জিনিসপত্র আগের মতো আগ্রহের সঙ্গে নিচ্ছে না। তাদের চাহিদা নির্ভর করে ক্রেতাদের ওপর। সে কারণে অনেক পুরোনো শিল্পীরাও পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির জিনিসপত্র তার পুরোনো ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে এ পেশায় যারা জড়িত এবং যাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন মৃৎ শিল্প তাদের জীবন যাপন একেবারেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দুঃখ-কষ্টের মাঝে দিন কাটলেও আত্রাইয়ের মৃৎ শিল্পীরা এখনও স্বপ্ন দেখেন কোনো একদিন আবারও কদর বাড়বে মাটির পণ্যের। সেদিন হয়তো আবারও তাদের পরিবারে ফিরে আসবে সুখ-শান্তি। আর সেই সুদিনের অপেক্ষায় আজও দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা।

এ ব্যাপারে উপজেলার ভবানীপুর পালপাড়া গ্রামে ২৪ জুন সরেজমিনে জিতেনন্দ্রনাথ পাল এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বাপ-দাদার কাছে শেখা আমাদের এই জাত ব্যবসা আজও আমরা ধরে রেখেছি। নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলাসহ আশপাশের এলাকায় এক সময় মাটির তৈরি জিনিসের ব্যাপক চাহিদা ছিল কিন্তু বর্তমানে বহুমুখী সমস্যা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের এই মৃৎ শিল্পটি।

একই ব্যাপারে উপজেলার রায়পুর গ্রামের বিপ্লব কুমার পাল বলেন. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদী-খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন মাটি সংগ্রহে অনেক খরচ করতে হয় আমাদের। এ ছাড়াও জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে মিল না থাকায় প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে আমাদের। আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিল্পকর্মে প্রশিক্ষিত করে মৃৎশিল্পের সময়োপযোগী জিনিসপত্র তৈরিতে এবং বিদেশে এ পণ্যের বাজার সৃষ্টিতে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।

এদিকে উপজেলার সচেতন মহল ও বিশিষ্টজনরা মনে করছেন মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এর বাজার সৃষ্টি এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুবই জরুরি।

অপরদিকে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইকতেখারুল ইসলাম বলেন, “আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিল্পীদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে মৃৎশিল্পের বিদেশে বাজার তৈরি করা সম্ভব। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃৎশিল্পের প্রসারে জন্য আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবো।”