শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী মহা রাসলীলা ২৩ নভেম্বর শুক্রবার

    0
    267

    কমলগঞ্জের মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী মহা রাসলীলা ২৩ নভেম্বর শুক্রবার

    সোলেমান আহমেদ মানিক: সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত কমলগঞ্জ উপজেলায় মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঐতিহ্যবাহী মহা রাসলীলা আগামী ২৩ নভেম্বর (শুক্রবার)।
    এই বৎসর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ১৭৬তম মহা রাসলীলা। প্রতি বছর পূর্ণিমা তিথিতে স্বাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণময় শিল্পকলা সমৃদ্ধ মনিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মাহা রাসলীলা উৎসব। মনিপুরী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ও মাধবপুরে আশ্বিন মাসের শুরু থেকেই উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। উপজেলার মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে উঠে এ আনন্দ উৎসবের।
    দেশের বিভিন্ন স্থানসহ ভারত থেকেও মনিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন সহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেই ছুটে আসেন মহা রাসলীলা অনুষ্ঠান উপভোগের জন্যে। মনিপুরী সম্প্রদায় অধ্যুষিত কমলগঞ্জের আদমপুর ও মাধবপুরের রাসোৎসবের জন্যে তৈরি মণ্ডপগুলো সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মণ্ডপগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত শিশু নৃত্য শিল্পীদের সুনিপুণ অভিনয় যেন মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে দর্শনার্থীর সমাগম।
    মনিপুরীদের মহা রাস বলতে প্রেম রসকে বুঝানো হয়। বস্তুত রস শব্দ থেকেই রাস শব্দটির উৎপত্তি। রস আস্বাদনের জন্য রাধাকৃষ্ণের লীলানুকরণে নৃত্য গীতের মাধ্যমে যে উৎসব উদযাপন করা হয় তাই রাসোৎসব। নৃত্য, সংগীতে  মনিপুরীদের প্রাচীন জাতীয় লোক নৃত্য ‘লাই হারাওবা’ থেকেই রাস নৃত্যের সৃষ্টি। জানা যায় ১৭৭৯ খৃস্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে যে নৃত্য গীতের প্রবর্তন করেছিলেন তা-ই রাস নৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর একশত বছর পরে মহারাজ চন্দ্র কীর্তির শাসনামলে গোটা রাস নৃত্য আচৌকা ভঙ্গী, বৃন্দাবন ভঙ্গী, খুডুম্বা ভঙ্গী, গোষ্ট ভঙ্গী, গোষ্ট বৃন্দাবন ভঙ্গী, আচৌবা, বৃন্দাবন ভঙ্গী তাণ্ডব পর্যায়ে পড়ে।
    উল্লেখ্য, মহারাজ ভাগ্য চন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশিরভাগই ছিলেন নৃত্য গীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাস নৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। এর ফলে মনিপুরীরা এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই ১৯৪২ খৃস্টাব্দ থেকে আজও কোনও রূপ-বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে এ রাস উৎসব। মনিপুরী এ নৃত্যকলা শুধু কমলগঞ্জের নয় গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মনিপুরী নৃত্য শিক্ষা।
    কার্তিক মাসের প্রথম থেকেই চলে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মনিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে। কিশোরীরা  রাসলীলায় অংশগ্রহণ করে এবং রাখাল নৃত্যের শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করে। রাখাল নৃত্য সাধারণ দিনের বেলায় অর্থাৎ সূর্যাস্তের আগেই অনুষ্ঠিত হয়। এদের পরনে ছিল ধুতি, মাথায় ময়ূর, পালকের মুকুট, কপালে চন্দ্রের তিলক, গলায় সোনার মালা, হাতে বাঁশি ও পায়ে নূপুর। এরপর বাঁশি হাতে বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অনুকরণে একজন শিশু শিল্পী মাঠে প্রবেশ করে। অনেকক্ষণ ধরে চলে এই নৃত্য গীতি। রাতে শুরু হয় মহা রাসলীলা। শুরুতেই পরিবেশিত হয়  রাসধারীদের অপূর্ব মৃদঙ্গ নৃত্য। মৃদঙ্গ নৃত্য শেষে প্রদীপ হাতে নৃত্যের তালে তালে সাজানো মঞ্চে প্রবেশ করেন শ্রী রাধা সাজে সজ্জিত একজন নৃত্যশিল্পী তার নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যের তালে তালে পরিবেশিত হয় মনিপুরী বন্দনা সঙ্গীত। শ্রী কৃষ্ণ রূপধারী বাঁশী হাতে মাথায় কারুকার্য খচিত ময়ূর পুচ্ছধারী এক কিশোর নৃত্য শিল্পী তার বাঁশির সুর শুনে  ব্রজ গোপী পরিবেষ্টিত হয়ে শ্রী রাধা মঞ্চে আসেন। শুরু হয় সুবর্ণ কংকন পরিহিতা মনিপুরী কিশোরীদের নৃত্য প্রদর্শন।
    উৎসবের আয়োজকরা জানান, রাস উৎসবকে সফল করতে প্রায় মাস খানেক ধরে এলাকার ছয়টি বাড়িতে রাসনৃত্য এবং রাখালনৃত্যের প্রশিক্ষণ ও মহড়া চলছে। তিনটিতে রাসনৃত্য ও তিনটিতে রাখাল নৃত্য। মাধবপুরে তিনটি জোড় মণ্ডপের আওতায় এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একেকটি মণ্ডপে আছেন একজন পুরোহিত। সেই পুরোহিতের পরামর্শে একজন প্রশিক্ষক ধর্মীয় বিধিবিধান মতো গোপী বা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেন।
    প্রশিক্ষককে সহযোগিতা করতে একজন সহকারী প্রশিক্ষকও রয়েছেন। প্রশিক্ষক শিল্পীদের ঠিক করেন। এরপর সামাজিক বিধান মতো শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমন্ত্রণের বাইরেও কেউ চাইলে রাসনৃত্যে অংশ নিতে পারেন। গোপীবেশী এই শিল্পীদের বয়স ১৬ থেকে ২২ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে । শুধুমাত্র রাধার বয়স হয় পাঁচ থেকে ছয় বছর। নৃত্যের প্রতিটি দলে নূন্যতম ১২ জন অংশ নিয়ে থাকে। একইভাবে রাখাল নৃত্যেরও প্রতিটি দলে ২০ – ২৪ জন ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী বালক অংশ নিয়ে থাকে।
    আদমপুর ও মাধবপুর ইউপি’র রাসমেলার আয়োজকরা আরোও জানান, মহা রাসলীলা মূল উপস্থাপনা শুরু হবে সকাল ১১টা থেকে “গোষ্ঠলীলা বা রাখালনৃত্য” দিয়ে। গোষ্ঠলীলায় রাখাল সাজে কৃষ্ণের বালকবেলাকে উপস্থাপন করা হবে। এতে থাকবে কৃষ্ণের সখ্য ও বাৎসল্য রসের বিবরণ। গোধূলি পর্যন্ত চলবে রাখালনৃত্য। রাত ১১টা থেকে পরিবেশিত হবে মধুর রসের নৃত্য বা শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলানুসরণ। এই রাসনৃত্য ভোর পর্যন্ত চলবে। এই রাসনৃত্যে গোপিনীদের সাথে কৃষ্ণের মধুরলীলাই কথা, গানে ও সুরে ফুটিয়ে তুলবেন শিল্পীরা।
    মনিপুরী মহা রাসলীলা সেবা সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, আমাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণ। এখন পুরো এলাকায় উৎসবের আমেজ। নতুন কাপড়চোপড় কেনা হয়েছে। আমাদের কাছে হেমন্তকাল মানেই রাস-পূর্ণিমা, রাস উৎসব।
    আদমপুর মহা রাস উদযাপন কমিটির নেতা ইবুংহাল সিংহ শ্যামল জানান, সকল আয়োজন এখন শেষ পর্যায়ে। আমাদের উৎসব সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হবে এমনটাই প্রত্যাশা।