শ্রীমঙ্গলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত

    0
    251

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৮ডিসেম্বর,সুমন পাল: শ্রীমঙ্গলে অযতত্ন  অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলোর বেশির ভাগই অরক্ষিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার সাক্ষী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপাগল অজস্র নারী-পুরুষের বলীদানের স্মৃতিচিহ্ন এসব বধ্যভূমি হারিয়ে যাচ্ছে।

    ব্যতিক্রম শুধু বধ্যভূমি ৭১ এবং এর আঙিনা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে বধ্যভূমি ও গণকবরের কয়েকটি চিহ্নিত করে নির্মাণ করা দুই-একটি স্মৃতিস্তম্ভ এখন জরাজীর্ণ। এরমধ্যে শ্রীমঙ্গল শহরের পূর্বাশা এলাকার বধ্যভূমি, সিন্দুরখান এলাকার বধ্যভূমি, ওয়াপদা বধ্যভূমি, ফুসকুড়ি বধ্যভূমি, কালিঘাট বধ্যভূমি দেয়াল দিয়ে চিহ্নিত করা হলেও অনেকটা বেহাল দশা। বধ্যভূমিগুলোর সংরক্ষণে এখনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শ্রীমঙ্গল এ পর্যন্ত পাঁচটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে।

    এরমধ্যে বধ্যভূমি ৭১ বিজিবি’র তত্ত্বাবধানে স্থানীয়ভাবে চাঁদা তুলে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের বীর বাঙালিদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে চা শ্রমিকরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকরা হারিয়েছিল অসংখ্য সংগ্রামী ও যোগ্য নেতাকে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা পরাগ বাড়ই জানান, শ্রীমঙ্গল চা শ্রমিক ওয়েলফেয়ার অফিসে পাকহানার বাহিনীর টর্চার সেল ছিল।

    প্রতিদিন নারী-পুরুষ ধরে এনে সেখানে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হত। সাধুবাবা বটতলায় বটগাছে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হত। পরে সেখানে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হত। এভাবে কয়েক দফায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের এখানে এনে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল ভাড়াউড়া চা বাগানের প্রবেশমুখে একটি ছড়ার পাড়ে একসঙ্গে ঝরে পড়ে ৪৭ জন চা শ্রমিকের তাজা প্রাণ।

    বেলা প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে পাক হানাদার বাহিনী শ্রমিকদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেখানে শহীদ হয়েছিলেন বিশ্বময় হাজরা, গংগা বাড়ৈ, ভোমর চাঁদ, অমৃত হাজরা, রামচরণ গৌড়, গবিনা গৌড়, কৃষ্ণচরণ হাজরা, রবিনা গৌড়, হক হাজরা, বংশী মৃধা, শিব মোড়া, মোংরা তুড়িয়া, হোসেনি হাজরা, চিনি হাজরা, গৌড় হাজরা, টিমা হাজরা, সনিছড়া হাজরা, হুল্লা গোয়ালা, হিংরাজ হাজরা, চবণ হাজরা, মহারাজ হাজরা, সম মাঝি, নুকল হাজরা, কালচান হাজরা, সুখনন্দন রিকিয়াশন, ইন্দ্র ভূইয়া, ফাগু হাজরা, রামলাল হাজরা, জগুয়া হাজরা, বিমুর হাজরা, হিরুয়া হাজরা, শিবু মুন্ডা, টেটুয়া ভুইয়া, আগুনো ভুইয়া, বুকৌ তেলি, রাজকুমার মাল, গৌড় বুঝুয়া হাজরা, জগদেও কাহার, বুনিয়া হাজরা, ক্ষুদিরাম হাজরা, বিজনারায়ণ গোয়ালা, রাম দেও হাজরা, হুরকু হাজরা, রাম সরুপ হাজরাসহ প্রমুখ।

    স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসব শহীদ পরিবারের খোঁজখবর কেউ রাখেনি। শুধুমাত্র নামের তালিকা সংরক্ষণ ছাড়া। গণহত্যার শিকার দুস্থ এসব পরিবারের সদস্যদের বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সরকার তাদের খেয়েপড়ে বাঁচার ব্যবস্থা করবেন-এটাই এসব শ্রমিক পরিবারের দাবি। ভাড়াউড়া চা বাগান ছাড়াও সাতগাঁও (মাকরী ছড়া) চা বাগানে আপনা অলমিকসহ আরো ৬-৭ জন চা শ্রমিক পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন।

    ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে যখন বুঝতে পেরেছিল পরাজয়ই তাদের সুনিশ্চিত, তখন গোটা বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য শুরু হলো বুদ্ধিজীবী হত্যা। সেই কালো থাবা থেকেও রেহাই পায়নি চা শ্রমিকরা।

    চা শ্রমিক সমাজের অগ্রনায়ক, নিপীড়িত নির্যাতিত চা শ্রমিকদের জাগ্রত করায় যার ছিল অগ্রণী ভূমিকা, আপসকামী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে যিনি ছিলেন বিদ্রোহী বীর, সেই পবন কুমার তাঁতিকেও পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। চারদিন বন্দি রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। কালীঘাট চা বাগানের শিববাড়ী দাশিবাড়ী থেকে ধরে নিয়ে যায় তাকে। চা শ্রমিকদের মধ্যে পবন কুমার তাঁতি ছিলেন প্রথম গ্র্যাজুয়েট। ১৯৪১ সালে রাজঘাট চা বাগানে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে বাগানে চলে আসেন তিনি। ১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর ভোরে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে তাকে। শ্রীমঙ্গল শহরের ওয়াপদা অফিসের পিছনে ভুরভুরিয়া ছড়ায় পবনের লাশ ফেলে রেখে চলে যায় পাকবাহিনী। মুক্তিযুদ্বে দেশের বীর বাঙালির সঙ্গে চা শ্রমিকরাও যুদ্বে অংশ নিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করলেও স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও চা শ্রমিকরা মুক্ত হতে পারেনি অত্যাচার, অবিচার, শাসন ও শোষণের জাঁতাকল থেকে।

    মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে জয়ী হলেও সিন্দুরখান চা বাগানের সুধীর দাশ, রাজঘাট চা বাগানের পবন খড়িয়া ও কেজুরী ছড়া চা বাগানের চন্দ কাটারের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা চা শ্রমিকরা জীবন যুদ্ধে আজ পরাজিত। আজ কেউই তাদের খোঁজ রাখছেন না। ছাত্র-জনতার সঙ্গে সেদিন চা শ্রমিকদের রক্তও একই মোহনায় মিলিত হয়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা। জাতি পেয়েছিল লাল সূর্যখচিত পতাকা।

    শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে চা শ্রমিকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু ও চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর ব নার ইতিহাসের অবসান হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের আত্মাহুতির প্রায় ৩ যুগে পদার্পণ। এই একবিংশ শতাব্দির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগেও চা শ্রমিকরা রয়ে গেছে সেকালেই। আজও অত্যাচার ও শোষণের চাকায় পিষ্ট চা শ্রমিকদের জীবন। মুক্তিযোদ্ধা চা শ্রমিক ও যুদ্ধাহত চা শ্রমিকদের জীবনযাপন দেখলে মনে হয়, হয়তো ‘জন্মই তাদের আজন্ম পাপ’।

    তবুও মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে এদেশের আপামর জনতার সঙ্গে চা শ্রমিকরা যে বীরত্ব ও প্রত্যয়ের দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের সবার মাঝে।