চাঁদপুর বন্দর থেকে চান্দপুর চা বাগান

    0
    279

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৬জানুয়ারী,পাভেল পার্থঃ ১৮৪৫ সনে সিলেটের মালনী ছড়া চা বাগানে প্রথম বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। ভারতের পাহাড়, অরণ্য, সমতল নানা জায়গা থেকে অন্যায়ভাবে আদিবাসীদের ধরে এনে বানানো হয় বন্দী দাস। চাবাগানের ভাষায় কুলি, বইয়ের ভাষায় চা শ্রমিক। ৭৬ বছর পর দীর্ঘ বন্দীদশার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় শ্রমিকেরা। শুরু করে মুলুকে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন। নানা বাগান থেকে দিনের পর দিন উদ্বাস্তু শ্রমিকের সারি এসে জড়ো হয় চাঁদপুর মেঘনা নদীবন্দরে। ২০ মে তৎকালিন রাষ্ট্র পুলিশ আর বাগান কর্তৃপক্ষ চাশ্রমিকদের মেরে কেটে ফালি ফালি করে দেয়। হাজারো লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় মেঘনায়। যারা বেঁচেছিল তাদের আবারো ধরে বেঁধে এনে ঢোকানো হয় চাবাগানে। মুলুকযাত্রা আন্দোলনের প্রায় ৯৪ বছর পর আবারো চাবাগান ফুঁসে ওঠেছে। এবার আর চাঁদপুরের মেঘনা নদীবন্দর নয়, হবিগঞ্জের সুতাং নদীর ধারের চান্দপুর চাবাগানে। চাবাগানীদের ১৫০ বছর ধরে ব্যবহৃত ৫১১ একর কৃষিজমি কেড়ে ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল’ তৈরি করতে চাচ্ছে রাষ্ট্র। চাবাগানের ১৫০ বছরের ইতিহাস এমনি, কোম্পানি ও রাষ্ট্রের জোর জবরদস্তি আর প্রশ্নহীন জুলুম। কিন্তু লাগাতার জুলুমের বিরুদ্ধে ইতিহাস থেকে ইতিহাসে জানবাজি রেখে দাঁড়িয়েছে চাশ্রমিক নিম্নবর্গ। চাঁদপুর মেঘনা নদীবন্দর থেকে আজকের চাঁন্দপুর চা বাগান।

    ২.সুখদেব মুন্ডার মা-বাবাদের জোর করে চাঁদপুর নদীবন্দর থেকে আবারো আনা হয় চান্দপুর চা বাগানে। সুখদেবের বিয়ে হয় বিনোতা মুন্ডার সাথে। বিনোতা মুন্ডা ছিলেন চান্দপুর বাগানের ‘নামধারী’ মানে স্থায়ী শ্রমিক। তাদের ২ ছেলে ১ মেয়ে। বিনোতা অবসর নেয়অর পর বড় ছেলে বরুণ মুন্ডার বিনোতার কাজটি পায়। কিন্তু বরুণের ছোট ভাই অরুণ মা-বাবা ও বোনকে নিয়ে চান্দপুর বাগানের ১নং লোহারপুল লেবার লাইনে থাকে। তাদের কোনো কাজ নেই বাগানে। অরুণ চান্দপুর চাবাগানের স্কুল থেকে প্রাথমিক পাশ করে চুনারুঘাটের আমতলী অগ্রণী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ২০০০ সনে। ২০১৫ সনের পয়লা জানুয়ারি থেকে চাশ্রমিকদের দৈনিক মজুরি নির্ধারিত হয়েছে ৮৫ টাকা। কিন্তু অরুণের ভাই বরুণ দৈনিক ৬৯ টাকা মজুরি পায় আর সপ্তাহে একদিন রেশনের আটা। তাহলে সন্দেহ জাগে অরুণেরা খায় কী, দায় কী? বেঁচে থাকে কীভাবে? বর্তমানে প গড়ের নতুন প্রতিষ্ঠিত ৭টি বাগানসহ বাংলাদেশে মোট চাবাগান ১৬৩টি। চাবাগানের ১,১৫,০০০ হেক্টর জমির পুরোটাই সরকারি খাস জমি। আর বিস্তীর্ণ এই চাবাগানে বসবাস করছেন দুই লাখ শ্রমিকসহ প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এই যে চাবাগানে প্রায় আট লাখ মানুষ যাদের চাবাগান কোনো কাজ দিতে পারেনি, এই বিশাল জনমিতি কীভাবে তাহলে টিকে থাকছেন? আর তরতাজা করে চলেছেন জাতীয় অর্থনীতি? দিনমজুরি, কৃষিমজুরি আর ক্ষেতল্যান্ডে চাষাবাদ করে। ক্ষেতল্যান্ড হলো চাবাগানের ভেতর বা ধারেকাছের টিলাভূমির ভেতর বিস্তৃত সমতল ভূমি। ভাওয়াল ও মধুপুর শালবন অ লে যে জমিন বাইদ নামে পরিচিত। একজন নামধারী শ্রমিক চাবাগান কর্তৃপক্ষ থেকে এক কেয়ার (১ একর=২.৪৭ কেয়ার) জমিনে চাষাবাদের সুযোগ পায়। অরুণেরা এমনি এক কেয়ার জমি পেয়েছেন, পাশাপাশি অন্য দুই পরিবারের আরো দুই কেয়ার জমি ভাগে চাষ করেন। সব মিলিয়ে তিন কেয়ার ক্ষেতল্যান্ডে চাষাবাদ করেই মূলত: বেঁচে থাকে অরুণের মতো লাখো লাখো চাবাগানি পরিবার। যাদের যাবতীয় ক্লান্তি মুচরে চাপাতায় জমা হয় ক্লান্তি নিবারণের রসায়ন। আর এই রসায়নের আদি অন্তের হদিশ না করেই প্রতিদিন সহ¯্র কোটি পেয়ালা ভরে ওঠছে চায়ের রসে।

    ৩.কিন্তু অরুণদের মন ভাল নেই। প্রায় বছর গড়িয়ে চললো। অরুণদের মতো চান্দপুর, বেগমখান, রামগঙ্গা ও জোয়ালভাঙ্গা চাবাগান দু:সহ যন্ত্রণার কাল পাড়ি দিচ্ছে। কারণ সরকারের ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল’ অরুণদের ৫১১.৮৬ একর ক্ষেতল্যান্ড জমি কেড়ে নিতে চাইছে। বছরে দুই মওসুমে ধান ফলিয়ে প্রায় ১৩০০ পরিবারের ভাতের জোগান দেয় এই জমিন। প্রায় ১৫০ বছর ধরে ঝোপ জলার এই জায়গাকে কৃষিজমিনে তৈরি করেছে অরুণদের পূর্বসুরীরা। সকল ঐতিহাসিক শর্ত আর সম্পর্ককে ভেঙেচুরে রাষ্ট্র ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল’ করার জন্য মরিয়া হয়েছে। শ্রমিকসহ চাবাগানি জনগণ শিল্পায়নের সপক্ষে দাঁড়িয়ে কৃষিজমিন সুরক্ষায় শুরু করেছেন ন্যায্য আন্দোলন। গঠিত হয়েছে ১১১ সদস্য বিশিষ্ট ‘চান্দপুর-বেগমখান ভূমি রক্ষা কমিটি’। চাবাগানের নিজস্ব কোনো জমি নাই, রাষ্ট্র কোম্পানি ও ব্যাক্তিকে নানা শর্তে জায়গা ইজারা দিয়েছে। চাবাগানের জন্য ইজারাকৃত জমির ভেতর প্রায় ১১ ভাগ মানে ৩০ হাজার ৭৪৩ একর হচ্ছে ক্ষেতল্যান্ড। চুনারুঘাট উপজেলায় চাষযোগ্যে জমির পরিমাণ ১,২২,৩৯৩ একর। খাস জমির পরিমাণ ৪৪৩৬ একর এবং ‘পতিত’ জমির পরিমাণ ১৬৫৪৪ একর। ভূমি রক্ষা কমিটি লাগাতার অবস্থান, কর্মবিরতি, স্মারকলিপি পেশ, মানবন্ধন, সভা, সমাবেশ, আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। নানাভাবে রাষ্ট্রকে শিল্পায়ন ও কৃষিঘনিষ্ঠ অর্থনীতির ময়দানে সামিল হওয়ার আহবান জানাচ্ছে।

    ৪.কিন্তু রাষ্ট্র অন্যায়ভাবে ১৫০ ধরে ভোগদখলে রাখা জমি মালিকদের না জানিয়ে, তাদের পূর্ব সম্মতি না নিয়েই বরাদ্দ দিয়েছে শিল্পায়নের জন্য। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ আসলে দেশের বিদ্যমান আইন লংঘন ও সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সার্বিক ভূমিজরিপ ও অবস্থা না জেনে তারা কৃষিজমিকে রাষ্ট্রীয় নথিতে ‘পতিত ও অব্যবহৃত জমি’ বানিয়েছে। বছরে প্রায় তিন কোটি টাকার ধানের জন্ম দেয়া কোনো জমিনকে ‘পতিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা অন্যায় এবং এই আচরণ প্রবলভাবে লিঙ্গদেমাগি। রাষ্ট্রীয় কোনো আশা জাগানিয়া উন্নয়নের একেবারেই সূচনালগ্ন থেকেই এমন বৈষম্য ও জবরদস্তি আশা করা যায় না। ‘প্রস্তাবিত কৃষিজমি সুরক্ষা আইন ২০১৫’ এবং ‘জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০১০’ সরাসরি কৃষিজমিতে শিল্পকারখানা স্থাপনকে নিষিদ্ধ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষিজমি রক্ষা করে শিল্পায়নের ঘোষণা দিয়েছেন। ২০১৫ সনের ২৫ নভেম্বর চুনারুঘাট উপজেলা ভূমি অফিস উল্লিখিত কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অ ল গড়ে তোলার অনুমোদন দেয় ‘জাতীয় ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অ ল কর্তৃপক্ষকে (বেজা)’। চান্দপুর চাবাগানের ক্ষেতল্যান্ড জমি ৯১৫ একর। ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অ লের’ জন্য চিহ্নিত ৫১১ একর কৃষিজমিও এরই অন্তর্গত, তবে বলা হচ্ছে এই অংশটুকু ডানকানের ইজারাভূক্ত নয়। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ডানকান ও বাগান কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ‘না জানার ভান দেখিয়ে’ যাবতীয় দায়িত্ব থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চাইছে। যেন মালিক-কোম্পানি আর শ্রমিক-মজুর বোন-ভাই। সমস্যা যা তা সরকারের সাথে। ডানকান, ব্রিটিশ এই কোম্পানি চান্দপুর চাবাগানের চলতি সময়ের ভূমিতর্ককে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যকার দরবার হিসেবে দেখছে না। তারা রাষ্ট্র বলতে সরকার ও সরকারের রাজনৈতিকতাকে প্রকট করে তুলছে মানুষের মনে। চুনারুঘাটে ১২টি চাবাগানের ৫টি বড় বাগানই ডানকানের। আর এই ডানকানকে না জানিয়ে রাষ্ট্র এতো বিশাল একটি জায়গা ব্যবহার করবে এটি কী বিশ্বাস করা যায়!

    ৫.এক বছর ধরে নানাভাবে প্রতিবাদ জানালেও চান্দপুর চাবাগানের চলমান সংগঠিত আন্দোলনটি শুরু হয় ২০১৫ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথম থেকেই চাগানের নারীরা চান্দপুর ভূমি রক্ষা আন্দোলনের প্রাণপ্রবাহ জাগ্রত রেখেছেন। এর ভেতর ২০১৬ সনের প্রথম দিনের বিশাল জমায়েত ও বিক্ষোভ সমসাময়িককালের এক অবিস্মরণীয় অবস্থান ছিল। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার দূর্গাপুর গ্রামের সজল মুন্ডা স্থানীয় তৈয়বুন্নেসা খানম একাডেমী কলেজের ছাত্র। শুরুর দিকে ভূমি রক্ষা আন্দোলন নিয়ে তার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। কারণ চোখের সামনে রতনা চাবাগানকে খুন হতে দেখেছে সে। মালিক ও সরকার গলাটিপে যেন একের পর এক হত্যা করেছে চাশ্রমিকদের। ২৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের শমসেরনগর চৌমোহনী চত্বরে ‘চা ছাত্র যুব পরিষদ’ ভূমিরক্ষার দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সজল মুন্ডাদের মতো অনেকেই যারা শ্রমিক বা চাবাগানবাসী নয় তারাও জড়িয়ে পড়ে এই আন্দোলনে। নানা সংগঠন ও ব্যক্তি সংহতি জানাচ্ছে। চাশ্রমিকদের অধিকার আদায়ে শহীদ শ্রীমঙ্গলের কালিঘাট চাবাগানের বসন্ত বুনারজি তখন মাত্র নবম শ্রেণিতে পড়তেন। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ সময়। চাবাগানের আন্দোলনগুলোতে ছাত্র-যুবদের তেমন একটা অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতা থাকেনি। নামধারী ও অস্থায়ী চাশ্রমিকদের সাথে বড় অংশটি বরাবরই ছিল নারীদের আর প্রবীণ কিছু মানুষও। এমনকি মা-বাবারা শিশু-বাচ্চাদের নিয়েও দিনের পর দিন অবস্থান করেছে নানা সময়ে নানান দাবির আন্দোলনে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো একটা বড় সময় জুড়ে চাবাগান বিষয়ে বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ ছিল বলে এ সংক্রান্ত খবরাখবর আমরা একেবারেই জানি না। বিশেষ অর্থনৈতিক অ ল গড়ে তোলার পেছনে যুক্তি দেখানো হচ্ছে এখানে অনেককে চাকরি দেয়া হবে। এতে কিন্তু চাবাগানের এক বিশাল বেকার ও দিনমজুর যুবপ্রজন্মের এই প্রলোভনের সাথেই থাকার কথা। কিন্তু সব হাতছানি আর আশ্বাসের জগঝম্প পেছনে ফেলে চান্দপুর ভূমি রক্ষা আন্দোলনে ছাত্র-যুব তরুণ প্রজন্মের এক বিশাল স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ তৈরি হয়েছে। এ হচ্ছে এক দুর্বার টান। প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশের ব্যাকরণে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে দেখার আহাজরি। চাবাগানের নতুন প্রজন্মের ভেতর এই আহাজারি জাগ্রত আছে। এভাবেই দেশজুড়ে ঢাকার শাহবাগ থেকে চান্দপুর চাবাগানে জাগছে তারুণ্য। তারুণ্যের এই জাগরণসমূহ একত্র করা জরুরি। দেশের নানা প্রান্তের নানাভাবের জাগরণের ব্যাকরণ থেকেই নির্মিত হবে সত্যিকারের গণজাগরণ। একটি জাগরণ আড়াল করে অন্য জাগরণের কোনো হদিশ থাকবে না। সব জাগরণই গুরুত্ববহ। দেশের সবপ্রান্তের নতুন প্রজন্মকেই এটি বুকের গভীর থেকে বুঝতে হবে। চান্দপুর চাবাগানের চলমান আন্দোলনে দেশের নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসুক। রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করুক। চাবাগানিদের কৃষিজমি ফিরিয়ে দিয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অ লের নীতি ও নমুনা তৈরি হোক নতুন প্রজন্মের জ্ঞান, কারিগরি আর ঘামের ¯্রােতে। চা ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা মোহন রবিদাস চান্দপুর চাবাগানের চলমান আন্দোলন বিশ্লেষণ করে জানান, …প্রতিদিন আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটি মাইলফলক, কিন্তু গণমাধ্যম তেমনভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরছে না। এটি কেবলমাত্র গরিব চাশ্রমিকদের অস্তিত্বের লড়াই নয়, এটি কৃষি রক্ষার প্রশ্ন, আমাদেরকে অবশ্যই এটি বুঝতে হবে। আর এ কাজে দরকার আরো বেশি তরুণদের উপস্থিতি।

    ৬.আগামী ৯ জানুয়ারি শনিবার চান্দপুর চাবাগানে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে ভূমি রক্ষা কমিটি। আশা করি তরুণ প্রজন্ম এই সমাবেশ সফল করে তুলবে। বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবে কৃষিজমি। আর সেখান থেকেই শুরু হবে চাবাগানের মর্যাদা আর বেঁচে থাকবার এক মানবিক সংগ্রাম। গবেষক ও লেখকঃপাভেল পার্থ