চা-শ্রমিকদের দাবী না মানা পর্যন্ত ধর্মঘট ও আলোচনা একসাথেই চলবে  

0
181

জহিরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টারঃ সিলেট ও চট্টগ্রামের লক্ষাধিক  চা শ্রমিকের মজুরি এখনও ১২০ টাকা। অসুখ হলে বাগানের ট্রলি গাড়ি দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো,চা বাগানের হাসপাতালে নাপা,  মেট্রিল ও খাওয়ার স্যালাইন ছাড়া কোন ঔষুধ দেওয়া হয় না,রক্ত পানি করে পেটে বাচ্চা নিয়ে বাগানে কাজ করেও সেই বাচ্চার শিক্ষার সুযোগ নেই নামে মাত্র ১২ বছর পর্যন্ত রেশন প্রদানের দাবীসহ ডজন খানেক অভিজ শ্রমিকদের।  

প্রথমে ১২০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার ব্যানারে আন্দোলন শুরু হলেও মীমাংসার সার্থে আলোচনার টেবিলে ৩০০ টাকা মজুরি করার দাবিতে চলমান চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট নিরসনে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী এনডিসি।

দিনভর দু-তিন দফায় বৈঠক করেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে আগামীকাল ১৭ আগস্ট বুধবার ঢাকায় মহাপরিচালকের কার্যালয়ে বিকাল ৪ টায় দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করবে শ্রম অধিদপ্তর।

সভায় উপস্থিত বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারি।

এদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। তবে মহাসড়কে অবস্থান কর্মসূচী প্রত্যাহার করেছেন শ্রমিকরা।নিজ নিজ চা বাগানে বিক্ষোভ মিছিল অবস্থান কর্মসূচী ও ধর্মঘট পালন করা হবে শান্তিপূর্ণভাবে। 

মঙ্গলবার (১৬আগষ্ট) দুপুর পৌনে ১২ টা থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে চা-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। প্রায় তিন-চার ঘণ্টাব্যাপী দু-তিন দফায় এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চা-বাগান শ্রমিক ভবিষ্যৎ তহবিলের নিয়ন্ত্রক (উপসচিব) শেখ কামরুল ইসলাম, পরিচালক মো. গিয়াস উদ্দিন, মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোছাঃ শাহীনা আক্তার, হবিগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সাদিকুর রহমান, হবিগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন) শৈলেন চাকমা, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন,শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সন্দ্বীপ তালুকদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ সার্কেল) মোঃ শহীদুল হক মুন্সী,সিলেট এনএসইআই এর যুগ্ম পরিচালক বজলুর রহমান, উপ-পরিচালক দাদন মুন্সী, বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুর রহমান এবং শ্রম কর্মকর্তা মোসাহিদ চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনর্চাজ শামীম উর রশিদ তালুকদারসহ প্রমুখ।

সভায় উপস্থিত অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ও চা-বাগান প্রতিনিধিদের একাংশ। ছবি আমার সিলেট প্রতিবেদক

চা-শ্রমিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন,  বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা পরাগ বারই, সভাপতি মাখন লাল কর্মকার, সহ সভাপতি পংকজ কন্দ, সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নিপেন পাল, সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা, অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দিসহ বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও সিলেট ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভ্যালির নেতৃবৃন্দ।

সভায় চা-শ্রমিক নেতারা উম্মুক্ত আলোচনায় তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তুলে ধরেন।শ্রমিক নেতারা বলেন, চা-শ্রমিকেরা ১২০ টাকা মজুরি দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকেরা জীবন যাপন করতে হিমশিম খাচ্ছেন। সন্তানদের পড়ালেখা করানোর জন্য বিভিন্নভাবে ঋণ করতে হয়। চা-বাগানের চিকিৎসাব্যবস্থা খুবই খারাপ। কোনো রোগী অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না।ইমারজেন্সি রোগীকে বাগানের ট্রলি দিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। গত করোনাকালীন সময়ে সবকিছু যখন বন্ধ, তখন চা-শ্রমিকেরা জীবন বাজি রেখে চা–শিল্পের জন্য কাজ করেছে। কোনো চা-বাগান করোনার সময় বন্ধ হয়নি। উৎপাদন করা হয়েছে রেকর্ড পরিমানের বেশি, তারপরেও কেন মজুড়ি বৃদ্ধির নামে তালবাহানা করছে মালিক পক্ষ।

সভায় উপস্থিত চা শ্রমিকদের একাংশ। ছবি আমার সিলেট প্রতিবেদক

 নারী চা-শ্রমিক নেত্রীরা বলেন, চা-বাগানে নারী শ্রমিকদের শৌচাগার নেই। এ জন্য চা-বাগানের ভেতরেই শৌচকর্ম সারতে হয়। চা-বাগানের নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি কম পান, গর্ভবতী নারীরা পেটে সন্তান নিয়েও কাজ করেন অথচ এই সন্তানের বাগানে কোন অধিকার নেই, না আছে লেখা পড়া করার কোন সুবিধা না আছে তাদের চিকিৎসার সুবিধা। চা-বাগানের বেশির ভাগ মানুষ ঘরের ভেতর গাদাগাদি করে থাকেন। এই অবস্থায় যদি এত কষ্ট করে কাজ করেও মজুড়ি বৃদ্ধি না হয়, তাহলে তাঁরা চা-বাগানের কাজ করবে কেন?

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালি সভাপতি বিজয় হাজরা  বলেন, সরকার তার প্রতিনিধি পাঠিয়েছে বলে আমরা এখানে আলোচনায় এসেছি। এখানে আমাদের শ্রমিকনেতারা তাঁদের সমস্যা ও বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন। কিন্তু মজুরির বিষয়ে মহাপরিচালক কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি। তিনি আমাদের আন্দোলন বন্ধ রেখে ২৩ আগষ্ট  পর্যন্ত অপেক্ষা করতে প্রস্তাব দেন। আমরা সেটা মানিনি। পরে তিনি আমাদের আগামিকাল বুধবার ১৭ আগষ্ট ঢাকায় আলোচনায় বসতে বলেন। সেখানে মালিকপক্ষও থাকবে আমরা বলেছি বাগান ভিত্তিক আমাদের আন্দোলন চলবে আলোচনা ও চলবে। যতক্ষণ আমাদের দাবি আদায় না হবে ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে এ সময় তিনি গণমাধ্যম কর্মিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

আন্দোলনরত চা শ্রমিকদের একাংশ। ছবি আমার সিলেট

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দী বলেন, “আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। মহাসড়ক অবরোধ প্রত্যাহার করেছি। তবে আমাদের নিজ নিজ বাগানে অবস্থান কর্মসূচী ও আন্দোলন চলবে, কলকারখানা চলবে না।কেহ কোন সেকশনে কাজে ফিরবে না। আমাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন ও আলোচনা একসাথে চালিয়ে যাবো।

এদিকে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের বলেছি সবার স্বার্থে আপাতত আন্দোলন বন্ধ করতে। আগামী ২৩ তারিখ মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ ও আমরা তিন পক্ষ মিলে সভায় সবার কথা তুলে ধরবেন। এই মুহূর্তে মালিকেরা কত টাকা মজুরি দেবে, সেটা বলার এখতিয়ার আমার নেই।সেটা আলোচনায় বসে তারা দুই পক্ষ ঠিক করবে।কি ভাবে বসাতে হয় সেটা আমরা ব্যাবস্থা করবো। দরকার হলে বারবার আলোচনা হবে। আপনারা জানেন এ সরকার শ্রমিক বান্ধব সরকার।আমরা চাই একটি শ্রমবান্ধব পরিবেশ, শিল্পবান্ধব পরিবেশ। আন্দোলনে দুই পক্ষেরই ক্ষতি হচ্ছে কেননা এখন চায়ের ভরা মৌসুম।তাই আমি তাদের ১৭ আগস্ট বুধবার বিকাল ৪ টায় ঢাকায় অধিদপ্তরের কার্যালয়ে আমরা বসবো যতক্ষণ না সিদ্ধান্ত হচ্ছে ততক্ষণ আলোচনা চলবে।  

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here