সাপুড়ে তোঁতা মিয়া’র স্বপ্নের খবর আজ আর কেউ রাখেনা

    0
    346

    সফিকুল ইসলাম শিল্পী,রানীশংকৈল প্রতিনিধিঃ  আমাদের সাপুড়ে তোঁতা মিয়ার কথা নিয়ে সাধারণ লোক মুখে শুধু এখন সম্ভবনাহীন একটি গাঢ় অন্ধকার প্রতিচ্ছবি! তোঁতা মিয়ার কিছু সাপ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত এবং বাকী সাপগুলোকে হত্যা না করে, উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষন করার জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে আহবান জানিয়েছে পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ। ১৯ নভেম্বর ২০০৭, সোমবার, ৩:৩০ মিঃ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) মিলনায়তনে পবা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার এবং ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাষ্ট বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে বন্যপ্রাণী সংশিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণের আলোকে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী পালন ও খামার স্থাপনের নীতিমালা’ বিষয়ক গোল-টেবিল বৈঠকে এ আলোচনা হয়।

    যেমন আকাশটা নীল হয়, রঙ বদলায় । সাত রঙ এ ভরিয়ে যায় প্রকৃতি । ছোট ছোট মেধা,শ্রম আর ভালবাসা গুলো একসময় ভবিশ্যতে বড় কিছু হবার স্বপ্ন দেখে। আর সে সপ্নকে লালন করে পর্যটকদের ২০০৭ সালে সেদিনও খেলা দেখাচ্ছিলেন আমাদের তোঁতা মিয়া। একটু অসতর্কতায় হঠাৎ করেই একটি সাপ ছোবল দিয়ে বসে তার ডান হাতে। উপস্থিতি সবাই বুঝতে না পারলেও তোঁতা মিয়া বুঝেছিলেন কি ঘটছে এবং কি ঘটতে যাচ্ছে তার জীবনে। হয়ত জীবনে অনেকবার সাপের ছোবল খেয়েছেন। কিন্তু কে জানতো এটাই তোঁতার জীবনে সাপের শেষ ছোবল! গত কয়েক বছর আগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার চৌরঙ্গী এলাকার তোঁতা মিয়ার সাপের কামড়ে মৃত্যু এবং খামারের বেশ কিছু সাপ না খেতে পেয়ে মারা যাওয়ায় এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞগণ, পরিবেশবীদ, এলাকাবাসী সহ সারা দেশের মানুষের মাঝে এ খবরটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় তোঁতা মিয়ার মৃত্যুর পর কিছু সাপ চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর ও অবশিষ্ট সাপ হত্যা করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। আলোচকগণ সরকারের কিছু সাপ সংরক্ষনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন, বাকী সাপগুলোকে উপযুক্ত পরিবেশে সংক্ষনের আহবানও জানিয়েছেন।

    বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন ‘বাংলাদেশে অনেক প্রজাতির সাপ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এ সাপগুলোকে সংরক্ষন করা হলে এগুলো একসময় প্রাকৃতির তধা দেশেরে সম্পদ হবে। পাশাপাশি এ ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস না করে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। সে সময় পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ বলেন, বন্যপ্রানীর খামার তৈরির অনুমোদন প্রদান করা হলে বন্য প্রাণী ধ্বংস হতে পারে। তারা বন্যপ্রাণীর খাবার স্থাপনের অনুমোদন প্রদান না করার আহবান জানিয়েছিলেন। সাপুড়ে তোঁতা মিয়ার বাড়ি ছিল ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার চৌরঙ্গী বাজারে। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম সাপের খামার করেছিলেন। বিভিন্ন ধরণের সাপের সংগ্রহ ছিল তার কাছে। প্রাকৃতিক ভাবে সাপের প্রজনন ঘটিয়ে সাপের বাচ্চা উৎপাদন করতেন। সেই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বেশ কয়েকবার শিরোনাম হযেছিল তার এই সাপের খামারের খবর। খামারটি এক পলক দেখার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জাযগা থেকে অনেক মানুষ ছুটে আসতেন। দেশের বাইরে থেকেও আসতেন অনেক পর্যটক। তার এই সাপের খামারটি হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গবেষণার বিষয়বস্তু।

    ঠাকুরগাঁওয়ের সাপের খামারি তোঁতা মিয়ার নাম শোনেননি এমন মানুষ অন্তত ঠাকুরগাঁওয়ের কমই আছে। দেশের একমাত্র সাপের খামারি ছিলেন তিনি। অসংখ্যবার খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি ও তার খামার। দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসতেন এক নজর দেখার জন্য! কথায় বলে সাপুড়িয়ার মৃত্যু নাকি সাপের দংশনেই হয়।তোঁতা মিয়ার ক্ষেত্রে তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিলো। দীর্ঘদিন ধরে তার তিলে তিলে গড়ে তোলা খামার বাণিজ্যিক ভাবে বিষ সরবরাহের আগেই এক ছোবলেই সব শেষ।অন্যান্য দিনের মতো ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার চৌরঙ্গী বাজারে দেশের একমাত্র সাপের খামার তোঁতা মিয়ার বাড়িতে মিডিয়াসহ অনেকেই ভিড় করছিলেন।সাপের খেলা দেখে খুশি হয়ে যে যা দেয় সেটা আর তার কষ্টের টাকা দিয়েই খাবার জোগাতেন সাপের।খেলা দেখাতে গিয়ে এটাই তার জীবনের সাপের শেষ ছোবল ছিল! সেই দৃশ্য ভিডিওতেও ধরা পড়ে। এতে দেখা গেছে তিনি দ্রুত তার স্ত্রীকে দিয়ে হাতে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি হন। বিষক্রিয়া কমে না যাওয়ায় দুদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তোঁতা মিয়া।

    তার মৃত্যুর তিন দিন পর কামরুপ কামাক্ষা থেকে একদল সাপুড়িয়া এসেছিল শেষ চেষ্টা করতে। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতার দরুণ তাদেরকে লাশ তোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেসময় তার সংগ্রহে ছিলো কমপক্ষে তিন হাজার সাপ ও সাপের বাচ্চা। প্রাকৃতিকভাবে সাপের প্রজনন ঘটিয়ে সাপের বাচ্চা উৎপাদন করতেন তোঁতা মিয়া। তার এই সাপের খামারটি হয়েছিল চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের গবেষণার বিষয়বস্তু। তোঁতা মিয়ার মৃত্যুর পর পরিচর্যার অভাবে সাপসহ অনেক সাপের বাচ্চা মারা যায়।কিছু সাপ ঢাকা চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরিত করা হয় ও কিছু সাপ চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ নিয়ে যায়। ঠাকুরগাঁওয়ের খবরের সন্মানিত পাঠকদের জন্য তোঁতা মিয়ার জীবনের শেষ খেলা দেখানোর মূহুর্তে সাপের ছোবল দেবার দৃশ্য শেয়ার করা হলো।এটাই ছিল তার জীবনের শেষ সময়। তোতা মিয়ার সকল সাপ উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষন এবং বন্যপ্রানীর খামার তৈরির অনুমতি শেষ পর্যন্ত পাইনি।
    তোঁতার মৃত্যুর পর সাপ সহ কয়েক হাজার সাপের বাচ্চা মারা যায়, কিছু সাপ ঢাকা চিড়িয়াখানায় স্থানান্তরিত করা হয় ও কিছু সাপ চট্টগ্রাম ভার্সিটির প্রাণীবিদ্যা বিভাগ নিয়ে যায়। বেঁচে থাকতে সরকার তার সাপের খামার নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করতেন। তার সাপের খামারের বিষ দিয়ে জমিতে রাসায়নিক বিষ হিসেবে কাজে লাগানোর কথা জানা যায়। তবে বর্তমান কেউ খবর রাখেনা তার পরিবারের। অভাবের জ্বালা সহ করতে না পারায় দ্বিতীয় সংসার করতে বাধ্য হয় তোঁতা মিয়ার স্ত্রী জোসনা বেগম।জোসনা বেগম জানান, আমার স্বামীর খোঁজ খবর রাখতেন মারা যাওয়ার পর কেউ আমাদের খোঁজ খবর না। খুব কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। প্রতিবেশী কবির বলেন, ভিটে মাটিতে কেউ থাকে না,তোঁতা’র এক ছেলে এক মেয়ে সহ নওগাঁ’র বাপের বাড়িতে থাকে জোঁছনা বেগম।