ঢাকা, ০৮ আগস্ট : ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ মানবকল্যাণধর্মী জীবন ব্যবস্থা হিসেবে এতে মানুষের জন্ম থেকে নিয়ে মৃত্যু পযর্ন্ত প্রয়োজনীয় সকল বিধি-বিধান, নিয়ম-পদ্ধতি, চাওয়া-পাওয়ার সুন্দর সমাধান দিয়েছেন মহান আল্লাহ। নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন জীবনের সকল কাজের একটি নিয়ম-পদ্ধতি, মানদন্ড ও সীমারেখা। দেখিয়ে দিয়েছেন জীবনের সবচেয়ে সহজ ও সুন্দরতম পথনির্দেশনা। এরই মধ্যে ঈদ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর জীবনের একটি আনন্দ উৎসব। মুসলিম জীবনের নিজস্ব স্বকীয়তা-সংস্কৃতির এক বিশেষ অধ্যায়। এটি হচ্ছে পরস্পরের ভালোবাসাবাসির উৎসব, মানবতার উজ্জীবনের উৎসব, সাম্য-ন্যায়-ভ্রাতৃত্বের মহান শিক্ষার উৎসব। জাতীয় ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠা, বিবেক ও মানবতাবোধ জাগ্রত করা, আভিজাত্যের অহঙ্কার এবং সামাজিক ব্যবধান বিলুপ্ত করে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি গড়ে তুলার এক মহান সুযোগ।
প্রতি বছরই দু’বার আমাদের জীবনে আসে দু’টি উৎসব। একটি ঈদুল ফিতর অপরটি ঈদুল আদহা। মুমিন জীবনের সংশোধন ও প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে পবিত্র রমজানের শেষে মাহান আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের দিনটি দিয়েছেন। রামাদানের সিয়াম সাধনার এক মাস শেষে পরবর্তী এগারো মাস রামাদান মাসের শিক্ষার আলোকে কাটানোর শুরুর মূহুর্তে এদিনটি এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। এ দিনে মুসলিম উম্মাহ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয় নতুন করে। উঁচু নিচু ভুলে সবাই এক হয়ে যায় এ দিনটির জন্য। সবার মুখে ফুটে আনন্দের হাসি। ধনী-গরীব, ছোট-বড়, ইতর-ভদ্র, শাসক-প্রজা, সাদা-কালো ভেদাভেদ ভুলে সবাই দাঁড়িয়ে যায় এক কাতারে। মহান মুনিবের বান্দা হিসেবে ভাই-ভাই হয়ে আদায় করে ঈদের সালাত। এক মহামিলনের সুযোগ হয়ে উঠে ঈদ উৎসবে। সকল শ্রেণী ও বর্ণ বৈষৈম্য ভুলে এক প্রভূর বান্দা হিসেবে কোলাকুলি করে পরস্পরে। সে এক জান্নাতি আবেশ বিরাজ করে পৃথিবীজুড়ে। এটাই ঈদের শিক্ষা। কবি গোলাম মোস্তফা একে অত্যন্ত সুন্দর শব্দে ছন্দায়িত করেছেন-
ভ্রাতৃ প্রণয়ের মহান দৃশ্য, মিলন কলগানে মুখর বিশ্ব
বিভেদ জ্ঞান যত আজিকে সব হত, ধন্য ঈদ তুমি ধন্য।
এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে আমাদের মাঝে কোন পারস্পরিক বৈষম্য কিংবা বৈপরিত্ব নেই। তাই এ শিক্ষার আলোকে একটি ইনসাফপূর্ণ সমবায় সমাজ-রাষ্ট্র গঠনে ঈদ এক অসামান্য ভূমিকা রাখে। রামাদান মাসেই আল্লাহ নির্ধারিত করেছেন স্বচ্ছল বান্দাদের উপর সাদাকাতুল ফিতরের বিধান। সাথে আছে সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণের একটি অন্যতম উপায় হিসেবে বিত্তবান মুসলমানদের সম্পদের মধ্যে যাকাতের বিধান। যা এই পবিত্র রমজান ও ঈদ উপলক্ষে আদায় করা হয়। যার মাধ্যমে অসহায়, দুঃস্থ, দরিদ্র-পীড়িত মানুষের মুখে যতকিঞ্চত হাসি ফুটানো সম্ভব হয়। কিন্তু এর মধ্যে কিছু বিষয় পরিপালনে আমাদের মধ্যে সামান্য দুর্বলতা দেখা দেয়। নিজের ইবাদতের অংশ স্বরূপ ফিতরা প্রদানে আমাদের মাঝে সংকীর্ণ মানসিকতা দেখা যায়। গরীবের এ পাওনাটাকে আমরা সবসময় চেষ্টা করি স্বল্প মূল্যে আদায় করে দিতে। বাজারের সবচেয়ে কম দামি জিনিসের হিসেবে আমরা ফিতরা আদায়ের চিন্তা করি। বাস্তবে এটাতো গরীবের অধিকার, তার পাওনা। আমরা কখনো ভাবি না, এ পাওনাটাকে যদি একটু উচ্চ মূল্যে দান করি তাহলে গরীব-অসহায় মানুষগুলোর কী পরিমাণ উপকার হয়। সময় মতো সঠিকভাবে ফিতরা ও যাকাতটা আদায় করলে তার পাওনাদারের জন্য খুবই উপকারী হয়। তেমনি ঈদের বাজারে মিতব্যয়ী না হয়ে আমাদের মাঝে পারস্পরিক প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব পরিলক্ষিত হয়, যা মোটেই ইসলাম সমর্থন করে না। হ্যাঁ উৎসবকে আনন্দঘন-প্রাণবন্ত করতে কেনাকাটা লাগতেই পারে। তাই বলে এর জন্য প্রতিযোগিতার কোন যৌক্তিকতা নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাকুরীজীবি মানুষের ঈদের বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য অতিরিক্ত উপার্জনের চিন্তা করতে হয়। আর তখনই তিনি পা বাড়ান অবৈধ উপার্জনের দিকে। সুদ, ঘুষ ইত্যাদির মাধ্যমে সে অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে গিয়ে পবিত্র উৎসবটি কলুষিত হয়ে যায়, অবারিত পূণ্যার্জনের বদলে তিনি লিপ্ত হন পাপাচারে। তখন ঈদের শিক্ষাই ব্যাহত হয়। এছাড়া ইসলামের সুষ্ঠু বিনোদনের বাইরে গিয়ে বর্তমানে ঈদ আনন্দের নামে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে অশ্লীলতা-বেহায়াপনা। দেশের সব প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াগুলো নিজেদের কাটতি বাড়াতে প্রচার-প্রকাশ করে থাকে নানা অশ্লীল অনুষ্ঠান ও ফিচার। এর দ্বারা মুলত: ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে ঈদের প্রকৃত মর্মকথা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এসব দিকে অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের সে মানসিকতা পরিহার করতে হবে।
ঈদের আসল মর্মকথা অনুধাবন করতে হবে। শুধু নিজের চিন্তা না করে সমাজের অসহায়, দরিদ্র, পীড়িত মানুষগুলোর দিকে তাকাতে হবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। লক্ষ্য রাখতে হবে, এ উৎসব যেন কোন ভাবেই শুধুমাত্র ধনাঢ্য অভিজাত সম্প্রদায়ের উৎসবে পরিনত না হয়। এতে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে নিয়ে পরকাল ভিত্তিক জীবনের অংশ বানাতে হবে। কবির ভাষায়-
ঈদ আসেনাই তাহাদের তরে যাহারা পরেছে নতুন বেশ
পরকাল ভয়ে পূর্ণ যে মন, সেই তরে ঈদের রেশ।
ঈদ উৎসবকে শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। একে ছড়িয়ে দিতে হবে পুরো সমাজে। সমাজের মানুষগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হবে। তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। সাধ্য মতো তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। জামা-কাপড় ও খাবার-দাবারে তাদের শরীক করতে হবে। তাহলেই ঈদের প্রকৃত শিক্ষা বাস্তবায়িত হবে। ঈদ হবে পুরো মানবজাতির উৎসব। আর এ উৎসবকে শুধু একদিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও চলবে না। এর শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে সারা জীবন। ঈদ উৎসব শেষ হওয়ার পর খুব সহজেই আমরা ভুলে যাই এর শিক্ষা। মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের এ মেল বন্ধনকে এত সহজে বিচ্যুত করা যাবে না। তাহলে সমাজ-রাষ্ট্র সর্বত্র বয়ে যাবে শান্তির সুবাতাস, উচ্চ থাকবে মানবতার জয়গান। কবি গোলাম মোস্তফা এখানেও খুব সুন্দর ভাবে একটি বার্তা দিয়েছেন-
আজি
সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা মুরতি লভিয়াছে হর্ষে
আজিকে
প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়াছে রাখিতে হবে সারা বর্ষে।
লেখক : লুৎফুর রহমান তোফায়েল, নির্বাহী সম্পাদক- সাপ্তাহিক বিজয়ের কণ্ঠ