ঢাকা, ০১ মে : আজ পহেলা মে বুধবার, মহান মে দিবস আজ। সমগ্র বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘মালিক-শ্রমিক একতা, শিল্পোন্নয়নের মূলকথা’। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওইদিন তাদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে শ্রমিক শ্রেণী এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে তখন থেকেই সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
আজ থেকে ১২৭ বছর আগের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয় শ্রমিকরা। শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভ সমুদ্রে। শহরের তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখে। এক লাখ ৮৫ হাজার নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে আরও অসংখ্য বিক্ষুব্ধ শ্রমিক লাল ঝাণ্ডা হাতে নেমে আসে পথে। নির্বিচারে তাদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। প্রাণ হারায় ১০ শ্রমিক।
১ মে শুরু হওয়া এ শ্রমিক আন্দোলন অব্যাহত ছিল আরও কয়েকদিন। অব্যাহত থাকে ধর্মঘটও। ৩ মে একটি ফসল কাটার কারখানার সামনে শ্রমিক সভায় পুলিশের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারায় আরও ৬ শ্রমিক। এ হত্যার প্রতিবাদে ৪ মে হে মার্কেট স্কোয়ারে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম শ্রমিক সমাবেশে আবারও বর্বরোচিত হামলা চালায় পুলিশ ও গুণ্ডা বাহিনী। এতে প্রাণ হারায় আরও ৪ শ্রমিক। পরে ৬ অক্টোবর মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪ শ্রমিক নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। হে মার্কেটের এ গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
এর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মেকে ঘোষণা দেয়া হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হতে শুরু করে মে দিবস হিসেবে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বুধবার দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা, মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। বুধবার সরকারি ছুটির দিন।
মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এডভোকেট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া,বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক পৃথক বাণীতে শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
মে দিবস উপলক্ষে এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বিশ্বের সব শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, একটি দেশের উৎপাদন, উন্নয়ন ও সামগ্রিক অগ্রগতিতে শ্রমজীবী মানুষের অবদান অপরিসীম। মেহনতি মানুষের কল্যাণ ও ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে দেশের ভাগ্যোন্নয়ন জড়িত।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিপুল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে পরিণত করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
অধিকারের দাবিতে প্রাণ দেয়া শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ঐক্য ও সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে আমরা বিভিন্নমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। জাতীয় শিশু শ্রমনীতি ২০১০ এবং জাতীয় শ্রমনীতি ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে।
আমি আশা করি, মহান মে দিবসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রমিক এবং মালিক পরস্পর সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে কল-কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরও নিবেদিত হবেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া এক বাণীতে বলেন, মে দিবসের প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে বিশ্বের কোথাও কোথাও যেমন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও শোষণ-বঞ্চনা বহুলাংশে দূরীভূত হয়েছে আবার বিভিন্ন স্থানে নিপীড়িত শ্রমিকরা আজো তাদের ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
অস্তিত্বের স্বার্থে’ সব ধরনের অন্যায়, জুলুম ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই অক্ষুন্ন রেখে নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়ার জন্য শ্রমজীবী মানুষের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সরকার এ বছর মে দিবস পালন করছে ‘নিরাপদ কর্মপরিবেশ, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠন দিনটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) কর্মসূচি নিয়েছে।
এছাড়া জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, জাতীয় শ্রমিক জোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ব্লাস্ট, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ, ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় শ্রমিক জোট, বাংলাদেশ নাগরিক সমাজ, ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক জোট, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন, জাতীয় শ্রমিক পার্টি, বাংলাদেশ বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ, পোশাকশিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, শ্রমজীবী নারী ঐক্য, জনসংহতি আন্দোলনসহ আরো অনেক সংগঠন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
এমন সময়ে এবারের মে দিবস আসলো, যখন দেশের ইতিহাসে ঘটে গেল চরমতম ট্রাজেডি। ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা নামের একটি নয়তলা ভবন ধসে প্রায় চারশ শ্রমিক নিহত হন। জীবিত উদ্ধার হন প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। নিখোঁজের সংখ্যাও অনেক।
এ ঘটনায় পুরো জাতি শোকার্ত। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলেও নাড়া দিয়েছে। এবারের মে দিবসে তাই রয়েছে শোকের আবহ।
দুনিয়াজুড়ে মে দিবস: এক সময়ের বাসচালক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা থেকে এখন রাষ্ট্রপতি। নিকোলাস মাদুরো বুধবার হাঁটবেন কারাকাসের রাস্তায়। মে দিনে – আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসে। মিরান্দা অ্যাভিনিউ থেকে বলিভার অ্যাভিনিউ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষ শ্রমিকের মিছিলে।
হাভানার হোসে মার্তি স্কোয়ারে তখন উপচে পড়া সমাবেশে ৭৩টি দেশ থেকে আসা ২ হাজারের বেশি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কর্মী শ্রদ্ধা জানাবেন বলিভারীয় নেতা হুগো শ্যাভেজকে। স্বাভাবিক। দুনিয়ার সর্বত্র যখন কাজের সময় বেড়েছে, তখন এখানে কমছে। নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমঘন্টা কমে এখন দিনে ৬ ঘন্টা। সপ্তাহে ৩৬ ঘন্টা। বেড়েছে ন্যূনতম মজুরি। লাতিন আমেরিকায় সর্বোচ্চ। ন্যূনতম মজুরি ১৯৯৮ সালে ছিল মাসে ১০০ বলিভার (১৬ ডলার)। ২০১২ তে তা বেড়ে হয়েছে ২০৪৭.৫২ বলিভার (৩৩০ ডলার)। বৃদ্ধির হার রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। ২০০০শতাংশ। সব শ্রমিকের জন্য পেনশন। এমনকি অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্যও। পেনশন রয়েছে বয়স্কদের জন্যও।
লাশ পাশে নিয়ে এবারে মে দিনে শামিল হয়েছে ঢাকা। ঠিক এক সপ্তাহ আগে সাভারে পোশাক কারখানা ধসে পড়ে ৩৮৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। হাজার হাজার আহত শ্রমিক, নিহতদের স্বজনের আর্তনাদ। পোশাক কারখানায় শ্রমিকরা পান মাসে ৩ হাজার টাকা। দিনে ১৫-ঘন্টা কাজ। শ্রমিকদের কাছে এবারের মে দিনে প্রধান দাবি, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা করতে হবে।
বুধবার, মে দিনে স্তব্ধ হবে এথেন্স। সরকারের ব্যয়সঙ্কোচের প্রতিবাদে ট্রেড ইউনিয়নগুলি ২৪ ঘন্টার সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে গ্রিসে। চলবে না বাস, বন্ধ থাকবে অফিস, স্কুল-কলেজ। এমনকি গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে আজ বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত বন্দরে নোঙর করে থাকবে নৌকা। রবিবার সংসদে ১৬৮-১২৩ ভোটে যে বিল পাস হয়েছে, তাতে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাঁটাই হবেন ১৫,০০০ সরকারি কর্মী। সাধারণ ধর্মঘটে শামিল হবেন নাবিকরাও। যোগ দেবেন রেলকর্মীরা। মিছিলে বিরাট সংখ্যায় হাঁটবেন তরুণরা। এই মুহূর্তে বেকারীর হার ২৭.২শতাংশ। তরুণদের মধ্যে এই হার প্রায় অর্ধেক।
মার্কিন মুলুকে প্রতিবাদী শ্রমিকরা নামবেন রাস্তায়। থাকবেন অকুপাই আন্দোলনের কর্মীরা। নিউ ইয়র্কে বের হবে মিছিল। ডাক দিয়েছে ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। অভিভাসী শ্রমিকদের উপর শোষণের অবসান চেয়ে তারাও শামিল হবেন মিছিলে। অকুপাই আন্দোলন দিয়েছে ‘জনগণের ডাকঘর রক্ষার’ ডাক।
ইস্তানবুলের তাকসিম স্কোয়ারে নয়, তুরস্কের সরকারী কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন মিমুর-সেন মে দিনের সমাবেশ করবে কানাকেল প্রদেশে। মিমুর-সেন জানিয়েছে, ঠিক ছিল তাকসিম স্কোয়ারেই হবে মে দিনের সমাবেশ। পাঁচটি ট্রেড ইউনিয়ন আলোচনায় বসে। সেখানে দেখা যায় রেভেলিউশনারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন তাসকিম স্কোয়ায়ে পৃথকভাবে সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চার বছর আগে একই ঘটনা ঘটেছিল। এই তাসকিম স্কোয়ারেই ১৯৭৭ সালে মে দিনের সমাবেশে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ৩৪ জন শ্রমিক। ১৯৮০তে অভ্যুত্থানের পর সামারিক অভ্যুত্থানের সরকার মে দিন নিষিদ্ধ করে। ২০০৯ সালে সরকার মে দিনে সরকারী ছুটি ঘোষণা করে। তাসকিম স্কোয়ারকে খুলে দেয় দিন উদযাপনের জন্য।
মিশরে বামপন্থী ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা লক্ষাধিক মানুষের মিছিলের প্রস্তুতি নিয়েছেন। শ্রমিক-বিরোধী অর্থনীতি, মূল্যবৃদ্ধি, বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে এই মিছিল শুরু হবে তাহরির স্কোয়ার থেকে। শেষ হবে রাষ্ট্রপতি ভবনে।
জাকার্তায় লেবার ইউনিয়ন কনফেডারেশনের ডাকে মিছিলে হাঁটবেন ২ লক্ষের বেশি শ্রমিক। আর ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিক মিছিলে অংশ নেবেন ৮০ লক্ষের বেশি শ্রমিক। সংবাদ সংস্থা সিনহুয়াকে একথা জানিয়েছেন লেবার ইউনিয়ন কনফেডারেশনের সভাপতি।
সারা বিশ্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমজীবী মানুষও তাদের অধিকার রক্ষার দাবিতে এদিন শামিল হবেন। বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলির যুক্ত আহ্বানে বিকেল সাড়ে চারটেয় শহীদ মিনারে শ্রমিক সমাবেশ। রাজ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিকের অধিকারের ওপরে ক্রমবর্ধমান আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মে দিন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শ্রমিক কর্মচারীরা তাদের অধিকার রক্ষার দাবিতে এবারের মে দিবসে সোচ্চার ।