জীবন যুদ্ধে জয়ী এক জাহানারা’র গল্প

    0
    274

    আমার সিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৭মার্চ,হাফিজ রহমান,সুনামগঞ্জ থেকেঃ সুনামগঞ্জ জেলার বিশম্ভরপুর উপজেলার সলোকাবাদ ইউনিয়নের ভাদেরটেক গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম জাহানারা বেগমের। পিতা আব্দুল হক ও মাতা হাজেরা খাতুনের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে জাহানারা বেগম তৃতীয়। মাত্র ৩ বছর ৬ মাস প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ হয় তার। ভিটে বাড়ি ছাড়া বাবার আর কোন সম্পত্তি ছিলনা বিধায় নিদারুন অভাব অনটনের মধ্যে দিয়েবড় হন তিনি। ১৪ বছর বয়সে একই ইউনিয়নের চালবন গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে হাসান আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সংসারেও অভাব তার পিছু ছাড়েনি। গরীব কৃষক স্বামীর সামান্য রোজগারে তাদের সংসার চানালো কঠিন হয়ে পড়তো। ঠিক সেই সময় দারিদ্রতাকে পরাজিত করার প্রত্যয় নিয়ে ২০০৬ সালে তিনি একটি উন্নয়ন সংস্থায় স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নেন। সিবিআরএমপি নামক ঐ সংস্থা থেকে মাত্র চার হাজার টাকা ঋন নিয়ে চার শতক জায়গা নিয়ে একটি নার্সারি করেন। কঠোর পরিশ্রম এবং সংস্থাটির সহযোগিতায় তিনি তার জীবনকে পরিবর্তন করে এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল একজন নারী। চার শতক জমি নিয়ে শুরু করা নার্সারিটি এখন একশ শতক জমিতে বিস্তৃত। প্রায় ২৫ জাতের ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছের চারা পাওয়া যায় তার নার্সারিতে। উক্ত নার্সারি থেকে প্রতি বছর তাদের আয় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। উক্ত আয় দিয়েই তাদের সংসারের যাবতীয় খরচ মেটানো হয়। এছাড়া নার্সারির পাশেই তিনটি পুকুরে মাছের চাষ করা হয়। পুকুর গুলোর মাছ বিক্রি থেকেও প্রতি বছর ভাল একটা আয় আসে। স্থানীয় জেলা, উপজেলা এবং বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলো তার নার্সারি থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে চারা ক্রয় করে। প্রতি বছর কৃষি মেলায় তার নার্সারির একটা স্টলও থাকে।

    জীবন সংগ্রামে জয়ী জাহানারা শুধু তার আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেই থেমে থাকেননি। তিনে তার জীবন সংগ্রামের কথা অন্যদের কাছেও পৌছে দিতে চান। তিনি ”সিড়ি” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ২০১২ সালে এলজিআরডি ভবন ঢাকায় বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। কিভাবে সকল প্রতিকূলতা জয় করে উপরে উঠতে হয় বইটিতে তা তুলে ধরেছেন। এছাড়া তিনি “ধূপ পোঁড়া গন্ধ” নামে একটি উপন্যাসও রচনা করেন। ২০১৪ সালে ঢাকায় এলজিআরডি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন মাননীয় কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। এবং জীবনের অনেক না বলা কথা, প্রেম-বিরহ-নারী বিচ্ছেদ, দেশ ও মানুষের এবং ভক্তিমূলক গানসহ নারী জাগরনের গান নিয়ে তিনি প্রায় পাঁচশত গান রচনা করেন। সম্প্রতি সাংবদিক জিয়াউর রহমান লিটনের সম্পাদনায় “কাজল ধোয়া জল” নামে তার আরেকটি গানের বই প্রকাশিত হয়। এছাড়া “সংগ্রামী মানুষ” নামে আরও একটি বই লিখে শেষ করেছেন। বইটিতে তিনি গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। ৭১ পরবর্তী সময়ের একটি মেয়ের জীবন কাহিনী নিয়ে সম্প্রতি “স্বতী লক্ষী” নামে আরেকটি গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছেন এবং শীগ্রই সেটা লেখা শুরু করবেন।

    প্রবল ইচ্ছা শক্তি আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্যর উচ্চশিখরে পৌছানোর পরিষ্কার উদাহরণ এই জাহানারা বেগম। শত লাঞ্চনা-বঞ্চনা, বাধা-বিপত্তি কোন কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ব্যক্তিগত সফলতার পাশাপাশি পেয়েছেন জাতীয় সম্মান। ২০১০ সালে ৮ মার্চ সফল নারী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের কাছ থেকে তিনি সম্মাননা ক্রেস্ট গ্রহন করেন। এছাড়া গত ১৫.১১.২০১৫ তারিখে বেসরকারী টেলিভিশন মাছরাঙ্গায় তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। প্রভাতি নামক উক্ত অনুষ্ঠানে তিনি দেশের কোটি কোটি দর্শকের সামনে তার সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরেন। তাছাড়া দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দৈনিক প্রথম আলোর ১৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যায় জয়ীতা হিসেবে তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এছাড়াও জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা থেকেও তাকে সফল নারী ও উদ্যোক্তা হিসেবে পুরষ্কৃত করে সম্মানিত করা হয়।

    বর্তমানে তিনি গ্রামের অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন নারীদের আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। জাহানারা বেগম নিজ এলাকায় “এসো কাজ করি” নামে একটি নারী সংগঠন গড়ে তুলেছেন । তার নেতৃত্বে বাল্য বিবাহ, কিশোরিদের ঝরে পড়া রোধ, যৌতুক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও বন্ধ করার লক্ষ্য সংগঠনটিকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া মা ও শিশুর যত্ন, হতদরিদ্র মহিলাদেরকে বিজিডি, বিজিএফ এবং বিধবা ভাতা ইত্যাদি সেবা নিশ্চিত করার জন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।

    জীবন সংগ্রামে জয়ী এই নারী ব্যক্তিগত জীবনে দুই সন্তানের জননী। দুই ছেলে আর স্বামীকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। তার বড় ছেলে বেলাল আহমদ সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে এখন এমসি কলেজে স্নাতকোত্তরে অধ্যায়নরত। ছোট ছেলে হেলাল আহমদ সুনামগঞ্জ সরকারী কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরিক্ষার্থী। ব্যক্তিগত জীবনে জাহানারা বেগম বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের একনিষ্ঠ ভক্ত। বাউল সম্রাটের উৎসাহ এবং প্রেরণাতেই তিনি নিজের জীবন বদলানোর চিন্তায় জাগ্রত হন এবং তারই অংশ হিসেবে আজকে তিনি দেশের একজন সফল নারী। তিনি স্বপ্ন দেখেন এদেশের প্রতিটি নারী একদিন নিজস্ব অবস্থান থেকে প্রতিষ্ঠিত হবে। নারীদের স্বচ্ছলতাই দেশ পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে কাজ করবে বলে তিনি মনে করেন।