শাহিনার দেহ নলকূপের ৬১ ফুট গভীর থেকেই উদ্ধার

    0
    237

    আমারসিলেট24ডটকম,১৪মার্চঃ হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক মাস সাত দিন পর উদ্ধার করা হলো হতভাগ্য গৃহবধূর লাশ। ২৬০ ফুট গভীর নলকূপের ৮০ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপের মধ্যে ছিল শাহিনার লাশ। পাইপের ৬১ ফুট গভীর থেকে উদ্ধার করা হয় শাহিনার অর্ধগলিত লাশ।

    কুমিল্লার জেলার দেবীদ্বার উপজেলায় পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের ৬১ ফুট গভীর থেকে শাহিনা আক্তার নামের এক গৃহবধূর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এক মাস আগে প্রবাসী স্বামীর ভাড়াটে লোকেরা তাঁকে হত্যা করে নলকূপে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
    হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক মাস সাত দিন পর উদ্ধার করা হলো ওই হতভাগ্য গৃহবধূর লাশ। ২৬০ ফুট গভীর নলকূপের ৮০ ফুট দীর্ঘ ও ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপের মধ্যে ছিল শাহিনার লাশ। পাইপের ৬১ ফুট গভীর থেকে উদ্ধার করা হয় শাহিনার অর্ধগলিত লাশ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই নিখোঁজ ছিলেন শাহিনা আক্তার। গত বৃহস্পতিবার  দিবাগত রাত পৌনে তিনটা থেকে পুলিশ লাশ ওঠানোর কাজ শুরু করে। সাত দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার  দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তাঁর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়।
    উদ্ধার অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফুল ইসলাম, দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন, দেবীদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  তারেক মোহাম্মদ হান্নান, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দেবীদ্বার থানার উপপরিদর্শক (এএসআই) শাহকামাল আকন্দ, জনপ্রতিনিধি ও সংবাদকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
    গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ শাহিনা

    মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দেবীদ্বার থানার উপপরিদর্শক  শাহকামাল আকন্দ জানান, গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহিনা আক্তার রাতের খাওয়া শেষে তার সন্তানদের নিয়ে ঘুমান। পরদিন সকাল থেকেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। শাহিনার ভাই মজিবুর রহমান সরকার তাঁর বোন নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে বাদী হয়ে গত ৯ ফেব্রুয়ারি দেবীদ্বার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

    ১০ জনকে আসামি করে মামলা

    দেবীদ্বার থানার উপপরিদর্শক শাহকামাল আকন্দ আরও জানান, নিহত শাহিনার মুঠোফোনের তালিকা ধরে পুলিশ ১০ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি শাহিনার ভাই ওই ১০ জনকে অভিযুক্ত করে কুমিল্লার আদালতে বোনকে অপহরণ, হত্যা ও গুম করার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামিরা হলেন শাহিনার শাশুড়ি রফেজা বেগম, স্বামী মোবারক হোসেন, ছেচড়াপুকুরিয়া গ্রামের মো. জসীম উদ্দিন, জাহিদ মিয়া, রুহুল আমীন, আবদুল করিম, সেলিম মিয়া, ইজ্জত আলী ও খোকন। বাকি একজনের নাম জানা যায়নি।

    হত্যাকারীর জবানবন্দি
    মুঠোফোনের তালিকা ধরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দেবীদ্বার থানার উপপরিদর্শক শাহকামাল আকন্দ একদল পুলিশ নিয়ে ৭ মার্চ রাতে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থান নেন। সেখান থেকে এক নারী পুলিশকে দিয়ে ফোনে প্রেমালাপের মাধ্যমে অপহরণ মামলায় অভিযুক্ত অন্যতম আসামি আবদুল করিম শেখকে ঘটনাস্থলে ডেকে এনে আটক করে। পরে আবদুল করিম বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে শাহিনা আক্তার হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন।

    জবানবন্দিতে আবদুল করিম শেখ জানান, শাহিনার স্বামী মো. মোবারক হোসেন আবুধাবিপ্রবাসী। স্ত্রী শাহিনা আক্তারকে হত্যা ও গুম করার কাজে দুই লাখ টাকায় ১০ জনকে ভাড়া করেন তিনি।

    করিম শেখ আরও জানান, মোবারকের পরামর্শে শাহিনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ঘটনার দিন ৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে মুঠোফোনে শাহিনাকে বাড়ির বাইরে ডেকে আনেন করিম শেখ। দুই সহযোগীকে নিয়ে বাড়ির উত্তর পাশের নির্জন জায়গায় নিয়ে শাহিনাকে গলা টিপে হত্যা করে করিম শেখ। পরে একটি বস্তায় চারটি ইট ভরে সেই বস্তা শাহিনার গলায় বেঁধে পাশের একটি অব্যবহূত নলকূপের পাইপের ভেতরে ফেলে দেওয়া হয়। পরে পাইপের ভেতরে মাটি চাপা দেন তাঁরা।

    কুমিল্লার ৪ নম্বর আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতের বিচারক মো. সফিকুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করে তাঁকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

    শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হলো লাশ

    নলকূপ স্থাপন ও উত্তোলন প্রতিষ্ঠান ‘ভাই ভাই মুক্তা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ’, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর সহায়তায় লাশ তোলার কাজ চলে। ভাই ভাই মুক্তা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী মো.ঃ আলী আকবর বলেন, ‘গত ৮ মার্চ  বিকেল থেকে উত্তোলন সরঞ্জাম সরবরাহ ও সেগুলো স্থাপন করে রোববার থেকে কাজ শুরু করেছি। সম্পূর্ণ পাইপ উত্তোলন করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ৯ শ্রমিক এবং স্থানীয় ৫ শ্রমিকসহ ১৪ জন শ্রমিক দিন-রাত কাজ করেছিল।’

    আলী আকবর জানান, নলকূপ ছিল ২৬০ ফুট গভীর। ৮০ ফুট দৈর্ঘ্যের ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপের মধ্যে ছিল শাহিনার লাশ। পাইপের ৬১ ফুট পর্যন্ত খুঁড়ে শাহীনার লাশ উদ্ধার হয়।

    মায়ের জন্য তিন শিশুর আহাজারি

    শাহিনার লাশের খোঁজে নলকূপের পাইপ তোলার কাজ চলার সময় প্রতিদিনই নিহত শাহিনার দুই ছেলে ইমরান হোসেন (১৩), তুষার আহমেদ (১০) ও একমাত্র মেয়ে রোজিনা আক্তার (৭) গিয়ে আহাজারি করেছে। তাদের সঙ্গে শত শত উত্সুক মানুষের ভিড়ও ছিল ঘটনাস্থলে। সবাই প্রতীক্ষায় ছিল কখন লাশ উঠবে।

    স্বামী শ্বশুরবাড়িতেনির্যাতিত ছিলেন 

    স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১৫ বছর আগে উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের তুলাগাঁও গ্রামে শাহিনা আক্তারের (৩৫) সঙ্গে একই ইউনিয়নের ছেচড়াপুকুরিয়া গ্রামের মোঃ. মোবারক হোসেনের (৪০) বিয়ে হয়। তিন সন্তান থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পর থেকেই শাহিনা আক্তারের ওপর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নির্যাতন শুরু করে। এ নিয়ে কয়েকবার গ্রামে সালিসি বৈঠকও হয়। শাহিনা আক্তারের বাবা মো. কেরামত আলী সরকার জমি বিক্রি করে চার লাখ টাকা দিয়ে মেয়ের স্বামী মো. মোবারক হোসেনকে আবুধাবি পাঠান। কিন্তু মোঃ মোবারক হোসেন বিদেশ থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের কোনো টাকা পাঠাতেন না। শাহিনা তাই অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিন সন্তানকে লালনপালন করতেন।

    স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলাও  করেছিলেন 

    যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে স্বামী মোবারক হোসেন, শাশুড়ি রাফেজা বেগম, ভগ্নিপতি আমির হোসেনসহ আটজনকে অভিযুক্ত করে ২০১২ সালের ২১ মার্চ দেবীদ্বার থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-২৩)  বাদী ছিলেন শাহিনা আক্তার নিজেই।