শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হুজি নেতা গ্রেফতার

0
511
শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হুজি নেতা গ্রেফতার
শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হুজি নেতা আজিজুল হক রানা শাহনেওয়াজ ওরফে রুমান (৪৪)

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন-হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা আজিজুল হক রানা শাহনেওয়াজ ওরফে রুমানকে (৪৪) গ্রেফতার করা হয়েছে।

দীর্ঘ ২১ বছর পর রাজধানীর খিলক্ষেত বাজার এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। এই সুদীর্ঘ সময়ে সে বিভিন্ন ছদ্মবেশে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখে। নিজের পরিচয় গোপন করে জাতীয় পরিচয়পত্র নেয়। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে কখনও টেইলারিং আবার কখনও মুদি দোকানদার, বই বিক্রেতা, গাড়ি ড্রাইভিংও কাজ করত।

সর্বশেষ প্রিন্টিং ও স্ট্যাম্পপ্যাড বানানোর কাজ করত। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে জিহাদী বই, দুটি মোবাইল ফোনসেট, পেনড্রাইভ ও কম্পিউটারের হার্ডডিক্স উদ্ধার করা হয়।

এখনও এই হত্যা চেষ্টার মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত চার জঙ্গী পলাতক রয়েছে। এরা হচ্ছে, এনামুল, লোকমান, ইউসুস ও মোসায়েক। বুধবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আসাদুজ্জামান এসব তথ্য জানান।

সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান জানান, ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফরসঙ্গীদের হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান সরকারী আদর্শ কলেজ মাঠে সভামঞ্চের পাশে মাটির নিচে একটি ৪০ কেজি ওজনের বোমা এবং হেলিপ্যাড (ডহর পাড়া)’র পাশে মাটির নিচে একটি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্যরা।
গ্রেফতারকৃত আজিজুল হক রানা মুফতি হান্নানের সঙ্গে বোমা পুঁতে রাখার দায়িত্বে ছিল। ঘটনাটি প্রকাশ পেলে এবং বোমা দুটি উদ্ধারের পর আজিজুল হক কোটালীপাড়া থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতারকৃত আজিজুল হক রানা ১৯৮৭ সালে গাজীপুরের শ্রীপুর জামিয়া আনোয়ারিয়া মাদ্রাসায় নুরানি বিভাগে ভর্তি হন। এ সময় ওই মাদ্রাসার ওস্তাদ ও হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্য মুফতি হান্নানের অনুসারী মাওলানা আমিরুল ইসলামের সংস্পর্শে আসে। মাওলানা আমিরুল ইসলাম তাকে হরকাতুল জিহাদে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করে। মাদ্রাসায় মুফতি হান্নান, আব্দুর রউফ, আব্দুস সালামসহ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি) বিভিন্ন সিনিয়র সদস্যদের যাতায়াত ছিল। হুজি সদস্যরা ওই মাদ্রাসায় গোপন বৈঠক করতেন।

আসাদুজ্জামান জানান, আজিজুল হক সংগঠনে যোগদানের পর অন্য ছাত্রসহ প্রশিক্ষণ ও তালিম নেয়ার জন্য হুজি নেতা মুফতি ইজহারের চট্টগ্রামের লালখান মাদ্রাসায় যান ও তালিম গ্রহণ করে। তালিম শেষে সেখানে সে বোমা তৈরি, আত্মরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। মুফতি হান্নান সংগঠনের অপারেশনাল কার্যক্রমের জন্য সাহসী জিহাদী বিশ্বস্ত কয়েকজন লোক সংগ্রহ করার জন্য মাওলানা আমিরুল ইসলামকে দায়িত্ব দিলে তিনি আজিজুল হককে নির্বাচন করেন। আমিরুল ইসলাম তাকে একটি চিঠি লিখে দিলে সেটা নিয়ে গোপালগঞ্জ বিসিক এলাকায় সোনার বাংলা সাবান ও মোমবাতি তৈরির কারখানায় যায়।
মুফতি হান্নানের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাকে মাওলানা আমিরুল ইসলামের দেয়া চিঠিটি দেয়। মুফতি হান্নান তাকে সংগঠনের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বুঝিয়ে দেয় ও আজিজুল হকের নাম পরিবর্তন করে ছদ্মনাম ‘শাহনেওয়াজ’ দেন।

তিনি জানান, আজিজুল হক নতুন নাম শাহনেওয়াজ পরিচয়ে প্রায় ১৫ দিন মোমবাতি প্যাকিংয়ের কাজ করে। বিশ্বস্ততা অর্জন করলে কারখানার পেছনে একটি কক্ষে গোপন বৈঠকে উপস্থিত থাকার অনুমতি পায়। কারখানায় মোমবাতি ও সাবান তৈরির আড়ালে বোমা তৈরির কাজ চলত। বোমা তৈরির কাজে আজিজুল হকসহ মোঃ ইউসুফ ওরফে মোসহাব, মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ, ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক হোসেন, মোঃ মহিবুল ওরফে মফিজুর রহমান, শেখ মোঃ এনামুল হক, আনিসুল ইসলাম ওরফে আনিসসহ আরও অনেকেই জড়িত ছিলেন। ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফরসঙ্গীদের হত্যার উদ্দেশ্যে পুঁতে রাখা বোমা উদ্ধারের পর আজিজুল পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। মাওলানা আমিরুলের সঙ্গে দেখা করে।

দীর্ঘ ২১ বছর একটি চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি জঙ্গী সদস্য কীভাবে পালিয়ে থাকতে সক্ষম হলেন, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, এটা ব্যর্থতা নয়, সফলতা। ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেকে আত্মগোপনে রেখেছিল সে। সে ঘন ঘন জায়গা পরিবর্তন করত। ২১ বছর লাগলেও ব্যর্থতা নয় সফলতা এবং কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সাকসেসফুল হয়েছে। এই সংগঠনের সব শীর্ষ জঙ্গীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মামলায় আরও চারজন, মোঃ ইউসুফ, মোঃ লোকমান, শেখ মোঃ এনামুল ও মোঃ মিজানুর রহমান পালিয়ে আছেন। তাদেরও আমরা গ্রেফতার করতে পারব বলে আশা করছি। দেশে থেকেও আজিজুল হক সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। দেশের কোথাও নাশকতা কিংবা হামলার কোন পরিকল্পনা ছিল কি না আজিজুল হকের ? এমন প্রশ্নের উত্তরে সিটিটিসি প্রধান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন কোন তথ্য তার কাছ থেকে আমরা পাইনি।

যেভাবে ২১ বছর আত্মগোপন ছিল আজিজুলঃ সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান জানান, ‘আজিজুল হক দীর্ঘ ২১ বছর বিভিন্ন ছদ্মবেশে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখে এবং অত্যন্ত গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে টেইলারিং, মুদি দোকানদার, বই বিক্রেতা, ড্রাইভার এবং সর্বশেষ প্রিন্টিং ও স্ট্যাম্পপ্যাড বানানোর কাজ করত। তিনি জানান, রানা তার আসল পরিচয় গোপন করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। দেশ ত্যাগ করার জন্য পাসপোর্ট বানানোর চেষ্টা করে। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে জেনে সে পাসপোর্ট বানানো থেকে বিরত থাকে। সে সর্বশেষ খিলগাঁও একটি রাবার স্ট্যাম্পের দোকানে কাজ করে। এখনও সে হুজির সাংগঠনিক কাজে যুক্ত ছিল। তার কাছ থেকে বিভিন্ন পুস্তিকা উদ্ধার করা হয়েছে। অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান জানান, ২০০৭ সালে সে পরিচয় গোপন করে বিয়ে করে। সংসারও করে। গ্রেফতারকৃত আজিজুল বোমা তৈরিতে পারদর্শী। সে কাউকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে কিনা তা জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। তার বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ড পেলে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এ অবস্থায় তিনি বোমা তৈরির কৌশল অন্য কাউকে শিখিয়েছেন কি না ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করেছি। তাকে আমরা এসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তিনি হুজিবিকে রিফর্ম করার চেষ্টা কিংবা নতুন কাউকে বোমা তৈরির কৌশল শিখিয়েছেন কিনা ? তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বের করার চেষ্টা করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে ২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই মাঠেই পরদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। এ ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপ-পরিদর্শক নূর হোসেন মামলা করেন। এ ঘটনায় করা হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-২-এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদ- দেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন।

প্রায় ২১ বছর পর ২০২১ সালের ২৩ মার্চ এই মামলার রায় ঘোষণা হয় বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ ও হত্যা ষড়যন্ত্র এ মামলায় ১৪ আসামির সবার প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মোঃ কামরুজ্জামান। আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা জানান বিচারক। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে আজিজুল হক, লোকমান, ইউসুফ, এনামুল হক ও মোছহাব হাসান পলাতক ছিলেন।
এ মামলার প্রধান আসামি মুফতি আবদুল হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল। ২০০৪ সালে সিলেটে যুক্তরাজ্যের সাবেক হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলার দায়ে এই সাজা পেয়েছেন তিনি।