আজ ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিলঃঅস্থায়ীভাবে সরকার গঠন

    1
    306

    আমারসিলেট24ডটকম.১০এপ্রিলঃ আজ ঐতিহাসিক ১০ এপ্রিল,রোজ বৃহস্পতিবার। ১৯৭১ সালের এই দিনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি চিরস্মরনীয় দিন। এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার বর্তমান মুজিব নগর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র জারি করা হয় এবং একইসাথে অস্থায়ীভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং পরে ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার (যেটিকে পরে মুজিবনগর নামে নামকরণ করা হয়) একটি আমবাগানে এ সরকার শপথ গ্রহণ করেন। তবে ১৭ এপ্রিল শপথ নিলেও ১০ এপ্রিল তারিখেই সরকার গঠনের পর সেই দিনই তারা স্বাধানতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
    একটি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে পাঠ করা হলো ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ যার অনূদিত তিনটি অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি: ‘ঘোষণা দিতেছি ও প্রতিষ্ঠা করিতেছি যে, বাংলাদেশ হইবে সার্বভৌম জনগণের প্রজাতন্ত্র এবং এতদ্বারা ইতঃপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে নিশ্চিত করিতেছি, এবং এতদ্বারা নিশ্চিত করিতেছি ও সিদ্ধান্ত লইতেছি যে, সংবিধান যে সময় পর্যন্ত প্রণীত না হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকিবেন, ইংরেজি ভাষায় লিখিত আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া বিবেচিত হইবে।’
    ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর দেশের বিভিন্ন জেলা একের পর এক পাক সেনাদের দখলে চলে যাওয়ায় বিপ্লবী সরকার গঠনের জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী এ আম্রকাননকেই নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় বৈদ্যনাথ বাবুর সেই আমবাগানের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। মুজিবনগরকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী হিসেবেও ঘোষণা করা হয়।
    ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠানিক শপথ ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও মুক্তিবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশের প্রথম সরকার। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
    সেদিনের ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশ-বিদেশের শত শত সাংবাদিকের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ এবং শপথ অনুষ্ঠান সফলভাবে শেষ হয়েছিলো মেহেরপুর ও মুজিবনগরের এক ঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর সহযোগিতায়। মুজিবনগর সরকার খ্যাত এ বিপ্লবী সরকারের দক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ^ মানচিত্রে বাঙালির নিজস্ব আবাসভূমি স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।
    নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিপ্লবী সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা, বিশ^ জনমত গঠন এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করে।

    ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ
    মুজিবনগর, বাংলাদেশ
    তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১
    যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং
    যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল;
    এবং
    যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং
    যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং
    যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং
    যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং
    যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং
    যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব কে তুলেছে; এবং
    যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;
    সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে
    বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং
    এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং
    রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং
    তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং
    বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
    বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।
    স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী
    বাংলাদেশ গণপরিষদের ক্ষমতা দ্বারা এবং ক্ষমতাবলে যথাবিধি সর্বাধিক ক্ষমতাধিকারী।

    মুজিবনগর সরকার
    ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শখ মুজিবুর রহমানের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণাকে এর মাধ্যমে প্রতিপাদন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানে বন্দি থাকার কারণে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন।
    রাষ্ট্রপতি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি)
    উপরাষ্ট্রপতি: সৈয়দ নজরূল ইসলাম (রাষ্ট্রপতির অনুপুস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন)
    প্রধানমন্ত্রী: তাজউদ্দিন আহমদ
    আইন ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী: খোন্দকার মোশতাক আহমদ
    অর্থমন্ত্রী: এম. মনসুর আলী
    স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী: এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান
    সশস্ত্রবাহিনী প্রধান: জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী
    চিফ অব স্টাফ: মেজর জেনারেল আবদুর রব
    ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে (পরবর্তী নাম মুজিবনগর) স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহন করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষনা করেন অতঃপর তিনি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষনা করেন এবং পরিচয় করিয়ে দেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দেন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।