রাজউক কর্মচারীর ছেলে ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ এর উত্তান পতন

    0
    253

    গ্রেফতার হলেন বহুল আলোচিত জুয়ার বড় আসর হিসেবে পরিচিত ক্যাসিনো সম্রাট যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বহু অপরাধের সাক্ষী ক্যাসিনো জুয়ার অন্যতম কর্ণধার ঢাকা মহানগর যুবলীগের দক্ষিণের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকেও গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারের পর সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে তার কাকরাইলের অফিসে টানা পাঁচ ঘণ্টা অভিযান চালায় র‌্যাব।

    অভিযানে অফিস থেকে প্রায় বারো শ’ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, পাঁচ রাউন্ড তাজা বুলেট, একটি ম্যাগজিনসহ একটি অত্যাধুনিক বিদেশী পিস্তল ও দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার হয়। উদ্ধারের পরপরই সম্রাটকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ক্যাঙ্গারুর চামড়া রাখার দায়ে ছয় মাসের কারাদন্ড প্রদান করেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম। সাজা দেয়ার পর কাকরাইল থেকে কড়া নিরাপত্তায় সোজা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।

    আর মাদক ও অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় মামলা দায়ের হচ্ছে।

    সম্রাটের উত্তানের আড়ালেঃ 

    পুরো নাম ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। তবে ‘ক্যাসিনো সম্রাট’ হিসেবেই পরিচিত তিনি। গ্রামের বাড়ি ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন তার বাবা ফয়েজ আহমেদ।

    বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে সম্রাটদের পরিবারের কেউ থাকে না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন তিনি। ক্যাসিনো কারবার সংযুক্ত করেন ঢাকার ক্লাবগুলোতে। এক দশকের বেশি সময় ধরে জুয়া খেলা ছাড়াও চাঁদাবাজি, টেন্ডার, বাড়ি ও জমি দখল করার মতো ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বার বার অভিযোগ উঠেছে। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে এই সাবেক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে।

    সম্রাটের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯০ সালে। সারাদেশে এরশাদের শাসনবিরোধী আন্দোলন চলছিল তখন। ছাত্রলীগের সংগঠক হিসেবে রমনা অঞ্চলে আন্দোলন সংঘটিত করেছেন সম্রাট। এ কারণে জেলও খাটতে হয় তাকে। কথিত আছে, এরশাদের জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র সমাজের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। ২০০৩ সালে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। তখন দক্ষিণের সভাপতি ছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। অভিযোগ, শাওনই সম্রাটকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। পরে ২০১২ সালে সম্রাট ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি হন। এরপর আর তার পেছনে তাকাতে হয়নি।

    দলীয় সমাবেশগুলো সফল করতে সম্রাট বিভিন্ন সময় ভূমিকা রাখেন। টাকা ও জনবল সরবরাহের কাজ করতেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। সম্রাটকে যুবলীগের ‘শ্রেষ্ঠ সংগঠক’ ঘোষণা করা হয়। আর তার ইউনিটকে ঘোষণা করা হয় সেরা সাংগঠনিক ইউনিট। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ার সুবাদে তার ছিল বিশাল বাহিনী। কাকরাইলের অফিসে অবস্থান করলেও কয়েকশ’ নেতাকর্মী সব সময় তার আশপাশে অবস্থান করতেন। কার্যালয় থেকে বেরিয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিত শতাধিক নেতাকর্মী। ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজির টাকা দিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য চালাতেন তিনি।

    দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মিল্ক্কী হত্যার পর সম্রাট তার প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও বাড়াতে থাকেন। মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল ও বাড্ডা এলাকার অপরাধ জগতে তার একক আধিপত্য তৈরি হয়। ঢাকার এক সময়কার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। তবে অতি সম্প্রতি জিসানকে দুবাইয়ে গ্রেফতারের পর জানা যায়, সম্রাট ও জি কে শামীমকে হত্যার ছক ছিল তার।

    ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত ছিলেন সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরীও। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দেন। গতকাল রোববার সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীও বলেছেন, সম্রাটের নেশা ছিল জুয়া খেলা। তিনি একজন পেশাদার জুয়াড়ি। মাসে একাধিকবার সিঙ্গাপুরে তিনি জুয়া খেলতে যেতেন। সেখানকার সবচেয়ে বড় জুয়ার আস্তানা মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোতে পশ্চিমের দেশগুলো থেকেও আসে জুয়াড়িরা। সেখানেও সম্রাট ভিআইপি জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত। প্রথম সারির জুয়াড়ি হওয়ায় সিঙ্গাপুরের চেঙ্গি এয়ারপোর্টে তাকে রিসিভ করার বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে মেরিনা বে স্যান্ডস ক্যাসিনোয় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিলাসবহুল লিমুজিন গাড়িতে।

    বিয়ে নিয়ে নানা কাহিনীঃ

    বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে একাধিক বিয়ে করেছেন সম্রাট। প্রথম স্ত্রী ডালিয়া বেগম ডলির সঙ্গে অনেক আগেই তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে। সেই ঘরে তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম শারমিন চৌধুরী। তিনি থাকতেন ডিওএইচএসের বাসায়। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর থেকে আর নিজের বাসায় যাননি সম্রাট। কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন তিনি। মাসের শুরুতে স্ত্রী শারমিন চৌধুরী সেই অফিসে গিয়ে মাস খরচের টাকা নিয়ে আসেন। কথিত আছে, ছাত্রলীগের এক নেত্রী আর একজন অভিনেত্রীকেও বিয়ে করেছেন তিনি। তবে এসবের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মালয়েশিয়ার নাগরিক সিন্ডলিংয়ের সঙ্গেও তার ‘ব্যক্তিগত সম্পর্ক’ নিয়ে নানা কাহিনী শোনা যায়। ভার্চুয়াল জগতে সম্রাটের কিছু ছবি নিয়ে আছে নানা আলোচনা। কোনো এক অনুষ্ঠানে তোলা একটি ছবিতে সিন্ডলিংসহ কয়েকজনের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় দেখা যায় তাকে। সম্রাটের ঘনিষ্ঠজন বলছেন, ছবিটি ২০১৭ সালে সিন্ডলিংয়ের জন্মদিনে তোলা। অনুষ্ঠানস্থল মালয়েশিয়ার যহুর বারুতে সিন্ডলিংয়ের বাসা। তার জন্মদিন উপলক্ষে সে বার সম্রাট দেড় কোটি টাকা দিয়ে একটি প্রমোদতরী ভাড়া নিয়েছিলেন। সিন্ডলিংকে একটি বিলাসবহুল গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি সম্রাট সিনেমা পরিচালনায়ও নামেন। বছরখানেক আগে তিনি সিনেমা নির্মাণের লক্ষ্যে ‘দেশবাংলা মাল্টিমিডিয়া’ নামে প্রতিষ্ঠান খোলেন। এই হাউস থেকে একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। আরেকটি সিনেমার শুটিং চলছে। সিনেমার কাজ দেখাশোনা করতেন তার সহযোগী আরমান।