কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ

    0
    423

    কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজ শুক্রবার দুপুর দুইটার দিকে শতবর্ষী বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। শহীদ মিনারে ঢাকার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিনোদবিহারী চৌধুরীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বিউগলে বিদায়ের করুণ সুর বাজানো হয়। Binod Bihari death news
    আজ দুপুরে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ কলকাতা থেকে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আনা হয়। দুপুর ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সাইফুজ্জামান শিখর বিনোদবিহারী চৌধুরীর মরদেহ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যমবিষয়ক বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল এ কথা জানান।
    বিনোদবিহারীর মরদেহ হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে মরদেহ রাখা হবে চট্টগ্রামের যাত্রামোহন সেন মিলনায়তনে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষমূর্তির পাদদেশে। সেখান থেকে সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। রাতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক আন্দোলনের অগ্রসেনানী বিনোদবিহারীর শেষকৃত্য হবে নগরের অভয় মিত্র শ্মশানে।
    গত বুধবার রাতে ১০৩ বছর বয়সে বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী কলকাতার ফর্টিজ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি শেষ ইচ্ছায় বাংলাদেশে তাঁকে সমাহিত করার কথা জানিয়ে গেছেন বলে জানান তাঁর ছেলে সৌমশুভ্র চৌধুরী।

    অগ্নিযুগের প্রবাদ পুরুষ বিপ্লবী বিনোদ বিহারীর মৃত্যুতে ওয়ার্কার্স পার্টির শোক

    বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক এক শোক বিবৃতিতে বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামের অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, শতায়ু বিপ্লবী এই মহান পুরুষ মাস্টার দা সূর্য সেনের সান্নিধ্যে থেকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলার কালের সাক্ষী। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দৃঢ় আস্থাবান এই প্রবীণ বিভিন্ন সময়ে তাঁর অভিজ্ঞতা লব্ধ পরামর্শ দিয়ে জাতিকে সংকট উত্তরণে সাহায্য করেছেন। তার এই মৃত্যুতে জাতি একজন প্রাজ্ঞ অভিভাবককে হারালো যা পূরণ হবার নয়। বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ প্রয়াত কমরেড বিনোদ বিহারীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার ও শুভান্যুধায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

    বিনোদবিহারী চৌধুরীর জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। তাঁর মা শ্রীমতী রমা রানী চৌধুরী, পিতা কামিনীকুমার চৌধুরী। ১৯২৯ সালে পি সি সেন সারোয়াতলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায়বাহাদুর বৃত্তি পান।
    ১৯২৭ সালে ১৬ বছর বয়সে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সংস্পর্শে এসে বিপ্লবী দল যুগান্তরে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী থাকাকালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ‘ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বাহিনীর’ সদস্য হিসেবে অংশ নেন চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে।
    ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিনোদবিহারী অন্য চার সহযোদ্ধার সঙ্গে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগার দখল চেষ্টায় অংশ নেন। দখলের পর তাঁরা দেশীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং সূর্যসেনকে রাষ্ট্রপতি করে ‘অস্থায়ী গণতন্ত্রী বিপ্লবী সরকারের’ ঘোষণা দেন। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল জালালাবাদ যুদ্ধেও অংশ নেন বিনোদবিহারী। ওই যুদ্ধে তাঁর গলায় গুলি লাগে। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জীবিত বা মৃত ধরতে ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
    বিনোদবিহারী ১৯৩৩ সালে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। ভারতের রাজপুতনার দেউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৩৪ সালে প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন। ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংশন পেয়ে বিএ পাস করেন। ১৯৩৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর আবার তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। প্রায় এক বছর গৃহবন্দী থাকাকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তিনি ইংরেজিতে এমএ ও বিএল (আইন) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।
    গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বিনোদবিহারী চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাঞ্চজন্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। এ সময় তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪১ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। কারাগারে থাকা অবস্থায় বিনোদবিহারী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।
    বিনোদবিহারী চৌধুরী ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে ধর্মভিত্তিক পৃথক নির্বাচনের পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচনের আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান দেশের সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিনোদবিহারী অবসরে যান। ১৯৬৯ সালে স্বৈরশাসনবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
    শুরুতে সাংবাদিকতা ও আইন পেশায় যোগ দিলেও পরে তাতে আর যুক্ত থাকেননি বিনোদবিহারী চৌধুরী। শেষ জীবনে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন শিক্ষকতাকে। প্রায় শতবর্ষ বয়স পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের মোমিন সড়কের বাসায় তিনি ছাত্রদের পড়িয়েছেন।
    দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের পর নানা সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থান-পতন টলাতে পারেনি মহান এই বিপ্লবীকে। ১৯৬৮ সালে তাঁর দুই ছেলে সুবীর চৌধুরী, বিবেকানন্দ চৌধুরীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা কলকাতায় স্থায়ী হন। কিন্তু তিনি সস্ত্রীক বাংলাদেশে থেকে যান। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর হারান ৭০ বছরের দাম্পত্য জীবনের সঙ্গী বিভারানী চৌধুরীকে। বিনোদবিহারীর জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে মোমিন সড়কের বাসাতেই।
    স্বাধীন বাংলাদেশে বিনোদবিহারী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। তবে দেশের সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অধিকারভিত্তিক আন্দোলনে ছিলেন অগ্রবর্তী সৈনিক। স্বৈরাচারবিরোধী, জঙ্গিবাদবিরোধী ও সামাজিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এই অগ্নিপুরুষ।
    ২০০০ সালে বিনোদবিহারী স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ গুণীজন সম্মাননা, ১৯৯৮ সালে ভোরের কাগজ সম্মাননা, শহীদ নতুনচন্দ্র স্মৃতিপদক।