শীর্ষ বৈঠকে চীনও বাংলাদেশের মধ্যে ৫টি চুক্তি স্বাক্ষরিত

    0
    213

    আমারসিলেট24ডটকম,০৯জুনঃ ৬ দিনের এক সরকারি সফরে চীনে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সে দেশের প্রধানমন্ত্রী লিঃ কেকিয়াংয়ে মধ্যে আনুষ্ঠানিক দিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ শীর্ষ বৈঠকে অর্থনৈতিক ও কারিগরী ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ৫টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এর মধ্যে ২টিচুক্তি হচ্ছে- বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জলবায়ু পরিবর্তনেউদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা।আজ সোমবার সকালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের গ্রেট হলে দুদেশের মধ্যেআনুষ্ঠানিক বৈঠক শেষে এসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে দুদেশেরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বাক্ষর করেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবংচীনের প্রধানমন্ত্রী লিঃ কেকিয়াং নিজ নিজ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকশেষে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, স্বাক্ষরিত ৫টি চুক্তির মধ্যে দুটিচুক্তি হলো সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং পত্র বিনিময় (ইওএল)। প্রধানমন্ত্রীরমিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি একে এম শামীম চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
    পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকবলেন, চুক্তিগুলো হলো- বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনীতি ও কারিগরি সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তি এবং পটুয়াখালীতে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। তিনিবলেন, চট্টগ্রামে চীনা ইকোনোমিক এন্ড ইনভেস্টমেন্ট জোন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেবাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ জোন কর্তৃপক্ষ (বেপজা) এবং চীনের হারবারএন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীশেখ হাসিনার চীন সফরের চতুর্থ দিনে আজকের এ শীর্ষ বৈঠকের আগে বাংলাদেশেরপ্রধানমন্ত্রীকে গ্রেট হল অফ পিপল-এ গার্ড অফ অনার দেয়া হয়। তিনি গার্ডপরিদর্শন করেন এবং সামরিক অভিবাদন গ্রহণ করেন।
    এর আগে আজ সোমবার সকালেবেইজিংয়ে ‘সাম্প্রতিক বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সাফল্য এবং চীনের সঙ্গেঅংশীদারিত্ব’ শীর্ষক সেমিনারে চীনের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদেরপ্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বলেন, চীনে তার বর্তমান সফরেবাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহযোগিতার এক নতুন পথ উন্মোচিত হবে। তিনি বলেন, আমার চীন সফর একটি বিরাটসাফল্য। এখন থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় অতীতেরচেয়ে আরো বেশি গুরুত্ব পাবে। চায়না ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ(সিআইআইএস) বেইজিংয়ে তার নিজস্ব কার্যালয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
    প্রধানমন্ত্রীবলেন, বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মায়ানমার (বিআইসিএম) অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায়চীনের প্রস্তাবের প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে। এক সময়ের জনপ্রিয় “সিল্ক রুট” হিসাবে পরিচিত এই করিডোরের ফলে নেপাল ও ভুটানসহ এ অঞ্চলের সবদেশের জনগণ লাভবান হবে। স্বল্প সময়ে চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগতউন্নতির প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, চীনের সাম্প্রতিক উন্নয়নে তিনিঅভিভূত। চীন থেকে বাংলাদেশে অনেক কিছু শেখার রয়েছে। এসময় সিআইআইএস’রভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক কুটনীতিক রুয়ান জংঝে তার স্বাগত বক্তব্যেপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেনএবং তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে সাফল্যের বর্ণনা দেন।
    রুয়ানজংঝে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসাবে গড়ে তুলতেপ্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। এ প্রশ্নোত্তর পর্বেপিপলস ডেইলি ও শেন জেন টেলিভিশনের সাংবাদিক এবং চায়না কমিউনিকেশনইউনিভার্সিটির (সিসিইউ) ফ্যাকাল্টির সদস্যসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমেরপ্রতিনিধিরা অংশ নেন। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অগ্রগতি এবংবাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ এবং জনগণের সাথে জনগণের যোগাযোগসহ চীন-বাংলাদেশসম্পর্কোন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এ সময় সিআইআইএস সদস্য, ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষার বিপুল সংখ্যক সাবেকছাত্র-ছাত্রী এবং উভয় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ও চীনা ভাষায়অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
    শেখ হাসিনা তারলিখিত ভাষণে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে চীনের অব্যাহত সমর্থনেরপ্রশংসা করে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে এদেশের জনগণের লড়াইয়ে চীন আরো সমর্থন ও সহযোগিতা দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন।২০১১ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি মডেল’ বলে যেমন্তব্য করেছেন তার উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিবের এ বক্তব্য তারসরকারকে ‘রূপকল্প-২০২১’ কৌশল গ্রহণে উৎসাহিত করেছে।
    প্রধানমন্ত্রীবলেন, আমি বিশ্বাস করি আমাদের সরকার তার পূর্ণাঙ্গ অঙ্গীকার ও নিষ্ঠাসহ এলক্ষ্য অর্জনে সফল হবে এবং বাংলাদেশ সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও শান্তির দিকে এগিয়েযাবে। আমি জানি, আমরা আমাদের বন্ধুদের বিশেষ করে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনেরসরকার ও জনগণের সমর্থন এবং সহযোগিতায় সাফল্য লাভ করব। তিনি প্রধানমন্ত্রীহিসেবে তার মেয়াদকালে বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের সাফল্য এবং বাংলাদেশ-চীনক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, পারস্পরিক শ্রদ্ধাও মূল্যবোধের অংশীদারিত্ব এবং প্রাচীন কাল থেকে ব্যবসা ও ভ্রমণের মাধ্যমেজনগণের সাথে জনগণের যোগাযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে চমৎকারসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠতরহয়েছে।
    এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে চীনের যেসব ছাত্র-ছাত্রীপড়াশোনা করতে আগ্রহী আমরা তাদেরকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করবো।চীনও বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তিনিআশা প্রকাশ করেন। চীনকে সহযোগিতার অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো আদর্শিক ও আঞ্চলিক পক্ষপাত ছাড়াই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হয়েছে।বাংলাদেশ ও চীন উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থে কার্যকর যে কোনোইস্যুকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে আসছে।
    মহাজোট নেতা বলেন, বাংলাদেশশান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারেরভিত্তিতে একটি সম্প্রীতির সমাজ গড়ার চীনের নীতির প্রতি পুরোপুরি সমর্থনদিয়ে আসছে। জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্কএগিয়ে নিতে গভীরভাবে আগ্রহী। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতার কথাউল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করেসংস্কৃতি, শিল্প ও কৃষি, পানিসম্পদ, বন্যা পূর্বাভাস, ভূমিকম্পসতর্কবার্তা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং জননিরাপত্তা পর্যন্তএ সহযোগিতা বিস্তৃত।
    প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গত ৫ বছরে বাংলাদেশ চীনেরসঙ্গে ১৭টি চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষর করেছে। ফলে ২০০৭ সাল থেকে চীনবাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ও আমদানির উৎসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এবাণিজ্য খুবই ভারসাম্যহীন। বাংলাদেশ চীন থেকে ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানিকরছে। বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানির পরিমাণ ৫০ কোটি ডলারেরও কম।
    বাণিজ্যিকব্যবধান কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশেচীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৯ সালের ২১ দশমিক ২৪ মিলিয়ন থেকে ২০১২সালে ১৮১ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৩ সালে চীনের৪৯টি কোম্পানী বাংলাদেশের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে ৩১ কোটি ডলারবিনিয়োগ করেছে।
    প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্তবাংলাদেশ চীনের অনুদান ও সহায়তা পেয়েছে ২৬৬ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। একই সময়ঋণ পেয়েছে ১ হাজার ৭৩১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। চীনের এসব অনুদান, সাহায্য ওসহজ শর্তের ঋণ বাংলাদেশে ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। এছাড়া আরও৬টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ১৪টি অগ্রাধিকার প্রকল্প সহজ শর্তের ঋণ সহায়তাবিবেচনার জন্য চীন সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
    বাংলাদেশ- চীন-ভারত- মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের (বিসিআইএম-ইসি) ব্যাপারে চীনের সক্রিয়ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, এই গ্রুপের প্রথম স্টাডি বৈঠকেযোগাযোগ, পণ্য বাণিজ্য, সেবা ও বিনিয়োগ, পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন এবং জনগণেরসাথে জনগণের যোগাযোগকে সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
    বাংলাদেশেরসংসদ নেতা বলেন, এ বছরের শেষ দিকে ঢাকায় এ গ্রুপের দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিতহবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের বাংলার সঙ্গে চীনেরসম্পর্ক সুপ্রাচীন। এ সম্পর্কের সূচনা হয় দক্ষিণের সিল্ক রুটে বাণিজ্য ওভ্রমন এবং আমাদের জনগন ও অঞ্চলের মধ্যে পণ্য, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিনিময়েরমাধ্যমে। তিনি তাইওয়ান ও তিব্বত ইস্যুতে ‘এক চীন নীতি’র প্রতি বাংলাদেশেরদৃঢ় সমর্থনের কথা পুনরায় উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের জনগণপ্রগতিশীল এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিনি বলেন, আমাদের ১৬ কোটি মানুষ এসবনীতিমালা রক্ষা করতে সংকল্পবদ্ধ।
    প্রধানমন্ত্রী এও বলেন, বাংলাদেশের সকলধর্মের লোক শান্তি-সমৃদ্ধির সঙ্গে বসবাস করতে এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নেরমাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক আধুনিক ও সমৃদ্ধজাতি গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।