সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ ﷺ

    0
    229

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৪ডিসেম্বরক,লুৎফুর রহমান তোফায়েলঃ সৃষ্টির শুরু থেকে এ যাবৎ পৃথিবীতে যত রাজা-মহারাজা, বীর-মহাবীর, বিপ্লবী-মহাবিপ্লবী, নেতা-মহানেতা ও সমাজ সংস্কারকের আগমন ঘটেছে, এঁদের সবাই প্রায় সভ্যতার বিভিন্ন অংশে অসামান্য অবদান রেখেছেন। পৃথিবীতে তাদের বহু অমর কীর্তি স্থাপিত হয়েছে। এরা বহু জীবনদর্শন দিয়ে মানবজাতির উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের সে অবদান, চেষ্টা-সাধনা ও কৃতিত্ব অনেকাংশেই পূর্ণতা পায়নি। তা ছিল নিতান্তই আংশিক, অপরিপূর্ণ বা খুবই ক্ষণস্থায়ী। তবে ইতিহাসে একজন মাত্র ব্যক্তি আছেন যিনি ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্র সফলতা ও কৃতিত্ব দিয়ে মানবজীবনের আদর্শ হয়ে রয়েছেন। তিনি হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)। একটি সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে পরিপূর্ণ অবদান, কীর্তি এবং দর্শন রয়েছে শুধুমাত্র তাঁর জীবনেই।

    আল্লাহ মানুষের হেদায়াতের জন্য পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তিনিই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। মুসলমানতো বটেই, দুনিয়ার প্রায় সব অমুসলিম মনীষী ও ইতিহাসবিদ এই সত্যকে স্বীকৃতি দিয়েছেন নির্দ্বিধায়।

    প্রিয়তম হযরত নবী মুহাম্মদ (দঃ) ছিলেন সকল প্রশংসনীয় গুণে গুণান্বিত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি অংশে তিনি স্থাপন করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের নমুনা। জীবনের এমন কোনো দিক নেই যেখানে তাঁর আদর্শের সুন্দরতম দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না। মানুষের জন্ম থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের সুন্দরতম আদর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। তিনি ছিলেন মানবজাতির একমাত্র ত্রাণকর্তা। তাওহিদের আলো দিয়ে তৎকালীন অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পরিবর্তন করে পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ সমাজে রুপান্তরিত করেছিলেন। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের সকল ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের। সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের সকল পরিমন্ডলে তিনি এক সফল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

    মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর নবুওয়াত প্রকাশের পর মক্কা জীবনে ১৩ বছর অতিবাহিত করেন মানুষের চরিত্র ও আচার ব্যবহারের মৌলিক সংশোধনে। প্রথমে নীরবে নিভৃতে ও পরে প্রকাশ্যে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দিয়েছেন সমাজের সকল মানুষের কাছে। প্রচলিত সব কুসংস্কার, অনাচার, অবিচার ও অজ্ঞতা সম্পর্কে সমাজের মানুষকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন প্রাণপনে। হাজারো বাধা-বিপত্তি এবং নির্যাতনের শিকার হয়েও পিছপা হননি বিন্দু পরিমাণ। আপোষহীনভাবে চালিয়ে যান মহান প্রভূর একত্ববাদ প্রচারের কাজ। এরপর মদিনায় হিজরত করে শতদ্বাবিভক্ত আরব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গোত্র প্রথার বিলোপ সাধন করে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেন। স্বৈরাচারী শাসন অথবা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতি লাভ করে। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের একমাত্র শ্রেষ্ঠতম শাসনব্যস্থা। ইনসাফভিত্তিক এই সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল সর্বকালের সেরা একটি শাসনতন্ত্রের মাধমে। যা ছিল মহান আল্লাহ প্রদত্ত তাঁর ঐশী বাণী আল-কোরআন। যেখানে ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, ছোট-বড়, আমীর-ফকির, সাদা-কালো সবার মধ্যে এক অসাধারণ ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে গড়ে উঠে নতুন সভ্যতা। যেখানে বিধর্মীদেরও নিজেদের ধর্ম পালন ও বসাবাসের স্বাধীনতা ছিল সুন্দর পদ্ধতিতে।

    জন্মের পর থেকেই হযরত মুহাম্মদ (দঃ) মানবজীবনের আদর্শরূপে আভির্ভূত হন। ছোটবেলা থেকেই তিনি অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রতিটি সৃষ্টির সাহায্যকারী, দুর্বল, অসহায়, নির্যাতিত মানবতার অকৃত্রিম বন্ধু। বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত। পথহারাদের প্রথ প্রদর্শক। নবুওয়তের আগ থেকেই সমাজের সর্বস্থরের মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য কাজ করলেও তাঁর সে চেষ্টা-সাধনা পূর্ণতা পেয়েছিল মহান প্রভূর পক্ষ থেকে ওহির জ্ঞান লাভের পর। মহান মা’বুদ বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক ও মানবজীবনের সংবিধান স্বরূপ পবিত্র আল-কোরআন তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেন। এই পরশ পাথর দিয়েই মুহাম্মদ (দঃ) তৎকালীন তমসাচ্ছন্ন সমাজকে আলোকময় করে তুলেছিলেন।

    মাত্র ১৭ বছর বয়সে নির্যাতিত মানুষের করুণ দুর্দশা দেখে সমমনা যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক সমাজসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ ও মনবতার প্রতি তাঁর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দুর্বল অসহায়, অধীনস্থ ও নির্যাতিতদের প্রতি তাঁর এমন একটি কোমল হৃদয় ছিল যে, জীবনের শেষ ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণেও অসহায় মানবতার প্রতি দরদি মনের আবেগ ও আন্তরিকতা প্রস্ফুটিত হয় এই বক্তব্যের মধ্যে; “তোমরা নিজে যা খাবে তা-ই তোমাদের ভৃত্যদের খাওয়াবে, নিজে যা পরবে তা-ই তাদের পরাবে।” অধীনস্থদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন আপোষহীন। এদের ব্যাপারে তিনি শুধু নসিহতই করেননি; নিজেও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন। নিজের খাদেম যায়েদ ও আনাস (রাঃ)-এর বক্তব্য থেকে তা কিছুটা অনুমেয়। যায়েদ (রাঃ) ছোট বেলায় মাতা-পিতাকে হারিয়ে ফেলে একসময় রাসুলের কাছে আসেন। তার পিতামাতা খবর পেয়ে তাকে ফিরিয়ে নিতে আসলে যায়েদ (রাঃ) বলেন, তামাম পৃথিবী যদি আমাকে দেয়া হয় তবুও এই ব্যক্তির কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছি, তাঁকে ছেড়ে যেতে পারব না। আনাস (রাঃ) দীর্ঘ ১০ বছর রাসুল (দঃ) এর খাদিম ছিলেন। তিনি বলেন, এই দশ বছরের কোনো দিন রাসুল (দঃ) আমাকে ধমক দিয়ে একটি কথাও বলেননি।

    নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়ও রাসুল (দঃ) একক কৃতিত্বের অধিকারী। তৎকালীন সমাজের শত্রু হিসেবে পরিগণিত নারীর মর্যাদা দিয়ে পবিত্র কোরআনের আমোঘ বাণী প্রচার করে বলেন, “পুুরুষের নারীর উপর যতটা অধিকার আছে, নারীরও পুরুষের উপর ঠিক ততটা অধিকার রয়েছে।” যে কন্যা সন্তানের জন্মকেই সমাজে মর্যাদা হানিকর মনে করা হত। সে মেয়েদের লালন পালন রাসুল জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম বানিয়ে দিলেন। রাসুল (দঃ) বলেন, যার তিনটি বা দুটি কন্যা অথবা বোন রয়েছে আর সে তাদের প্রতি যতœশীল হয় তার জন্য জান্নাত অনিবার্য।

    মানব প্রেমেও রাসুল মুহাম্মদের (দঃ) জীবন সমোজ্জ্বল। বিপদে ধৈর্যশীলতা, দারিদ্র্যে অচ ললতা, শত্রুর প্রতি ক্ষমাশীলতার মহৎ দৃষ্টান্তে তাঁর জীবন ভরপুর। নারী-পুরুষ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শিশু-কিশোর সবার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ ছিল কুসুমের মতো কোমল। তাঁর চরিত্র ছিল প্রীতি-মমতা, স্নেহ-সৌজন্য ও দয়ার আধার। সম্পুর্ণ নিষ্কলুষ এবং অতি উৎকৃষ্ট চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে জাহেলি সমাজের মানুষও তাঁকে ‘আস-সাদিক’ (সত্যবাদী) ও ‘আল-আমিন’ (বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত করে। মহানবীর আদর্শ, নিখুঁত চরিত্র, দয়া, দানশীলতা, ক্ষমা প্রভৃতি গুণাবলী সম্পর্কে পবিত্র কোআনে আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।” সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী, দয়া, দানশীলতা, সহিষ্ণুতা, উদারতা তথা সকল মানবিক গুণের এক বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছে মহানবীর জীবনচরিত্রে। তাঁর অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ফলে তিনি একজন দূরদর্শী কূটনীতিবিদ, দক্ষ সেনাপতি, স্নেহবৎসল পিতা, প্রেমময় স্বামী, সফল ব্যবসায়ী এবং মহান সংস্কারকের ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন।

    এতকিছুর পরও তিনি অতি সহজ, সরল, সাধারণ এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। স্বহস্থে নিজের ও গৃহের কার্যাবলী সম্পাদন করতেন। শ্রমের মর্যাদা দান করতেন। মদিনায় মসজিদ নির্মাণ ও খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খননে সাহাবিদের সাথে নিজে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।

    বৈপ্লবিক পরিবর্তন দ্বারা তিনি আরবের তথা মুসলিম বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেন তার কোনো তুলনা ইতিহাসে নেই। পৌত্তলিকতা, ধর্মীয় কুসংস্কার এবং বস্তুপূজা প্রভৃতি যখন আরবের ধর্মীয় জীবনকে কলুষিত করে তুলেছিল তখন মুহাম্মদ (দঃ) তাওহিদের সুমহান বাণী প্রচার করে সমগ্র জাতিকে একটি ভ্রাতৃসংঘে আবদ্ধ করেন। কৌলিন্যের পরিবর্তে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে তিনি মুসলমানদের একটি জাতিতে পরিণত করেন। তিনিই জুয়া খেলা, মদ্যপান, অহেতুক রক্তপাত, ব্যাভিচার প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

    আজকের অশান্ত এই সমাজে মুহাম্মদ (দঃ)-এর মতো একজন মহামানবের আদর্শ অনুসরণ করলে সবার মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠবে। একটি শোষনমুক্ত বাসযোগ্য সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবী গড়ে তুলা সম্ভব হবে। লেখকঃপ্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট