হবিগঞ্জে চার শিশু হত্যা:আসামি জুয়েল’র স্বীকারোক্তি

    0
    246

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২১ফেব্রুয়ারী,হবিগঞ্জ প্রতিনিধিঃ  হবিগঞ্জের বাহুবলে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে ৪ শিশু হত্যার ঘটনায় আটক জুয়েল মিয়া (২৫) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জুয়েল মিয়া সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আবদুল আলী বাগালের ছেলে।
    রোববার হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কৌশিক আহম্মেদ খন্দকারের
    আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি।বিকেল ৪টা ৩৪মিনিট থেকে ৫টা ৪৪মিনিট পর্যন্ত এ জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
    এদিকে, এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক সালেহ আহম্মেদকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেছেন।হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহিদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

    উল্লেখ্য,সুত্রে জানা গেছে-চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে তাদের অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় অটোরিকশা গ্যারেজে। সেখানে একে একে গলা টিপে হত্যা করা হয় চারজনকে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় ৬ জন। হত্যার পর শিশুদের লাশ গভীর রাতে মাটি চাপা দেয়া হয়। আদালতে ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দিতে এভাবেই নৃশংস খুনের বর্ণনা দিয়েছে ‘হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া’ জুয়েলের ভাই রুবেল। রুবেল চার শিশু হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি আবদুল আলি বাগালের ছেলে। লাশ উদ্ধারের পর তাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছিল।সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কৌশিক আহমেদ খোন্দকারের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় রুবেল। হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় তার কার্যালয়ে ব্রিফিংকালে জানান, সুন্দ্রাটিকি গ্রামে বাগাল পঞ্চায়েত এবং তালুকদার পঞ্চায়েতের বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এক মাস আগে বাগাল ও তালুকদার পঞ্চায়েতের মাঝে উভয় পঞ্চায়েতের সীমানায় থাকা একটি বরই গাছ কাটা নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়।

    পরে বিষয়টি সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করা হলেও সিএনজি চালক বাচ্চু মিয়া ও গ্রেপ্তারকৃত আরজু সামাজিক হেয় প্রতিপন্ন হয়। এর পর থেকেই তারা পরিকল্পনা করে বাগাল পঞ্চায়েতের শিশুদের হত্যা করার। রুবেলের জবানবন্দির তথ্য তুলে ধরে পুলিশ সুপার বলেন, ১২ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকালে পূর্ব ভাদেশ্বর গ্রামে ৪ শিশু ফুটবল খেলা দেখতে যায়। বৃষ্টির জন্য খেলা না হওয়ায় শিশুরা মাঠে ঘুরাফেরা করছিল। তখন আগ থেকে ওত পেতে থাকা বাচ্চু মিয়া তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে সিএনজি-অটোরিকশায় উঠতে বলে। ৪ শিশু সিএনজি-অটোরিকশায় উঠলে তাদের চেতনানাশক পুশ করে অজ্ঞান করে বাচ্চু মিয়ার গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরজু ও রুবেলসহ ৬ জন মিলে তাদেরকে গলা টিপে হত্যা করে। হত্যার পর লাশগুলো গ্যারেজেই লুকিয়ে রাখা হয়। পরে গভীর রাতে যে স্থান থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয় সেখানে গর্তে পুঁতে রাখা হয়।

    পুলিশ সুপার জানান, ঘটনার আলামত উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে বাচ্চুর ব্যবহৃত, সিএনজি-অটোরিকশা, আরজুর বাড়ি থেকে কোদাল আর শাবল, রাস্তা থেকে কয়েকটি বস্তা এবং একটি রক্তমাখা পাঞ্জাবি উদ্ধার করা হয়েছে। আরজুর স্বীকারোক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মুটিভ উন্মোচিত হয়েছে। তবে একজনের স্বীকারোক্তিই শেষ কথা নয়। সে কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে। তাই তদন্ত অব্যাহত থাকবে।

    আগামী ১৫ দিনের মধ্যে অভিযোগভিত্তিক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। প্রাথমিক তদন্তে ৬ জনের নাম এলেও এর মধ্যে রুবেল এবং আরজু গ্রেপ্তার হয়েছে। অন্যরা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি। আরজুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আরজু, রুবেল ছাড়াও গ্রেপ্তারকৃত বশিরের ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। সোমবার রিমান্ড শুনানি হবে। গ্রেপ্তারকৃত ৫ আসামিকে রিমান্ডে নিলেই প্রকৃত তথ্য পরিষ্কার হবে। পুলিশ সুপার বলেন, ১২ই ফেব্রুয়ারি ঘটনার সময় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আবদুল আহাদ ৪ শিশুকে বাচ্চু মিয়ার সিএনজি-অটোরিকশায় দেখেছে বললেও পরে অস্বীকার করে। ফলে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়েছে। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ এবং পুলিশের কৌশল ব্যবহার করে ঘটনার মোটিভ উদ্ধার করা হয়। সুন্দ্রাটিকি গ্রামে ডিবি, ডিএসবিসহ ৫০ জন পুলিশ সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি করে সফল হয়েছে।

    পুলিশের পাশাপাশি মিডিয়াও ব্যস্ত রয়েছে। একজনের জবানবন্দি পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয় না। তবে এই জবানবন্দি ঘটনার রহস্য উদঘাটনের ভিত্তি হিসাবে কাজ করবে। এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার জন্য পুলিশের কোনো সদস্যের গাফিলতি রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

    এদিকে সিলেটের ডিআইজি মিজানুর রহমান পিপিএম বলেছেন, গ্রেপ্তারকৃত ৫ জনই কমবেশী এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। শুক্রবার বিকালে পুলিশ সুপারের সভাকক্ষে এক সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত করতে। এই ঘটনায় ৫ জন গ্রেপ্তার হলেও এর পিছনে আরও কোনো গডফাদার জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সোচ্চার এলাকাবাসী: ৪ শিশু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও খুনিদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন বাহুবলের জনগণ। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত কাল শনিবার অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ ও মানববন্ধন ডেকেছে। এসব সমাবেশ ও মানববন্ধন সফল করতে চলছে মাইকযোগে প্রচারণা।

    গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর নিহতদের জন্য বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার বেলা ২টার দিকে উপজেলা সদরে জাঙ্গালিয়া প্রজন্ম ক্লাব নামে একটি সংগঠন বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করে। মিছিল থেকে খুনিদের ফাঁসির দাবি করা হয়। শনিবার বেলা ১১টায় বাহুবল অনার্স কলেজের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক, বাদ আছর তৌহিদী জনতার ব্যানারে স্থানীয় মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষক, সচেতন নাগরিক সমাজ, সানশাইন প্রি-ক্যাডেট এন্ড হাইস্কুল মানববন্ধন ও সমাবেশ আহ্বান করেছে।

    গত শুক্রবার বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে স্কুলপড়ুয়া চার শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর বুধবার সকালে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ঈসা বিল এলাকায় তাদের বালিচাপা লাশ পাওয়া যায়। নিহত শিশুরা হলো- স্থানীয় আবদাল মিয়া তালুকদারের ছেলে মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), আবদুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) এবং আবদুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেন (১০)। মনির সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে এবং তার দুই চাচাত ভাই শুভ ও তাজেল একই স্কুলে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। আর তাদের প্রতিবেশী ইসমাইল ছিল সুন্দ্রাটিকি মাদরাসার ছাত্র।

    এ ঘটনায় এ পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা হলেন- আবদুল আলী বাগাল, তার দুই ছেলে জুয়েল মিয়া ও রুবেল মিয়া, আজিজুর রহমান আরজু ও বশির মিয়া। এদের মধ্যে আবদুল আলী বাগাল ও জুয়েল মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। হত্যাকারীদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের ডিআইজির পক্ষ থেকে। এরমধ্যে  ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি জানিয়েছেন, এ হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে।