সংবাদ বিশ্লেষণঃযুবক হলো বলির পাঠা !

    0
    744

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,১৮অক্টোবর,মুকুল মোহাম্মদ, উন্নয়ন গবেষকঃ আবারো যুবক-কে আটকাতে বিশেষ আদালত গঠনের প্রস্তাব। এরআগে যুবক নিয়ে পরপর দুইবারে ২টি কমিশন এবং একটি মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে সরকার। তারও আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত-তল্লাশিতে গেছে ১ বছর। ১/১১-র দাবানলে গেছে ২ বছর। সবমিলিয়ে যুবক সঙ্কটের ৯ বছরেও সদস্যদের পাওনা পরিশোধের কোনো কুলকিনারা হয়নি। ২০০৬ সালের ২৪ মে যুবকের একটি প্রকল্পের নামে অভিযোগ উত্থাপন দিয়ে ঘটনার শুরু। তারপর দায়িত্বহীন সংবাদ প্রতিবেদনের ফলে সদস্যদের মাঝে দেখা দেয় চরম হতাশা।

    শুরু হয় মামলা, মোকদ্দমা, আটক, অফিস ভাংচুর ও লুটপাট। অভিযোগ ছিলো যুবক বিভিন্ন প্রকল্পে নামে টাকা নিয়ে ২৩টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। অনেকের মতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অদূরদর্শীতার কারণেই যুবককে বলির পাঠা হতে হয়েছে। ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুবকের কার্যক্রমকে ঠিক রেখে দায়পরিশোধে সময়সীমা বেধে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করলেই সমস্যা এতদূর গড়াত না। যে প্রকল্পটির নামে অভিযোগ ছিলো সেটি বন্ধ রেখে বাকি প্রকল্পগুলো সচল রাখা দেশের ও সদস্যদের স্বার্থে উচিত ছিলো। আরটিভি, যুবক ট্যুরিজম, যুবক ফোন, যুবক হ্উাজিং, কৃষি বাংলা, হ্যাচারি এমন ২৩টি প্রকল্প বা প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যত অনিশ্চিত করা জাতীয় স্বার্থে কাম্য ছিলোনা।

    যুবক বিষয়ে ২০১০ সালের ২রা মে দৈনিক জনকন্ঠে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়- বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের বিশাল পরিকল্পনায় ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে যুবক। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতা আর ষড়যন্ত্রের গ্যাঁড়াকলে পড়ে মাঝপথেই থমকে দাঁড়ায় সংগঠনটি। ফলে আমানতকারীরা আস্থা হারায়। অনুসন্ধান চালিয়ে আইএফআইসি ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যুবক আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার কিনতে গিয়েই দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে যায়। সেখান থেকেই শুরু হয় যুবকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একটি সংবাদপত্রকে যুবকের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো হয়।

    যুবক নিয়ে কতিপয় মিডিয়ার অতি উতসাহের কারণ রহস্যজনক। পত্রিকাগুলো একদিকে যুবককে অবৈধ বা প্রতারক বলছে- যদিও সে অভিযোগ এখনো ষ¦তসিদ্ধ প্রমাণিত নয় এবং যা সংবাদপত্রের এখতিয়ারের বাইরে। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে- যুবকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যদি সত্যিই হবে তাহলে ৯ বছর তদন্তের পরও কেন নতুন আইন করে যুবককে আটকাতে হচ্ছে! অপরপক্ষে আরটিভি ও টেলিবার্তা (যুবক ফোন)-এর মতো বিশাল বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বিশেষ গ্রুপের অবৈধ দখলে থাকার পরও তারেকে কেন অবৈধ বা প্রতারক বলা হচ্ছেনা। এ বিষয়ে সেসব উতসাহী মিডিয়ার নিরব ভুমিকার কারণ কি দেশের জনগণ জানতে পারবে? মিডিয়ার অতি উতসাহ সম্পর্কে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির পত্রিকার সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ে সম্পাদকমন্ডলির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন- কেন যুবককে নিয়ে লিড নিউজ করা হলো? আজ যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকতো তাহলে হলমার্ক এক কোটি টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতো!

     বিপদের সুযোগ নেয় সুযোগসন্ধারীরা

    বাংলাদেশ ব্যাংক যুবককে ক্ষুুদ্র ঋণের অনুমতি দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকলেও বিগত জোট সরকারের শেষের দিকে সেটি আটকে দেয় প্রতিপক্ষ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালীরা। উল্টো চাপ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে যুবকের নামে শোকজ করা হয়। যুবক ফোনের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পর ইমেজ সঙ্কটের অভিযোগে ঢাকা ব্যাংক ৪০০ কোটি টাকা লোন বন্ধ করে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নামাকাওয়াস্তে একটি পত্রিকার মালিক যিনি নতুন দলও করেছিলেন তিনি নিজেকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী দাবি করে যুবকের কাছ থেকে নানা কৌশলে ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, আরটিভির সাবেক প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহ নেওয়াজ দুলাল জনকণ্ঠকে বলেন- আরটিভি প্রতিষ্ঠাকালে যুবকের শেয়ার ছিল শতকরা ৫৭ ভাগ। মোসাদ্দেক আলী ফালুর ৪০ ভাগ এবং আইএফআইসি ব্যাংকের পরিচালক বাদলের ৩ ভাগ।

    ১৪ আগস্ট, ২০১৪ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশ- গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণের কোনো উদ্যোগ না নেয়া হলেও অনেক সম্পত্তি বর্তমানে যুবকের দখলে নেই । নারায়ণগঞ্জ, ভোলা, বরিশাল, খুলনা ও বাগেরহাটে জমি বেদখল হয়ে গেছে। ‘মোসাদ্দেক আলীর কাছ থেকে আরটিভির বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নেয় যুবক। পরে ৫৭ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা বুঝে পায়।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় টাকা ছাড়াই যুবকের মালিকানা লিখে নেয় বেঙ্গল গ্রুপের মোর্শেদ আলমের পরিবার। ২৬ নভেম্ব^র ২০১৪, দৈনিক আমাদের সময় সংবাদে বলা হয়- মামলাধীন জমি, বিকে টাওয়ার নির্মাণ, আরটিভির শেয়ার, ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শেয়ার, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের বকেয়া ভাড়া নিয়ে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ চলছে।

    অর্থনীতি প্রতিদিন ৭ জানুয়ারি, ২০১৪ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ- য্বুকের টাকায় চলছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে ৮০ শতাংশ মালিকানা  শেয়ার দেয়ার শর্তে ১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যুবক।

     কমিশনের প্রতি হতাশা

    ২৩ এপ্রিল ২০১৩ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশ কমিশনের রিপোর্ট তৈরিতে লেগেছে সাত বছর। যুবকের পক্ষ থেকে সম্পত্তি বেদখল, সম্পত্তি ঘিরে চাঁদাবাজি বৃদ্ধির অভিযোগ করা হয়েছে। খুলনায় যুবক কমিশনের চিঠির দোহাই দিয়ে ২ হাজার শতক জমিতে নির্মিত বাগেরহাট হ্যাচারি স্থ’ানীয় ইউএনও দখল নিয়েছে। বগুড়ায় ৪ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্ষুব্ধ যুবক সদস্যরা দখল করে নিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ২০ কোটি টাকা মূল্যের ৩শ’ শতক জমি জোরপূর্বক রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে কতিপয় অসদস্য দুর্বৃত্ত। ভোলার সাবেক সচিব ৭৩৪ শতাংশ জমির পুরো মূল্য গ্রহণ করে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে। যুবকের কাছ থেকে মূল্য গ্রহণের পরও প্রায় ৭ কোটি টাকার জমি দখল করে আছে ভোলার চেয়ারম্যান মজনু মোল্লা। এছাড়া তেজগাঁওয়ে ৫০ শতক জমির ওপর নির্মিত ৪ তলা ভবনটির মাসিক ২ লাখ টাকা ভাড়া পাওনাদার যুবক সদস্যদের নামে জোরপূর্বক আদায় করে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা।

     টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষমতা নেই কমিশনের

    দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ২৬ জুলাই ২০১৫, প্রতিবেদনে বলা হয়- ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদকে চেয়ারম্যান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১১ সালের মে মাসে সাবেক যুগ্ম-সচিব রফিকুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে গঠন করা হয় যুবকবিষয়ক স্থায়ী কমিশন। এ কমিশনের দায়িত্ব ছিল যুবকের সম্পদ আয়ত্তে নিয়ে গ্রাহকের পাওনা পরিশোধের। কিন্তু আইনি জটিলতায় তা করতে সমর্থ হয়নি কমিশন।  শেষে ২০১৩ সালের জুনে যুবকে প্রশাসক নিয়োগের সুপারিশ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দায়িত্ব শেষ করে যুবক কমিশন। এ বিষয়ে ২০১২ সালের ২০ জুন দৈনিক কালের কন্ঠের প্রতিবেদনে বলা হয়- যুবকের গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেয়ার ক্ষমতা নেই কমিশনের! কমিশন বলছে, আইন অনুযায়ী তারা তা পারবে না। গ্রাহকরা যুবকের কাছে কত টাকা পায় এবং কোন পদ্ধতিতে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেয়া যাবে- এ দুটি বিষয় নির্ধারণ ছাড়া বাকি কোনো কিছুই আইন অনুযায়ী তারা করতে পারবে না। তাই যুবকের সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধের যে দায়িত্ব কমিশন গঠনের সময় সরকার দিয়েছিল, কমিশন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. এম জহিরের মতামত নিয়ে তা বাদ দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছেন যুবক কমিশনের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম। ১১ আগস্ট, ২০১৪ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশ- আইন মন্ত্রণালয়ের এ অভিমতের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যুবকে প্রশাসক নিয়োগের জন্য বলা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, আইনের কোনো বিধান নেই যুবকে প্রশাসক নিয়োগের। বিষয়টি আরও গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মর্তুজা রেজা চৌধুরী জানান, আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি যুবকে প্রশাসক নিয়োগ সম্ভব নয়। কারণ প্রশাসক নিয়োগ-সংক্রান্ত আইনের কোনো বিধান পাওয়া যায়নি। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

    ২০১৫ সালে আগস্টে দৈনিক প্রথম আলো বলছে- ঝুলেই রইল গ্রাহকদের পাওনা, যুবক কার্যক্রম বন্ধের নয় বছর পার হয়েছে কিন্তু বিষয়টির সুরাহার পথ এখনো বের করতে পারেনি সরকার। জনকন্ঠ ৮ ডিসেম্ব^র ২০১৪ সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে- পৃথক আইন দিয়ে একটি স্থায়ী কমিশন বা সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে। ওই কমিশন যুবকের সম্পত্তি সরকারের  হেফাজতে নেয়া, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা ও বিক্রি করে অর্থ প্রকৃত গ্রাহকদের মূল পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিদ্যমান কোম্পানি আইনে এ নতুন ধারা সংযোজন বা নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রশাসক নিয়োগের জন্য আইন ও নীতিমালা পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাহলে সহসাই প্রশ্ন জাগতে পারে- ৯ বছর তদন্ত অনুসন্ধানের পর যদি নতুন আইন করেই যদি যুবককে আটকাতে হয় তাহলে যুবকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো কি অসত্য ছিলো?